, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

Avatar n_carcellar1957

আপনার কি মা-বোন নেই?

প্রকাশ: ২০১৫-১০-০৪ ১৫:৩১:১১ || আপডেট: ২০১৫-১০-০৪ ১৫:৫৪:১৩

Spread the love

আরটিএমনিউজ২৪ডটকম: প্রায়ই রাস্তাঘাটে, বাসে, ট্রেনে ছেলেরা যখন মেয়েদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করে, তখন মেয়েদের পক্ষ নিতে কিছু লোক জড়ো হয়। সাধারণত এরা ছেলেদের গালাগাল করে এবং সদুপদেশ বিতরণ করে। ছেলেদের তিরস্কার করতে গিয়ে এরা বলে ‘আপনার কি মা-বোন নেই?’ পুরুষেরা নারীকে অত্যাচার করছে, এতে মা-বোনের সম্পর্ক উল্লেখ করা জরুরি কেন তা আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। কেবল রাস্তাঘাটের উপদেষ্টা পুরুষ নয়, এমন কথা আমাদের বুদ্ধিজীবীরাও বলেন যে নারীকে মাতৃরূপে, কন্যারূপে এবং ভগ্নীরূপে দেখতে হবে। আমার প্রশ্ন, নারীকে এসব রূপে দেখতে হবে কেন? এগুলো এক ধরনের সম্পর্ক। নারীকে সম্মান করতে হলে কোনও এক সামাজিক সম্পর্কের সীমানার মধ্যে এসে সম্মান করতে হবে কেন? যে-পুরুষের মা বোন নেই, সে-পুরুষের কাছে তবে কি নারীরা সম্মান পাবার অধিকার রাখে না? নারীকে কেন পুরুষের মা, বোন এবং কন্যারূপে বিরাজ করে নিজের সুবিধা আদায় করতে হবে? এ কি কোনও বাড়তি সুবিধা?
নারী আপাদমস্তক মানুষ, মানুষের মর্যাদা পাওয়ার অধিকার নিশ্চয়ই সে রাখে। কিন্তু বলা হচ্ছে নারীকে অমর্যাদা করা পুরুষের উচিত নয় কারণ পুরুষের মা এবং বোন সম্পর্কটি নারীরা বহন করে, তাই কোনও নারী ওই সম্পর্ক বহন না করলে অন্তত পুরুষের এইটুকু বোধ থাকা দরকার যে, তার আত্মীয়দের মতোই দেখতে কাউকে নির্যাতন করা বা অসম্মান করা ঠিক নয়, যদি কিছু করতেই হয় তাকে করুণা করতে হবে। মা ও বোনকে সাধারণত করুণাই করে পুরুষেরা। এই করুণা যেন পুরুষেরা যেকোনও নারীকেই করে- এই হল মূল উপদেশ। এক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই একটি প্রশ্ন উঠতে পারে, কোনও পুরুষের যদি মা এবং বোন না থাকে, তবে কি সে নারীকে অপমান করবার অধিকার রাখে? ‘আপনার কি মা-বোন নেই?’ এর উত্তরে কোনও পুরুষ যদি বলে বসে- ‘না নেই,’তবে? তার অপরাধ কি তখন ক্ষমার যোগ্য?
পুরুষের মা-বোন-কন্যারূপে পরিচিত হয়ে সম্মান পাওয়া নারীর জন্য অপমানকর। কোনও সম্পর্করূপে নয়, নিজের পরিচয়ই এখন আসল পরিচয় হওয়া উচিত নারীর জন্য। সম্পর্কের দোহাই দিয়ে নারীকে সম্মান পেতে হলে সেই সম্মান নারীকে সত্যিকার সম্মানিত করে না।
‘মেয়েরা তো মায়ের জাত’ এ-রকম একটি কথাও প্রচলিত বেশ। মেয়েদের সম্মান করতে হবে কারণ তারা মা। এখানে ঠিক সম্মান করবার কথাও বোঝানো হয় না, ‘যেহেতু কষ্ট করে প্রসব করে তাই তাদের লাথিঝাঁটা দিয়ো না, বেচারাকে মারধর না করলেও তো পারো’—ব্যাপারটি এ-রকম। এখানে মা বলে যে গৌরব করা হয়েছে, তা অনুমান করি কোনও কন্যার মায়ের গৌরব নয়, বেটাছেলের জন্মের কথা ভাবা হয়েছে। বেটাছেলেদের জন্ম দিয়ে মেয়েরা মহৎ কাজ করে, তাই মেয়েদের একেবারে ছুড়ে না ফেললেও তো চলে! মেয়েদের মায়ের জাত বলবার পেছনে যে উদ্দেশ্যটি কাজ করে তা এ-রকমই।
নারী মানুষের মর্যাদা পাবে, সে তাঁর নিজের অধিকারেই। পুরুষের মা-বোনের সম্পর্কের কারণে নয়। সেই সম্পর্কের ক্যামোফ্লেজেও নয়। যাঁরা বলেন নারীকে মা এবং বোনরূপে দেখতে, আমি তাঁদের জিজ্ঞাসা করি, সম্পর্কের করুণা কেন নারীকে করতে হবে? সে কি কারও মা এবং বোন না হয়েও কেবল মানুষ হয়ে মানুষের পরিচয়ে সম্মান পাবার যোগ্যতা রাখে না? আমরা সবাই জানি নারীর এই যোগ্যতা বা অধিকার আছে। যারা তার এই অধিকার খর্ব করতে চায় তারা কেবল লেখাপড়া না-জানা মানুষই নয়, লেখাপড়া জানা মানুষও। প্রতিক্রিয়াশীলদের চেয়ে ভণ্ড প্রগতিশীলদের ব্যাপারে নারীকে সচেতন থাকতে হবে বেশি। মুর্খ পুরুষের চেয়ে ধূর্ত পুরুষ থেকে সাবধান থাকতে হবে। কারণ এরা ধীরে ধীরে নারীকে বিভিন্ন মা-খালা-বোনের খোলসে আবৃত করে ফেলে, এইসব সামাজিক সম্পর্কের বাইরে তার পরিচয় স্বীকার করে না। নারী যেন জন্মজন্মান্তরের মেধাহীন-বুদ্ধিহীন! গোটাকয় সম্পর্কের ফাঁদে ফেলে নারীকে আটার গোলা বানানো হয়। রুটি-পুরি-লুচির মতো সময়-সুবিধামতো নারীকে মা-বোন-খালা ইত্যাদি গড়ে নেওয়া যায়,এতে নারী নামের আটার গোলা নানা আকার হয়ে কেবল সামাজিক তাওয়ায় পোড়ে।

তসলিমা নাসরিন |কলামিস্ট

Logo-orginal