Ziaul Hoque
শুঁটকিতে আর বিষ নয় : বিকল্প উদ্ভাবন চবি শিক্ষকের
প্রকাশ: ২০১৫-১০-২২ ১৬:১১:৫১ || আপডেট: ২০১৫-১০-২২ ১৬:১২:২৮
আরটিএমনিউজ২৪ডটকম, চবিঃ চট্টগ্রামের শুঁটকির খ্যাতি দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে আছে। ধনী-দরিদ্র সব শ্রেণীর মানুষের কাছে লোভনীয় এক খাবার উচ্চ পুষ্টিমান সমৃদ্ধ শুঁটকি। কিন্তু সুস্বাদু এই খাবারটি প্রক্রিয়াজাত করতে কিছু অসাধু মানুষ বিবেকবর্জিতভাবে ‘বিষ মেশানো’র কারণে অনেকেই শুঁটকি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। একসময় শুঁটকির ব্যবসায়ও মন্দাভাব দেখা দেয়। কিন্তু পরিস্থিতি আস্তে আস্তে পাল্টাচ্ছে। জনগণের সচেতনতার কারণে অনেকে বাধ্য হয়েই বিষ মেশানো বন্ধ করেছেন। কিন্তু এখনো অসাধু কিছু ব্যবসায়ী শুঁটকিতে বিষ মিশিয়েই যাচ্ছেন। যদিও তা আগের তুলনায় অনেকাংশেই কমে এসেছে। তবুও শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকরণে বিষের ব্যবহার যাতে শূন্যের কোটায় নামানো যায় সে জন্য বিকল্প পদ্ধতি উদ্ভাবনে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সামুদ্রিক বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের গবেষকেরা।
ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. শেখ আফতাব উদ্দিন ও শিার্থী মিল্কী দেবীর গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকরণে বিভিন্ন কীটনাশকের ব্যবহার এবং স্বাস্থ্যসম্মতভাবে প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহারের মাধ্যমে শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকরণ ও পোকার আক্রমণ দমনের বিষয়টি। সাফল্যও এসেছে তাদের গবেষণায়। বিকল্প পদ্ধতিতে শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকরণে গবেষণা সাফল্য শুঁকটিপ্রেমীদের জন্য এনেছে সুসংবাদ।
বিভিন্ন মাধ্যমে আহরিত শুঁটকির প্রথম গন্তব্য দেশের সর্ববৃহৎ পাইকারি মোকাম চট্টগ্রামের আসাদগঞ্জসহ বিভিন্ন আড়ত। পরে তা রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রির উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়।
অভিযোগ রয়েছে, শুকিয়ে ফেলার পর শুঁটকিতে মাছিসহ বিভিন্ন ধরনের পোকার আক্রমণে এর গুণাগুণ নষ্ট হয় ও ওজন কমে যায়। ফলে বিপুল তির হাত থেকে বাঁচতে বিভিন্ন ধরনের কীটনাশকের ব্যবহার হয়ে আসছে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে কোল্ড স্টোরেজে প্রক্রিয়াজাত শুঁটকি সংরণ করার পদ্ধতি চালু হওয়ায় কীটনাশকের ব্যবহার অনেকেকাংশেই হ্রাস পেয়েছে বলে ব্যবসায়ীদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে।
গত মঙ্গলবার চট্টগ্রামের আছদগঞ্জের শুঁটকি আড়তদার জাহাঙ্গীর আলম এ প্রতিবেদককে জানান, এখন আবহাওয়া ভালো। তা ছাড়া শুঁটকির ভরা মওসুম। কোল্ডস্টোরেজে মাছ সংরণ করা যায় বলে এখন বিষ প্রয়োগের প্রয়োজন নেই বলেও তিনি দাবি করেন।
