, মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪

Avatar Ziaul Hoque

লিবিয়া প্রবাসীদের দেড় কোটি টাকা নিয়ে প্রতারক উধাও

প্রকাশ: ২০১৫-১০-১৫ ১১:১০:১৩ || আপডেট: ২০১৫-১০-১৫ ১১:১১:৩১

Spread the love

96861_f3

আরটিএমনিউজ২৪ডটকমঃ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অচলাবস্থার কারণে দীর্ঘদিন দেশে টাকা পাঠাতে পারছেন না লিবিয়ায় কর্মরত বাংলাদেশীরা। ফলে অনেকটা অসহায় হয়েই দালালের শরণাপন্ন হচ্ছেন তারা। আর এই সুযোগ নিয়ে শতাধিক বাংলাদেশীর কাছ থেকে প্রায় দেড় কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বরিশালের ওমর খান ও ফুয়াদ খান সহোদর।

স্থানীয় এক ব্যাংক ম্যানেজারের সঙ্গে সুসম্পর্কের কথা বলে দেশে স্বজনদের কাছে টাকা পাঠিয়ে দেয়ার নাম করে বাংলাদেশী প্রবাসীদের কাছ থেকে ওই টাকা সংগ্রহ করেন তারা। পরে গোপনে লিবিয়া ত্যাগ করে দেশে পাড়ি জমায় দুই ভাইা।

দেশে এসে কারও টাকা ফেরত না দিয়ে উল্টো যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছেন তারা। এমনকি ভুক্তভুগীদের হুমকি দিচ্ছেন বলেও অভিযোগ ওঠেছে। লিবিয়ায় কর্মরত বেশ কয়েকজন প্রতারিত ব্যক্তি এসব কথা জানিয়েছেন। তারা জানান, ওমর ও ফুয়াদের বাড়ি বরিশালের উজিরপুর উপজেলার সাতলা ইউনিয়নের আলামদি গ্রামে। তাদের পিতার নাম শাজাহান খান। তারা লিবিয়ার জাওয়াইয়া শহরে মাংস ব্যবসা করতেন। দীর্ঘদিন ওই এলাকায় এ ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত থাকায় স্থানীয় অনেকের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাদের। আর এই সুযোগ নিয়ে বাড়িতে টাকা পাঠিয়ে দেয়ার নাম করে তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। ভুক্তভোগীরা কেউ কেউ জানান, দেশটিতে আসার পর থেকে যা রোজগার করেছিলেন তার সবই নিয়ে গেছে ওই প্রতারকেরা। তাদের কেউ কেউ এখন নিঃস্ব প্রায়।
ভুক্তভোগীরা জানান, ওমর খান ও তার ভাই ফুয়াদ প্রায় ২ বছর ধরে জাওয়াইয়া শহরের মাংশ পট্টিতে একটি দোকান ভাড়া নিয়ে মাংসের ব্যবসা করে আসছিল। এর সুবাদে স্থানীয় অনেক দোকানের কর্মচারী সঙ্গে তাদের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। লিবিয়াতে কর্মরত শ্রমিকরা প্রায় ২ বছর দেশে টাকা পাঠাতে না পেরে হুন্ডি ব্যবসায়ীসহ বিভিন্নভাবে চেষ্টা করতে থাকে। ইতিপূর্বে ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ের মাধ্যমে ১২শ’ ৮০ থেকে ১৩শ’ দিনারে ১ হাজার ডলার পাঠানো গেলেও এখন তা বন্ধ রয়েছে।

