, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

Avatar nu ajad

বাংলাদেশে বাকস্বাধীনতা এক নজিরবিহীন আক্রমণের সম্মুখীন

প্রকাশ: ২০১৫-১১-২০ ২১:৩৯:১৪ || আপডেট: ২০১৫-১১-২০ ২২:০৯:৪৪

Spread the love

Freedom

আরটিএমনিউজ২৪ডটকম, ঢাকা: রাষ্ট্র তার প্রয়োজনে অনেক কিছু্ই করতে পারে, সে ক্ষমতা যে কোনো শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রকে দেয়া আছে। আর যদি হয় সেটা সার্বভৌমত্বের নিরাপত্তা, আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, শান্তি-শৃঙ্খলা কিংবা জনস্বার্থের স্লোগান তাহলে তো কোনো কথাই নেই। এরপরও প্রশ্ন থাকতে পারে- রাষ্ট্রের এই প্রয়োজনের মাত্রাটা কিসের ভিত্তিতে নিরুপিত হবে। না, যারা ক্ষমতায় থাকবেন তারা যাচ্ছে তাই করতে পারবেন। এর জবাব পরিষ্কার, অবশ্যই রাষ্ট্রের পদক্ষেপ জনগণের কাছে ন্যায়সঙ্গত তথা যথার্থ বলে প্রতীয়মান হতে হবে। অন্যথা, রাষ্ট্রকে জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হবে।

যাক এসব তাত্ত্বিক কথা, এখন আসি মূল প্রসঙ্গে। নিরাপত্তাজনিত কারণ দেখিয়ে বুধবার ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপ, লাইন, ট্যাংগো ও হ্যাংআউটসহ সামাজিক যোগাযোগের বেশ কিছু মাধ্যম ও অ্যাপস বন্ধ করে দেয় সরকার। পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত এসব অ্যাপস বন্ধ থাকবে। এ পদক্ষেপ নিতে গিয়ে এক ঘণ্টারও বেশি সময় সারা দেশে ইন্টারনেট সেবাও বন্ধ ছিল। এখন সরকারের এই পদক্ষেপের যৌক্তিকতা নিয়ে চলছে বিতর্ক।

প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, সরকারের এই পদক্ষেপ কি জনগণের কাছে যথার্থ প্রতীয়মান হয়েছে, নাকি ক্ষমতাসীনরা ইচ্ছামাফিক এমনটি করেছে? এর আগেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। ফলে সরকারের এই পদক্ষেপ যদি জনগণের কাছে যথার্থ প্রতীয়মান না হয়ে থাকে তাহলে এর প্রতিকারই বা কি?

প্রসঙ্গত, বুধবার দুপুর থেকে সামাজিক মাধ্যম বন্ধ করার পর দেখা গেল অনেকেই এই মাধ্যমগুলো ব্যবহার করতে পেরেছেন। এখনও তা করছেন। বন্ধ করার পর তা ব্যবহার করতে পেরে অনেকে উল্লাসও প্রকাশ করছেন। ফলে এর মাধ্যমে আমরা কী বুঝবো? আর সরকারই বা আমাদের কি বুঝাতে চেয়েছে? তাই এসব বিষয়ে নিজের কিছু ভাবনা পাঠকদের সামনে তুলে ধরছি-

এক. 
আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন কিন্তু এতসব প্রযুক্তির ব্যবহার ছিল না। আমাদের শৈশব- কৈশোর কেটেছে প্রযুক্তি ছাড়াই। কিন্তু এই সময়ের ছেলেমেয়েদের বেলায় একথা ভাবাই যায় না। তবে এটা বাঁকা চোখে দেখারও সুযোগ নেই। কেননা যুগটাই এমন। তারা বড়ই হচ্ছে এর ভেতর দিয়ে। ফলে এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা, সংস্কৃতি, খেলাধূলা, খাওয়া-দাওয়া ও পছন্দ-অপছন্দ থেকে শুরু করে সবকিছুই প্রযুক্তি নির্ভর। এক্ষেত্রে ইন্টারনেট ভিত্তিক প্রযুক্তি আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো পৃথিবীকে এনে দিয়েছে তাদের হাতের মুঠোয়। এক মুহুর্তও এসব ছাড়া তাদের জীবন অচল। এমন যুগে এগুলো বন্ধ করে সরকার জনগণকে কি মেসেজ দিতে চেয়েছে জানিনা। তবে এর মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের কাছে ক্ষমতাসীনরা বিরাগভাজন হয়েছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাৎক্ষণিকভাবে তা দৃশ্যমান না হলেও হয়তো ভবিষ্যতে এর প্রতিক্রিয়া জানা যাবে বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

