, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

Avatar n_carcellar1957

বান্দরবানে তীব্র পানির সংকট

প্রকাশ: ২০১৫-০৬-০৮ ০৪:৩৪:০৪ || আপডেট: ২০১৫-০৬-০৮ ০৪:৩৪:০৪

Spread the love

 বান্দরবান প্রতিনিধি,আরটিএমনিউজ২৪ডটকম

bandarban-photo-02,-date-04.05

বান্দরবান: নির্বিচারে পানির উৎস ধ্বংস এবং প্রচণ্ড গরমে গ্রীস্মের শুরুতেই তীব্র পানি সংকট দেখা দিয়েছে পার্বত্য জেলা বান্দরবানে।

এতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বান্দরবান শহরসহ পাহাড়ি গ্রামগুলোর জনজীবন। বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাবে জেলার দুর্গম আদিবাসী পল্লীগুলোতে বেড়ে চলেছে পানিবাহিত রোগের প্রকোপ।

জেলার দুর্গম থানছি, নাইক্ষ্যংছড়ি, রোয়াংছড়ি, রুমা উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এসব এলাকায় কয়েক ঘণ্টা হেঁটে ঝিরি-ঝর্ণা, ছরা, খাল থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

দিন দিন পানির উৎস নষ্ট হয়ে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানির সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। ফলে, বাধ্য হয়ে পুকুর, নদী ও খাল বিলের দূষিত পানি ব্যবহার করতে হচ্ছে এসব এলাকার বাসিন্দাদের।

চিম্বুক এলাকার অ্যাম্পু পাড়ার বাসিন্দা লুরা ম্রো আরটিএমনিউজ২৪ডটকমকে জানান, প্রায় ১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি ঝিরি থেকে প্রতিদিন খাবার পানি সংগ্রহ করেন তিনি। প্রচণ্ড গরমে মাথায় থ্রুং বেঁধে উঁচু নিচু রাস্তা পেরিয়ে পায়ে হেঁটে যেতে হয় প্রায় ১ কিলোমিটার দূরের ঝিরিতে। এলাকায় বিশুদ্ধ পানির কোনো উৎস না থাকায় এ কাজ নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিশুদ্ধ পানির অভাবে ডায়রিয়া, টায়ফয়েডসহ নানা পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে পাড়ার শিশুসহ শত শত মানুষ।

রুমা সড়কের গেৎসমানি পাড়ার বাসিন্দা ক্যথোয়াই ম্রো আরটিএমনিউজ২৪ডটকমকে জানান, পানীয় জল এবং নিত্য ব্যবহারের প্রয়োজনীয় পানির জন্য এ পাড়ার নিকটবর্তী একটি ঝিরির ওপর প্রায় হাজার খানেক মানুষ নির্ভরশীল। কিন্তু প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অবৈধভাবে এ ঝিরি থেকে লাখ লাখ ঘন ফুট পাথর উত্তোলন করে পাচার করে থাকে।

ফলে দিন দিন পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে এবং নষ্ট হচ্ছে পানির উৎস। দূষিত হয়ে পড়ছে ঝিরির পানি। ফলাফল হিসেবে স্থানীয়রা পানিবাহিত রোগসহ নানা দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে।

Bandarban-Water-300x213

বান্দরবান সদরের ডলুপাড়া, মুরুক্ষ্যংমুখ পাড়া, চিক্যা কারবারী পাড়া, গলাচিপা পাড়া, ওয়াব্রাইং পাড়া, জামছড়ি পাড়া এবং পার্শ্ববর্তী রোয়াংছড়ি উপজেলার দুর্গম ঘেরাওমুখ পাড়া, নোয়াপতং মৌজার আন্তাহা পাড়া, কানাইজো পাড়া, নাছালং পাড়াসহ আশপাশের এলাকাগুলোতেও চলছে পানির তীব্র সংকট।

রোয়াংছড়ি উপজেলার ঘেরাওমুখ পাড়ার কারবারি (পাড়া প্রধান) অংসাখয় মার্মা আরটিএমনিউজ২৪ডটকমকে জানান, পাড়ার লোকজন পাশের কয়েকটি ঝিরি থেকে সারাবছর বিশুদ্ধ পানীয় জলসহ ব্যবহারের পানি সংগ্রহ করতেন। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে গ্রীষ্মের শুরুতেই ঝিরি-ঝর্ণার পানি শুকিয়ে যায়।

তাছাড়া পাহাড়ি দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে বিশুদ্ধ খাবার পানি সংগ্রহ করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। পানির চাহিদা মেটাতে এখানকার লোকজনের কষ্টের যেন অন্ত নেই। শিগগিরই এ পাড়ার ঝিরি-ঝর্ণাসহ পানির উৎসগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা না গেলে লোকজনের বসবাস অযোগ্য হয়ে পড়বে পাড়াগুলো। এজন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।

