, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

Avatar Ziaul Hoque

প্রশ্ন যদি হবেই ফাঁস, পড়বো কেন ১২ মাস?

প্রকাশ: ২০১৫-১০-০৮ ১২:০১:২৭ || আপডেট: ২০১৫-১০-০৮ ১২:৪৫:২৭

Spread the love

Probhash Potrait

আরটিএমনিউজ২৪ডটকম: ‘প্রশ্ন যদি হবেই ফাঁস, পড়বো কেন ১২ মাস?’ মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা বাতিল করে আবার পরীক্ষা নেওয়ার দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের একটি ফেস্টুনের স্লোগান এটি। এই প্রশ্নের কোনও উত্তর কি সরকারের কারও কাছে আছে? আমার ধারণা নেই। আর নেই বলেই পুলিশ বলপ্রয়োগে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছে।

আর ইদানিং দেখা যাচ্ছে, কোনও সঙ্কট মোকাবেলায় সরকারের সবচেয়ে সহজ উপায় হলো অস্বীকার করা। সরকার তাই করে যাচ্ছে। কিন্তু অস্বীকার করলেই কি আর সত্য মিথ্যা হয়ে যাবে? উটপাখির মতো বালুতে মুখ গুজে রাখলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে?

গত ১৮ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছিল কিনা, তার নিশ্চিত কোনও প্রমাণ আমার কাছে নেই। কিন্তু গত কয়েকবছর ধরে যে প্রবণতা, তাতে সাধারণের শক্ত ধারণা যে- প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে।

আর আমরা জানি, ধারণা কখনও-কখনও সত্যের চেয়েও শক্তিশালী। আর মেডিক্যালে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের শক্ত ধারণা প্রতিষ্ঠার পেছনে কিছু প্রমাণও আছে। ধারণাটা এমন, ভর্তি পরীক্ষার আগের দিন রাতে কেউ-কেউ প্রশ্নপত্র পেয়েছেন। আর এ জন্য তাদের ব্যয় করতে হয়েছে ১৫ লাখ টাকা। এই টাকা দেওয়া হয়েছে চেকের মাধ্যমে।

প্রশ্ন মেলার পরই সেই চেক ক্যাশ করা গেছে। যারা ১৫ লাখ টাকা দিয়ে প্রশ্নপত্র কিনেছেন, তারা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে চান্স পেয়েছেন। ঢাকা মেডিক্যালে চান্স পাওয়া মানে সব মিলিয়ে ৫০ লাখ টাকার সুবিধা। তাই ১৫ লাখ টাকা দিয়ে ৫০ লাখ টাকার সুবিধা কেনার সুযোগটা অনেকেই নিয়েছেন। এই ধারণার পক্ষে সবচেয়ে শক্ত প্রমাণ হলো র‌্যাবের সংবাদ সম্মেলন।

মেডিক্যালে ভর্তি পরীক্ষা চলার সময়ই র‌্যাব বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সহকারী পরিচালক ওমর সিরাজসহ বেশ কয়েকজনকে আটক করে। তাদের কাছ থেকে কোটি টাকার ওপরে চেক উদ্ধার করে। তখন র‌্যাব জানিয়েছিল, এই চক্রটি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় পাস করিয়ে দিতে ১৫ লাখ টাকা, জুডিশিয়াল সার্ভিসে নিয়োগ দিতে ১০ লাখ টাকা এবং কৃষি ব্যাংকের কর্মকর্তা পদে নিয়োগ দেওয়ার জন্য ছয় লাখ টাকা করে নিত।

এমন শক্ত প্রমাণ থাকার পর সরকার ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ স্থগিত রেখে বিষয়টি ভালো করে তদন্ত করতে পারতো। কিন্তু তা না করে উল্টো, দ্রুতগতিতে ২০ সেপ্টেম্বর পরীক্ষার ফল প্রকাশ করে দেয়। আমার ধারণা, এই তাড়াহুড়ো করতে গিয়েই সরকার পরিস্থিতিকে জটিল থেকে জটিলতর করে তুলেছে। এই প্রসঙ্গে আমার নিজের একটা অভিজ্ঞতা মনে পড়ে গেল, বছর বারো আগে আমি সাতরাস্তায় বিআরটিসির ট্রেনিং ইন্সটিটিউটে গাড়ি চালানো শিখি। শিখতে গিয়ে প্রথমে আমি ভাঙা রাস্তা দেখলে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দ্রুত সেই রাস্তাটুকু পেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতাম। একাধিকবার এ ঘটনার পর আমার প্রশিক্ষক আমাকে বললেন, রাস্তা খারাপ হলে গাড়ির গতি কমিয়ে দেখেশুনে সেই জায়গাটুকু পেরুতে হবে। সেই ঘটনা থেকে আমি একটা বড় একটা শিক্ষা নিয়েছি। হয়তো জীবনের বেশির ভাগটাই আপনি ভালো মসৃন রাস্তায় একই গতিতে চলবেন। কিন্তু যখন বাধা আসবে, বিপদ আসবে, ঝামেলা আসবে; আপনাকে অবশ্যই জীবনের গতি কমিয়ে দিতে হবে। ঠাণ্ডা মাথায় ভেবেচিন্তে বিপদটুকু পেরুতে হবে। নইলে আপনি খাদে পড়তে পারেন, বড় ঝাকুনি খেতে পারেন; তাতে বিপদ আরও বাড়বেই শুধু। সরকারও তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে আরও বড় বিপদ ডেকে এনেছে। বিপদটা এখন এমনই জটিল আকার ধারণ করেছে যে এর সমাধান খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বন্দুক থেকে গুলি বেরিয়ে গেলে আর ফিরিয়ে আনা যায় না।