এরই মধ্যে ওই দুই মাংস ব্যবসায়ী ওমর ও তার ভাই ফুয়াদ লিবিয়ার এক ব্যাংক কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে প্রবাসী বাংলাদেশীদের টাকা পাঠাতে শুরু করে। দীর্ঘদিন দেশে টাকা পাঠাতে না পারা বাংলাদেশীরা ওমরের কাছে ধরনা দেয়। দেশটির জাওয়াইয়া শহরের একটি হাসপাতালে মেইনটেন্যান্স বিভাগে কর্মরত অর্পণ মাহমুদ জানান, এ সুযোগে কয়েক দফায় ১০০০ ডলার হিসেবে সাড়ে ১৭শ’ দিনার নিয়ে বেশ কয়েকজন প্রবাসীর অর্থ দেশে পাঠায়। ১০ দিন পরে দেশে টাকা যাবে শর্তে আরও প্রায় ১২০ জনের কাছ থেকে প্রায় ২ লাখ ১০ হাজার দিনার নিয়ে তার পরিবারের বিভিন্ন সদস্যদের নামে পাঠিয়ে দেয়।

এভাবে বিশ্বস্ত হয়ে ওঠে ওমর। পরে সাব্রাতা এলাকা থেকে আরও ৪০ জনের কাছে থেকে ১০০০ ডলারে ১৭শ’ ৫০ দিনার করে নিয়ে দেশে পাঠানোর জন্য নেয়। এর একপর্যায়ে লিবিয়ার জাওয়াইয়া সমস্যার কারণে আর টাকা পাঠানো সম্ভব না এবং আর দিনার জমা নেবে না বলে ওমরকে জানিয়ে দেয় সেই ব্যাংক কর্মকর্তা। কিন্তু এরপরও ওমর ও তার ভাই ফুয়াদ দেশে টাকা পাঠানোর নাম করে জাওয়াইয়াসহ আশপাশের এলাকা থেকে দিনার সংগ্রহ করতে থাকেন। তারা আশ্বাস দেন ব্যাংকে সামান্য সমস্যা কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই এ সমস্যা কেটে যাবে। এ কথা বলে আবারও ১৭শ’ ৫০ দিনার করে প্রায় ১৬০ জনের কাছে থেকে ২ লাখ ৪৫ হাজার দিনার (প্রায় দেড় কোটি টাকা) সংগ্রহ করে। বেশ কিছুদিন পার হওয়ার পরও পাঠাতে না পারায় অনেকে দিনার ফেরত চান। চাপের মুখে প্রায় ২০ জনের দিনার তারা গোপনে ফিরিয়ে দিয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে গা ঢাকা দেন। অধিকাংশ সময় মোবাইল বন্ধ রাখে। মাঝে-মধ্যে মোবাইল খোলা পেয়ে ভুক্তভোগীরা কথা বললে দিনার ফিরিয়ে দেয়ার আশ্বাস দেন।

পরে সুযোগ বুঝে গত রোজার ঈদেও ৩-৪ দিন পর দেশে পাড়ি জমান তারা। অর্পণ মাহমুদ জানান, লিবিয়ার জাওয়াইয়া একটি ফার্মেসিতে কাজ করতেন রাকিব। তিনি তার ১ বছরের উপার্জিত দিনারসহ আরও ৪ জনের মোট ৬ লাখ সাড়ে ১০ হাজার দিনার জমা দেন রুমমেট ওমরের কাছে। কয়েকদিন পর দেশে টাকা না যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে ওমর জানান, ব্যাংকে সমস্যা হয়েছে তাই টাকা যেতে একটু দেরি হবে। এরও ১০ দিন পর দিনার ফেরত চাইলে তা লিবিয়ানের কাছে আছে বলে জানায়। পরে ঈদের ৩-৪ দিন পর এক ভোরে ওমর ও তার ভাই ফুয়াদ গা ঢাকা দেয়।

ওমর তার ভাই ফুয়াদ এবং রাকিব একসঙ্গে জাওয়াইয়া মসজিদের একটি রুমে ভাড়া থাকতেন। এই সুবাদে তার কয়েকজন পরিচিত মানুষও ওমরকে দিনার দিয়েছিলেন। ওমর গা ঢাকা দেয়ার পর অনেকে তাকেও সন্দেহ করে। পরে সে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইউরোপে পাড়ি জমায়।  জাওয়াইয়া হাসপাতালে নার্স হিসেবে কাজ করেন বগুড়ার আঞ্জুমান আরা খাতুন। তিনি স্বামী-সন্তান নিয়ে ৭ বছর ধরে লিবিয়ায় আছেন।