বান্দরবান মৃত্তিকা ও পানি সংরক্ষণ কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মাহবুবুল ইসলাম আরটিএমনিউজ২৪ডটকমকে জানান, পাহাড়ে অপরিকল্পিত জুম চাষ, নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন, বন-জঙ্গল উড়াজ ও ঝিরি-ঝর্ণা থেকে অবাধে পাথর উত্তোলনের ফলে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। রুক্ষ হয়ে যাচ্ছে পাহাড়।

এতে ঝিরি-ঝর্ণা, ছরা, নদী, খাল-বিলের পার্শ্ববর্তী স্থানে গাছপালা কমে গিয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে পানির উৎস। শিগগিরই এসব বন্ধ করা না গেলে চরম পানি সংকট দেখা দিতে পারে পাহাড়ি এলাকাগুলোতে।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের সূত্রমতে, ২০০৩ সালে জেলায় জনসংখ্যা ছিল ২৩ লাখ ৭৬ হাজার ৮০ জন ও পানির কভারেজ ছিল ৬৩.২৬%। কিন্তু ২০১৩-১৪ সালে জনসংখ্যা বেড়ে ৪ লাখ ৪ হাজার ৯৩ জন হওয়াতে পানির কভারেজ ৫০.৬৭% এ নেমে আসে।

এ বিভাগের আওতাধীন বিশেষ গ্রামীণ পানি সরবরাহ, পিইডিপি-৩ প্রকল্প, বান্দরবান পার্বত্য এলাকার নিরাপদ পানীয় জলের সমস্যা নিরসণ কর্মসূচি, বান্দরবান এবং লামা পৌরসভার পানি সরবরাহ ব্যবস্থা সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন কর্মসূচি, বান্দরবান জেলা ও সব উপজেলা হেডকোয়ার্টারে পানি সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়নকরণ, বন্যা দুর্গত এলাকায় পানি সরবরাহ ব্যবস্থা পুনর্বাসন ও উন্নয়ন ইত্যাদি চলমান প্রকল্পের মাধ্যমে পানি সংকট নিরসনের চেষ্টা চলছে।

Bandarban-Pic-300x171

এছাড়া বান্দরবান পার্বত্য জেলার প্রত্যন্ত পশ্চাদপদ দুর্গম পাহাড়ি এলাকার জনগোষ্ঠির জন্য নিরাপদ পানি সরবরাহকরণ কর্মসূচিসহ নতুন কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে জেলার পানি সংকট বহুলাংশে লাঘব হবে বলে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল সূত্র জানায়।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, বান্দরবান বিভাগের সহকারী প্রকৌশলী আবদুল বাতেন আরটিএমনিউজ২৪ডটকমকে জানান, জেলার ৭টি উপজেলায় মোট নলকূপের সংখ্যা ৮৬৬৯টি। তার মধ্যে চালু অবস্থায় রয়েছে ৬৯৫৯টি এবং অকেজো অবস্থায় রয়েছে ১৭১০টি।

এছাড়া অগভীর নলকূপ রয়েছে ১০৫৫টি, ডিএসপি নলকূপ রয়েছে ১৫০৩টি, তারা ডিপসেট রয়েছে ১৪১২টি, পাতকুয়া রয়েছে ৩৭১২টি, ইনফিলট্রেশন গ্যালারি রয়েছে ১৪টি, রেইন ওয়াটার রিজার্ভার ৩৯টি, ছরা উন্নয়ন ৮৬টি এবং পুকুর খনন ও পিএসএফ নির্মাণ করা হয়েছে ৬টি।

এগুলোর বেশির ভাগ নলকূপ, পাতকুয়া, তারা ডিপসেট দ্বারা পানির চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে। তবে, কিছু কিছু নলকূপ, রিংওয়েল, টিউবওয়েল অকেজো অবস্থায় রয়েছে। এগুলোও পর্যায়ক্রমে মেরামত করা হবে এবং পানির চাহিদা পূরণের সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে বলে জানান তিনি।

এ ব্যাপারে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, বান্দরবান বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সোহরাব হোসেন আরটিএমনিউজ২৪ডটকমকে জানান, জেলার স্বল্পসংখ্যক সমতল এলাকায় অগভীর ও গভীর নলকূপ দ্বারা পানি উত্তোলন সম্ভব হলেও অধিকাংশ এলাকায় ভৌগোলিক কারণে পানি উত্তোলন সম্ভব হচ্ছে না। ভূ-প্রকৃতগতভাবে পার্বত্য এলাকায় পানির স্তর দিন দিন নিচে নেমে যাচ্ছে।

এছাড়া বন জঙ্গল উজাড় ও জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে পানির উৎস শুকিয়ে যাচ্ছে। তাই চেষ্টা থাকা সত্ত্বেও শতভাগ বিশুদ্ধ খাবার পানির সংস্থান করা যাচ্ছে না। পানির উৎস সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। আশা করছি শিগগিরই এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব হবে।

এছাড়া বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য টিউবওয়েল, রিংওয়েল ও জিএফএস নির্মাণ কার্যক্রম চলছে। প্রত্যন্ত এলাকার বাসিন্দারা বিশুদ্ধ পানি সরবরাহে গৃহীত প্রকল্পগুলোর সুবিধাও ভোগ করছেন বলে জানান তিনি।

Logo-orginal