আছদগঞ্জ শুঁটকি ব্যবসায়ী আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজী মো: নাজের এ প্রতিবেদককে জানান, মাছ শুকাতে রাসায়নিকের ব্যবহার এখন বন্ধ হয়ে গেছে। কীটনাশক ব্যবহার করা হয়েছে কিনা তা শনাক্ত করার কোনো ব্যবস্থা না থাকার কথা তিনি এ প্রতিবেদকের কাছে স্বীকার করে বলেন, শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকরণের সাথে জড়িতদের বিষ ব্যবহারে কঠোরভাবে আমাদের নিষেধ আছে। আগে পোকা না আসার জন্য বিভিন্ন কিছু ব্যবহার করা হতো জানিয়ে তিনি বলেন, এখন কোল্ডস্টোরেজ হওয়াতে এর প্রয়োজনীয়তা নেই।
এ দিকে সমুদ্র বিজ্ঞানী ড. আফতাব এ প্রতিবেদককে জানান, বিভিন্ন ধরনের পোকার আক্রমণ রোধে মাছ শুকানোর আগে সুমিথিয়ন, নগস, নিউবেক্রন, এন্ড্রিন, ম্যালাথিয়ন, ডাইমেক্রনসহ বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক মিশ্রিত পানিতে চুবিয়ে নেয়ার দৃশ্য তারা কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে হত্য করেছেন। তিনি জানান, কীটনাশক মিশ্রিত পানিতে চুবানোর পর তা রোদে শুকিয়ে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। তিনি জানান, মানব শরীর রাসায়নিক উপাদান হজম করতে পারে না। ফলে এই কীটনাশকের কার্যকারিতা কখনো নষ্ট হয় না। এমনকি রান্নার পরও এর কার্যকারিতা নষ্ট হয় না। বরং তা শরীরে রাসায়নিক ক্রিয়াকে আরো বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে বিভিন্ন জটিল রোগ, যেমন ক্যান্সার, ত্বকে জ্বালাপোড়াসহ নানা ধরনের চুলকানি, পেট ব্যথা, মাথাব্যথা, স্নায়ুবিক বৈকল্য, জন্ম বিকলাঙ্গতার মতো মারাত্মক সব রোগ কীটনাশকযুক্ত শুঁটকির ভোক্তারা আক্রান্ত হচ্ছেন।
গবেষণার ফলাফল: এ দিকে নিমপাতা ও হলুদের ব্যবহারের মাধ্যমে কীটনাশকের বিকল্প পদ্ধতিতে শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতিতে ভালো ফলাফল পেয়েছেন দাবি করে ড. আফতাব বলেন, উল্লেখিত দু’টি প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহারের মাধ্যমে মাছ শুকিয়ে তিন মাস পর্যন্ত রেখে দেয়ার পরও কোনো ধরনের পোকায় আক্রান্ত হয়নি। এসব উপাদান ব্যবহারে প্রস্তুত শুঁটকির স্বাদও স্বাভাবিক বলে তিনি জানান।
এই সমুদ্র বিজ্ঞানীর গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী নিমপাতাকে ৪০-৫০ ডিগ্রি সেন্ট্রিগ্রেড তাপে সেদ্ধ করে ওই পানির তাপমাত্রা ২০-২৫ ডিগ্রি সেন্ট্রিগ্রেডে নেমে এলে তাতে মাছ আধা ঘণ্টা চুবিয়ে রেখে রোদে শুকাতে হবে। নিমের মধ্যে থাকা এজাডিরেক্টিন জীবাণুর বৃদ্ধি প্রক্রিয়া থামিয়ে দেয়ার মতা পরীতি বলে গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
এ ছাড়া কাঁচা হলুদ থেঁথিয়ে ৫০-৬০ ডিগ্রি সেন্ট্রিগ্রেড তাপমাত্রায় সেদ্ধ করে কিছুণ পর তাপমাত্রা কমিয়ে ২০-২৫ ডিগ্রি সেন্ট্রিগ্রেডে নেমে এলে তাতে আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা মাছ চুবিয়ে নিয়ে রোদে শুকাতে হবে।
প্রাকৃতিক উৎপাদন ব্যবহারের মাধ্যমে শুঁটকি প্রক্রিয়াজাত করলে একদিকে জনস্বাস্থ্য যেমনি হুমকিমুক্ত হবে, তেমনি ব্যবসায়ীরাও পোকার আক্রমণ থেকে রা পাবেন বিধায় সংরণে আর ঝুঁকি থাকবে না। প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে রাসায়নিকের ব্যবহারের বিকল্প মাছ শুকানোর এই পদ্ধতিকে জনপ্রিয় করে তুলতে সরকার ও জনপ্রতিনিধিরা এগিয়ে এলে আমরা প্রযুক্তিগত সহায়তা দিতে প্রস্তুত আছি এমন মন্তব্য করেন এই গবেষক। সূত্রঃ নয়াদিগন্ত
আরটিএমনিউজ২৪ডটকম/জেড এইচ