, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪

Avatar n_carcellar1957

আলো ছড়াচ্ছেন লুৎফর রহমান

প্রকাশ: ২০১৫-০৭-২৬ ২০:০৮:০৩ || আপডেট: ২০১৫-০৭-২৬ ২০:১৩:৪৬

Spread the love

alo

আরটিএমনিউজ২৪ডটকম, গাইবান্ধা : ৪০ বছরে গাইবান্ধা সদরের বাগুড়িয়া, মদনের পাড়া, পুলবন্দী, চন্দিয়া, ঢুলিপাড়া, কঞ্চিপাড়া ও পূর্বপাড়ার শত শত ছেলে-মেয়েকে শিক্ষার আলো ছড়িয়েছেন তিনি। তাঁর কাছে লেখাপড়া শিখে শিক্ষক, পুলিশ ও ডাক্তারও হয়েছেন অনেকে।

 

 

 

গরিব ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের শিশু শিক্ষার্থীর মাঝে এভাবেই শিক্ষার আলো ছড়ানোই যেন তাঁর অদম্য লক্ষ্য। সুদীর্ঘ দিন ফেরিওয়ালার মতো এলাকাতে ঘুরে ঘুরে করে শিশু শিক্ষার্থীর মধ্যে শিক্ষা বিস্তারে নিরলসভাবে তাঁর এ কাজ করে যাওয়া।

 

 

 

অবাক করার বিষয়, একজন শিশু-শিক্ষার্থীর কাছ থেকে দিনে মাত্র এক টাকা গ্রহণ করে নিষ্ঠার সাথে লেখাপড়া শিখিয়ে যাচ্ছেন তিনি। যার কথা জানাচ্ছিলাম, তিনি গাইবান্ধা সদর উপজেলার লুৎফর রহমান (৬৫)। গাইবান্ধা সদরের বাগুড়িয়া ও নিকটবর্তী গ্রামগুলোতে যার নাম ‘এক টাকার মাস্টার’!

 

 

 

 

 

‘এক টাকার মাস্টার’ অর্থাৎ লুৎফর রহমান প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গ্রামে গ্রামে ঘুরে ৩০ থেকে ৩৫ জন শিশু শিক্ষার্থীকে লেখাপড়া শিখিয়ে থাকেন। মাস্টার লুৎফর রহমানের বাড়ি গাইবান্ধা সদরের গিদারী ইউনিয়নের বাগুড়িয়ায়। গাইবান্ধা শহর থেকে অন্তত ৭ কিলোমিটার দূরে বাগুড়িয়া গ্রামটির অবস্থান। ১৯৭৪ সালে নদী ভাঙ্গনে সব হারিয়ে বাগুড়িয়ার যমুনা নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের পাশে আশ্রয় নেন লুৎফর রহমান।

 

 

স্ত্রী লতিফুল বেগম, মেয়ে লিম্মি, লিপি এবং ছেলে লাভলু ও লিটনকে নিয়ে লুৎফর রহমানের সংসার। বেশ কষ্টেই দুই মেয়েকে মানুষ করেছেন, বিয়ে দিয়েছেন। বড় ছেলে লাভলু এসএসসি পাস করার পর অর্থাভাবে আর লেখাপড়া করতে পারেনি। জীবিকার টানে লাভলু এখন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। ছোট ছেলে বাড়ির পাশের একটি মাদ্রাসায় লেখাপড়া করছে।

 

 

 

লুৎফর রহমানের খোঁজে সরেজমিনে গেলে স্থানীয় আব্দুল কাদের, মফিজল হক ও আয়নাল হকের সাথে কথা হয়। তারা জানালেন, তিন যুগেরও বেশি দিন ধরে লুৎফর রহমান গ্রামের গরিব ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের লেখাপড়া শেখাচ্ছেন। লুৎফর রহমান প্রতিদিন ফজরের নামাজের পড় তার বাড়ি থেকে বের হন। এরপর সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পায়ে হেঁটে বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে ঘুরে শিশুদের লেখাপড়া শেখান। কখনো রাস্তার ধারে, কখনো বাঁধে, আবার কখনো গাছতলায় বসেই শিশুদের লেখাপড়া শেখান।

 

 

 

 

একই গ্রামের সাদেক আলী, মজিবর রহমান জানালেন, লুৎফর রহমান নদী ভাঙ্গনে সর্বস্ব হারিয়ে বাগুড়িয়া গ্রামে এক সময় আশ্রয় নিয়েছিলেন। প্রতিদিন তিনি কয়েক গ্রামে ঘুরে শিশুদের পড়ান। সকাল ও দুপুরে শিক্ষার্থীদের ভালবেসে দেওয়া মুড়ি, চিড়াসহ খেয়ে তাঁর দিন কাটে। শিক্ষার্থীদের পড়া শিখিয়ে জনপ্রতি মাত্র এক টাকা গ্রহণ করেন। তবে কেউ তা দিতে অসমর্থ্য হলে তিনি কখনো জোর করেন না। সারাদিন প্রায় পঁয়ত্রিশ জন শিক্ষার্থীকে লেখাপড়া শিখিয়ে পান সমপরিমাণ টাকা। এতেই তিনি অনেক খুশি।

 

 