১ বছরের জমানো দিনার ১০ হাজার ডলার হিসেবে ১৬ হাজার দিনার ওমরের কাছে দিয়ে এখন তারা নিঃস্ব। ৪ সদস্যের এ পরিবারটি অর্থাভাবে দেশেও ফিরতে পারছে না। ওমর গা ঢাকা দেয়ার পর তারা লিবিয়া প্রশাসনের কাছে অভিযোগ দেয়ার প্রস্তুতি নিলে ওমরের বড় ভাই সৌদি আরব প্রবাসী ফারুক খান নিজেই যোগাযোগ করে  দু’দফায় ৫০ হাজার করে দেশে থাকা আঞ্জুমান আরার ভাই আবদুল হাকিমকে ১ লাখ টাকা দেন। বাকি টাকা দেশে এসে পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দেয়।

তবে ফারুক ছুটিতে বাড়িতে গিয়ে আর কোন যোগাযোগ করেনি। এমনকি তার পরিবারও ফোন রিসিভ করে পরিচিত কণ্ঠ বুঝেই কেটে দেয়।

ওমরের এলাকার নুরু শেখ। তিনি ওমরের পাশেই অন্য একটি মাংসের দোকানে কাজ করেন। তিনিসহ আরও ৫ জন মোট ১৮ হাজার দিনার দিয়েছিলেন ওমরকে। নুরু জানান, ওমর গা ঢাকা দেয়ার পর যখন এখানকার প্রবাসীরা ওমরকে খুঁজতে থাকেন, তখন ওমরের সৌদি আরব প্রবাসী ভাই ফারুক তার পরিবারকে ৬ লাখ টাকা দেয় এবং পরে বাকি টাকা দেশে ফিরে এসে দেবে বলে আশ্বাস দেয়।

একই সঙ্গে ফারুক তাকে অনুরোধ করে বাড়ির ঠিকানা কাউকে না জানাতে। কিন্তু নুরু ভুক্তভোগীদের বাড়ির ঠিকানা জানিয়ে দেয়। পরে ফারুক তাকে ফোনে জানায়, সে সব টাকা পরিশোধ কবে দেবে, তবে কেউ যেন লিবিয়াতে তার ভাইদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ না নেয়। তার ভাই লিবিয়াতে ব্যবসা করবে, কিছুদিনের মধ্যেই তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ফিরে আসবে এমন আশ্বাসও দেয় সে। এর কিছুদিন পরই ওমর এবং ফুয়াদ লিবিয়া থেকে গোপনে দেশে ফেরত আসে। এরপর থেকে সৌদি প্রবাসী ভাই ফারুক খানও সবার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়।

স্থানীয় এক কোম্পানির সুপারভাইজার হিসেবে কর্মরত মামুন নামে বগুড়ার এক বাসিন্দাও প্রতারক ওমরকে ১১ হাজার দিনার দিয়েছিলেন কিন্তু তার কোন টাকা বাড়িতে পৌঁছায়নি। প্রতারকরা দীর্ঘদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে জমানো এধরনের দেড়শতাধিক ব্যক্তির টাকা নিয়ে দেশে পালিয়ে এসেছে। এদিকে স্থানীয়ভাবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতারক ফুয়াদ খান ও ওমর খান বর্তমানে তাদের নিজ এলাকায় অবস্থান করছেন। তাদের বড় ভাই ফারুক খান কিছুদিন আগে সৌদি আরব থেকে বাড়িতে এসে আবারও চলে গেছেন।

আরটিএমনিউজ২৪ডটকম/জেড এইচ

Logo-orginal