, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

Avatar n_carcellar1957

রক্তে রাঙা শিক্ষাঙ্গন

প্রকাশ: ২০১৫-০৫-৩১ ১৩:৩১:২৬ || আপডেট: ২০১৫-০৫-৩১ ১৩:৩১:২৬

Spread the love

1888971_1835619253330488_8868565174818966901_oসবুজ, সতেজ মনগুলি জুড়ে ছিল হরেক স্বপ্ন৷ কিন্তু নির্বিচার সন্ত্রাস এক ঝটকায় নিভিয়ে দিল সে সম্ভাবনা৷ হয়তো বা চিরতরেই৷ যারা এক দিন মালালাকে মারতে চেয়েছিল, সে রকমই কেউ মেরে ফেলল শয়ে শয়ে কোমল প্রাণকে৷ ফোটার আগেই ঝরে গেল তারা, পড়ে রইল শুধুই হাহাকার আর পরিজনের দীর্ঘশ্বাস

মঙ্গলবার সকালে রোজকার মতোই ইউনিফর্ম পড়ে স্কুলে গিয়েছিল ১৪ বছরের ছটফটে ছেলে৷ যাকে ঘিরেই ভবিষ্যতের নানা স্বপ্ন বুনেছিলেন তাহের আলি৷ তার কফিনবন্দি দেহটা হাসপাতাল থেকে নিতে এসে হাহাকার করে উঠলেন তাহের৷ তার বিশ্বাস আর স্বপ্নের পৃথিবীটা নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে৷

প্রতিদিন ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে আসেন মেহের তারার৷ গাড়ি থেকে নেমে ছেলে যখন স্কুলের গেট পেরিয়ে ঢোকে, তখন মায়ের মনের কোণে অজান্তেই কোথাও হয়তো উঁকি দিয়ে যায় উৎকণ্ঠা৷ তার কারণ এই নয়, যে স্কুলে নিরাপত্তার অভাব নিয়ে দুশ্চিন্তা রয়েছে তার৷ কিন্তু যতক্ষণ না দিনের শেষে ছেলের সঙ্গে দেখা হয়, ততক্ষণ নিজেকে অসম্পূর্ণ মনে হয় মেহেরের৷ মনে হয়, তার সত্তার একটা অংশ যেন অন্য কোথাও পড়ে রয়েছে৷

মঙ্গলবার টিভির পর্দায় যখন ভেসে উঠল পেশোয়ারের সেনা স্কুলে তালেবান হানার খবর, তখন যেন হৃৎস্পন্দনটাই থেমে গিয়েছিল তার৷ এমনটা তো তার সন্তানের ক্ষেত্রেও ঘটতে পারত!

এই হাহাকার, এই উৎকণ্ঠা দেশ-কাল-জাতির সীমা মানে না, মানেনি৷ পাকিস্তানের নারকীয় ঘটনা এক ভাষাহীন বিস্ময়-আতঙ্কে স্তব্ধ করে দিয়েছে গোটা পৃথিবীকে৷ উঠে এসেছে একটাই প্রশ্ন… কেন?

কেন সন্ত্রাসের বলি হলেঅ শিশুরা, রাজনীতির সমীকরণ বা সামরিক শক্তিপ্রদর্শনের খেলায় যাদের কোনো ভূমিকাই নেই? যারা স্কুলের বারান্দায় ‘দাড়িওয়ালা সালোয়ার-কামিজ পরা’ লোকগুলোকে দেখে প্রথমে বুঝতেই পারেনি, কিছুক্ষণ পরে নির্বিচার নির্মম গুলি এসে লাগবে তাদের বুকে, পেটে, মুখে, মাথায়… ঝাঁঝরা করে দেবে?

আর এই তো প্রথম নয়৷ সাম্প্রতিক অতীতে বারে বারেই সন্ত্রাসবাদীদের নিশানা হয়েছে শিশু এবং স্কুলপড়ুয়ারা৷ বিশেষ করে পাকিস্তান ও বালুচিস্তানে৷ গত পাঁচ বছরে পাকিস্তানে অন্তত ১৩ বার জঙ্গি হানার লক্ষ্য কোনো স্কুল বা স্কুল পড়ুয়ারা৷ মৃত্যুর সংখ্যা কখনও এক অঙ্কে, কখনো এক শতাধিকে৷ কী কারণে এই আক্রমণ? মনস্তত্ত্বের কোন প্ররোচনা, অবচেতনের কোন রহস্য তাদের ঠেলে দেয় এমন পৈশাচিক হিংসার দিকে? নাকি, সবটাই ঠান্ডা মাথার অঙ্ক? যুদ্ধের চাল মাত্র?