লুৎফর রহমানের কাছে লেখাপড়া শিখিয়েছেন বাগুড়িয়া গ্রামের জাহেদুল ইসলাম (৪৫)। তিনি লুৎফর রহমান সম্পর্কে বলেন, ‍”ছোটবেলা থেকেই তিনি দেখছেন লুৎফর রহমান স্যার এভাবেই ছেলেমেয়েদের পড়ান। আমিও তাঁর কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেছি। লুৎফর স্যার এমন শিক্ষা বিস্তারের বিষয়ে এলাকার অনেকেই তাঁকে এক সময় ‌‌‌‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍’পাগল’ বলেও কটূক্তি করেছেন। কিন্তু তারপরও দমে যাননি তিনি।”

 

 

 

চন্দিয়া গ্রামে গাছের নিচে বসে এক দল শিশুকে পড়াচ্ছিলেন লুৎফর রহমান। এ সময় কথা হয় তার সঙ্গে তিনি বললেন, ‘আমি খুব সামান্য মানুষ। যতটুকু জানি তাই শেখাই। লেখাপড়া না শিখলে কী কষ্ট আমি বুঝি। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শিশুদের পড়িয়ে ৩০-৩৫ টাকা পাই। ওই টাকা নিজের সংসারে দেই। বড় ছেলে লাভলুর আয়েই কোনোমতে চলে সংসার।’

 

 

গ্রামের শিশু শিক্ষার্থী সালমা খাতুন, মিলন মিয়া ও লাবণী লুৎফর রহমান স্যার সম্পর্কে জানাল, লুৎফর রহমান স্যার অনেক ভাল মানুষ। তিনি তাদের আনন্দের মধ্যে দিয়ে ভালভাবে লেখাপড়া শেখান।

 

 

 

বাগুড়িয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থী সুমন, কামাল ও রাশেদ জানাল, লুৎফর স্যার একজন অত্যন্ত ভাল মানুষ। তিনি তাদের ভালভাবে বুঝিয়ে পড়াশুনা করান।

 

 

শিক্ষক লুৎফর রহমান জানালেন, গাইবান্ধার ফুলছড়ির উড়িয়া গ্রামে ১৯৫০ সালের ৭ আগস্ট তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ফইমুদ্দীন ব্যাপারী ইন্তেকাল করেছেন অনেক বছর হল। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। ১৯৭২ সালে ফুলছড়ির গুণভরি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। ৭০-৮০ বিঘা জমি, পুকুর ভরা মাছ, গোয়াল ভরা গরু সবই ছিল তাদের সংসারে। কিন্তু ১৯৭৪ সালে নদী ভাঙ্গনে সব হারিয়ে সদরের গিদারী ইউনিয়নের বাগুড়িয়ার ওয়াপদা বাঁধে আশ্রয় নিয়ে বসবাস করে আসছেন।

 

 

 

তিনি বললেন, ‘১৯৭২ সালে এসএসসি পাস করার পর টাকার অভাবে কলেজে ভর্তি হতে পারিনি। লেখাপড়া না করার অভাব আমি বুঝি। তাই নিজের ইচ্ছে দিয়ে নিঃস্বার্থভাবে নতুন প্রজন্মের গরিব, অসহায় শিশু শিক্ষার্থীদের মধ্যে আলো ছড়িয়ে নিজের না পাওয়ার বেদনা ভুলতে চাই। ইনশাআল্লাহ্, মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত আমি এভাবেই শিশু-শিক্ষার্থীর মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে পৃথিবী ছাড়তে চান। তবে বয়সের কারণে এখন হাঁটতে কষ্ট হয়।’

 

 

 

গিদারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম সাদেক লেবু লুৎফর রহমান সম্পর্কে বললেন, ‘জীবনের শেষ বষয়ে এসেও মাইলের পর মাইল পাঁয়ে হেঁটে গ্রামে গ্রামে ঘুরে তিনি শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছেন। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে শিশুদের আলোর পথ দেখাচ্ছেন লুৎফর রহমান। বয়সের ভারে নুয়ে পড়লেও তার মনোবল কমেনি। শিক্ষার আলো ছড়ানোর লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন সমানতালে। আলোকিত এই মানুষটির উদ্যোগকে আরও এগিয়ে নিতে সাহায্যের হাত নিয়ে তাঁর পাশে দাঁড়ানো দরকার।’

 

 

 

শিক্ষক মাজহার উল মান্নান তাঁর সম্পর্কে বলেন, ‘লুৎফর রহমান মূলত একজন বিদ্যার ফেরিওয়ালা। লুৎফর রহমান তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে নীরবে নিভৃতে অবহেলিত-দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারে অসামান্য অবদান রেখে চলেছেন। লুৎফর রহমানের মতো আর কোনো মানুষ নিঃস্বার্থভাবে এমন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন বলে তার জানা নেই।’

 

 

লুৎফর রহমানের বিষয়ে গাইবান্ধা সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আশরাফুল মমিন খান বলেন, ‘লুৎফর রহমান একজন সাদা মনের আলোকিত মানুষ। এই মানুষটিকে যথাসাধ্য সহযোগিতা প্রয়োজন।’

আরটিএমনিউজ২৪ডটকম/এন এ কে

Logo-orginal