গাইবান্ধা-১ আসনের সাংসদ মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন যেমন এখন গুলি করে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। ফলাফল প্রকাশ করে ফেলার পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও এখন তেমনি নিজেদের কাছেই পালিয়ে বেড়াচ্ছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বারবার বলছেন, প্রশ্ন ফাঁস হয়নি। কিন্তু স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজে কি সেটা বিশ্বাস করেন? পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে, র‌্যাব হেফাজতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সহকারী পরিচালক ওমর সিরাজের ‘হৃদরোগে আক্রান্ত’ হয়ে মৃত্যুর ঘটনায়। র‌্যাবের ভাষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের মূল হোতা ওমর সিরাজের এমন মৃত্যু রহস্যজনক। ওমর সিরাজের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে সরকার প্রশ্নপত্র ফাঁসের মূল চক্রটি চিহ্নিত করতে পারতো। কিন্তু তার মৃত্যু সে সম্ভাবনারও মৃত্যু ঘটিয়েছে। ওমর সিরাজের মৃত্যুও দ্রুতগতিতে বিপদ পেরিয়ে যাওয়ার আরেকটি অপচেষ্টা।

মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা বাতিল করে নতুন করে পরীক্ষা নেওয়ার দাবিতে যে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছেন, প্রতিদিন পুলিশের মার খাচ্ছেন, তাদের দেখে গভীর বেদনায় আমার হৃদয় ভেঙেচুরে যাচ্ছে। এভাবে আমাদের শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন রাজপথে খানখান হয়ে যাবে, মার খাবে এটা মেনে নেওয়া যায় না। তারা তো রাষ্ট্রের কাছে টাকা-পয়সা-ক্ষমতা কিছুই চায়নি। তারা চেয়েছে মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সুযোগ।

অনেক অভিভাবক আছেন, ছেলেবেলা থেকেই সন্তানের হৃদয়ে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন ঢুকিয়ে দেন। ১২ বছর সেই স্বপ্নের পেছনে ছুটে তারা যখন এভাবে হোচট খায়, তখন তারা কষ্ট পাবে, প্রতিবাদ করবে, বিক্ষোভ করবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী যতই অস্বীকার করুন, অল্প কিছু হলেও প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে, এটা এখন বাস্তবতা। একজনও যদি ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে টিকে থাকেন, তাহলেও তো তাদের আন্দোলন নৈতিকভাবে যৌক্তিক। কিন্তু সরকার যুক্তিতে না পেরে গায়ের জোরে তার সমাধান করার চেষ্টা করছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলছেন, এ আন্দোলনের পেছনে কারও উসকানি আছে। থাকতেই পারে। যে কোনও বিবেকবান মানুষ, নিরীহ শিক্ষার্থীদের এমন একটি যৌক্তিক আন্দোলনে তাদের পাশে থাকতে পারে। এর আগে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করে তাদের টিউশন ফি’র ওপর আরোপিত ভ্যাট প্রত্যাহার করাতে পেরেছে। কিন্তু সে আন্দোলন আর এ আন্দোলন এক নয়। সরকার যত সহজে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিতে পেরেছে, এদের দাবি মেনে নেওয়া তত সহজ নয়। বরং এদের দাবি মেনে নেওয়াটা নতুন বিপদ ডেকে আনবে।

তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম সরকার শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিলো। আবার নতুন করে মেডিক্যালে ভর্তি পরীক্ষা হলো। কিন্তু সে পরীক্ষায় যদি আগের পরীক্ষায় টিকে যাওয়া একজনও বাদ পড়েন, তাহলে কী হবে? সেই শিক্ষার্থীর দোষ কী? তখন তো আবার নতুন আন্দোলন শুরু হবে। সরকার জটিল এক গিট্টু লাগিয়েছে। এখানে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের কোনও দায় নেই। এই গিট্টু সরকারই লাগিয়েছে। তাদেরকেই গিট্টু খোলার উপায় বের করতে হবে। পিটিয়ে শিক্ষার্থীদের মনের বেদনা-ক্ষোভ প্রশমন করা যাবে না। অন্যায় মানে অন্যায়। আপনি অস্বীকার করলেই তা ন্যায় হয়ে যাবে না।

গত কয়েকবছরে প্রাথমিক সমাপনী থেকে শুরু করে মেডিক্যাল ভর্তি- দেশের প্রায় সব পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। বারবার বলা হলেও সরকার এই সমস্যা মোকাবেলায় অস্বীকারের চেয়ে কার্যকর কোনও উপায় বের করতে পারেনি। আমি ধরে নিচ্ছি, প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকানোর সাধ্য নেই সরকারের। সে ক্ষেত্রে আমার পরামর্শ, পরীক্ষার আগের দিন সব জাতীয় দৈনিকে প্রশ্ন ছাপিয়ে দেওয়া হোক। তাতে সবাই একই প্রশ্নে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পাবে। নইলে কেউ ১২ মাস পড়ে পরীক্ষা দেবে, আর কেউ ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দেবে, এটা হতে পারে না। অভিন্ন প্রশ্নে পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ পাওয়ার অধিকার সবার আছে।

 প্রভাষ আমিন| অ্যাসোসিয়েট হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ।

 

আরটিএমনিউজ২৪ডটকম/জেড এইচ

Logo-orginal