মঙ্গলবার তালেবান ঘটনার দায় স্বীকার করে জানিয়েছে, এ তাদের প্রতিশোধ৷ যে ভাবে তাদের পরিবার-প্রিয়জন-সন্তানদের মেরেছে সেনা, এ তারই হিসেব চুকানোর পালা৷ যাতে রাষ্ট্র তাদের যন্ত্রণাটা বুঝতে পারে৷ কিন্তু সত্যিই কি এর পিছনে রয়েছে শুধুই এক সর্বনাশা জিঘাংসা? যা চোখের বদলে চোখ উপড়ে নেওয়াকেই একমাত্র ‘বিচার’ বলে মনে করে?

নিছক আবেগের বশে, প্রতিহিংসার বশেই কি এই মারণযজ্ঞ? দাঙ্গার মতো পরিস্থিতি তৈরি হলে যে পরিচিত সূত্র প্রভাবিত করে মব সাইকোলজিকেও? নাকি এ জিহাদ সুন্দরের বিরুদ্ধে, নিষ্পাপের বিরুদ্ধে, ইতিবাচক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে?

যে কাণ্ডজ্ঞানহীনতায় বামিয়ানে ইতিহাস ধ্বংস করেছিল তালেবানরা, সেই একই অহং-অন্ধত্বে এবার নিভিয়ে দিল ভবিষ্যতের প্রাণপ্রদীপ?সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলি যতটা সুনিয়ন্ত্রিত ও পরিকল্পিত ভাবে তাদের আক্রমণের ছক সাজাচ্ছে, যতটা নিখুঁত ও নির্ভুল তাদের প্রতিটি পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়ন, তাতে আবেগের তত্ত্ব বোধ হয় ততটা খাটে না৷ বরং এটা একটা নিষ্ঠুর খেলা৷ স্কুলগুলিকে নিশানা করাটা সেই খেলারই একটা মাস্টারস্ট্রোক৷ বেশির ভাগ মানুষের কাছেই সবচেয়ে বড় দুর্বলতার জায়গা তার সন্তান৷ নিজের শরীরের একটি অংশ দিয়ে এবং মন ও মননের সেরা নির্যাস দিয়ে যাকে সে গড়ে তোলে৷ যে তার সৃষ্টি আর তাই একদিকে তার স্বপ্ন ও বিশ্বাসের ভরকেন্দ্র, অন্যদিকে তার অহংবোধ ও সার্থকতালেপ্সার অন্তিম প্রতীক৷

আর স্কুল? সেখানেই তো একটু একটু করে মুকুল থেকে কিশলয় হয়ে ওঠে মা-বাবার প্রাণপুতলি৷ আর রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নাগরিকও৷ তার চেয়ে পবিত্র, তার চেয়ে নিরাপদ জায়গা আর কী থাকতে পারে? সমাজের এই মানসিকতাটাকেই ঠান্ডা মাথায় কাজে লাগায় জঙ্গিরা৷ আঘাত হানে সবচেয়ে নরম, সবচেয়ে নিরাপদ জায়গাতেই৷ ভেঙে দাও সেই পরম নির্মাণকে৷ গুঁড়িয়ে দাও তার পরিতৃপ্তির পৃথিবীটাকে৷ রাষ্ট্র এবং তার নাগরিকদের দিকে ছুড়ে দাও চরমতম বিদ্রূপ৷ জনমানসের একেবারে গভীরে শিকড় ছড়াক ত্রাসের দাসত্ব৷ আর বেআব্রু হয়ে যাক রাষ্ট্রের অসহায়তাও৷ এটাই সন্ত্রাসবাদীদের অঙ্ক৷

একই অস্ত্রে ঘায়েল করা দু’পক্ষকেই৷ তাদের সন্তানকে দুধে-ভাতে রাখা তো দূরস্থান, যে রাষ্ট্র তাদের প্রাণের নিরাপত্তাটুকু পর্যন্ত দিতে পারে না, তার প্রতি কী করে অটুট থাকবে নাগরিকদের ভরসা আর আনুগত্য? বিশেষ করে যখন তাদের বিশ্বাস আর প্রত্যয়ের ব্যক্তিগত দুনিয়াটাও চুরমার হয়ে যাচ্ছে? এ ভাবেই রাষ্ট্রে, সমাজে এবং ব্যক্তিগত পরিসরেও একটা প্রবল অভিঘাত তৈরি করতে চায় তারা৷ যা এতই শক্তিশালী, এতই অমোঘ, যার কোনো প্রত্যুত্তর হয় না৷

সেনা অভিযান হোক৷ সন্ত্রাসবাদীদের কব্জা করার ঘোষণা করুক রাষ্ট্র৷ কিন্ত্ত আজ থেকে তাহেরের মতো বাবারা, মেহেরের মতো মায়েরা আর কি নিশ্চিন্তে তাদের সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে পারবেন? আর শুধু পাকিস্তানেই নয়, সর্বত্রও৷ বিকেলে স্কুলবাস থেকে এক লাফে ব্যাগ পিঠে মেয়ে বা ছেলেকে নামতে দেখার আগে পর্যন্ত মনে মনে কাঁটা হয়ে থাকব আমরা সবাই৷ এই ভয়, এই অভিঘাত সীমানা জানে না (সংগৃহিত)

Logo-orginal