দুই. 
অনেকেই বলার চেষ্টা করছেন, সাম্প্রতিক সময়ে নাগরিকের বাকস্বাধীনতার উপর যে খড়গ চালানো হচ্ছিল সেটারই ধারাবাহিকতায় এই নগ্ন পদক্ষেপ। এ ছাড়া আর কিছুই নয়। কেননা, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় এ ধরনের পদক্ষেপ নজীরবিহীন। সরকার যে যুক্তিতে এমনটি করেছে তা জনগণের কাছে যথার্থ বলে প্রতীয়মান করতে পারেনি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া থেকেই বুঝা যাচ্ছে। ফলে এটাকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নাগরিকদের মতপ্রকাশের ন্যূনতম অধিকারটুকু খর্ব হিসেবেই দেখা হচ্ছে। রাষ্ট্রের নাগরিকদের সাথে সরকারের এর চেয়ে অগণতান্ত্রিক আচরণ আর কী হতে পারে! জানিনা, সামনে আর কত সংকুচিত করা হবে।

তিন. 
বুধবার থেকে বন্ধ করে দেয়া হয় ফেসবুক, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপস, মেসেঞ্জারসহ কয়েকটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অ্যাপস। কিন্তু এর মধ্যেও ব্যবহারকারীরা বিকল্প প্রযুক্তি ব্যবহার করে এগুলো ব্যবহার করছেন। বিশেষ করে জনপ্রিয় ফেসবুক ব্যবহারে সফল হয়েছেন অনেকে। এ বিষয়টি কী মেসেজ দিচ্ছে? অর্থাৎ সরকার যে এক্ষেত্রেও ব্যর্থ, ইচ্ছা করলেও এসব নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। ফলে এই পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে সরকার কী পেল আর না পেল সেটার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো আইটি সেক্টর তথা ভার্চুয়াল জগতেও আমাদের রাষ্ট্রীয় অবস্থান যে কতটা দুর্বল তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য থেকেও তা প্রতীয়মান হয়েছে। এ বিষয়ে কয়েকটি আইআইজি (ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেইটওয়ে) কোম্পানির কর্মকর্তারা বলেছেন, ‌‘অ্যাপসগুলো পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়ার প্রযুক্তি এদেশে নেই।’ বিটিআরসি চেয়ারম্যানও তা স্বীকার করে বলেছেন, ‘৯০ শতাংশ বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে।’ ফলে এটা আমাদের জন্য অশনিসংকেতও বটে। জানি না, রাষ্ট্রের হর্তাকর্তারা এটা কিভাবে দেখবেন।

চার.
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধের মাধ্যমে শুধু যে নাগরিকের বাকস্বাধীনতাই খর্ব হয়েছে এমনটি নয়। এর চতুর্মুখী নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে নাগরিকের উপর। আমার জানা মতে, দেশের অনলাইনভিত্তিক গণমাধ্যমগুলো চরম হুমকির মুখে পড়েছে। আর কয়দিন এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে যেমন অপরিমেয় ক্ষতির সম্মুখীন হবে, তেমনি গ্লোবাল ভিলেজের প্রতিযোগিতায় অনেকদূর পিছিয়ে যাবে বাংলাদেশ। আর এতে অনলাইনভিত্তিক গণমাধ্যমে কর্মরত হাজার হাজার যুবক বেকার হয়ে পড়তে পারে। শুধু অনলাইনভিত্তিক গণমাধ্যমগুলোই কেন, মেইনস্টিমের গণমাধ্যমগুলোও বিশ্বপ্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যাবে। এছাড়াও দেশ-বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি নাগরিকরা নানা ভোগান্তিতে পড়েছেন। যা এখানে বলে শেষ করা যাবে না।

পাঁচ. 
নিরাপত্তার কথা বলে ফেসবুক, ভাইবার ও হোয়াটসঅ্যাপের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং এ সংক্রান্ত বিভিন্ন অ্যাপস বন্ধ করা কি কোনো যথার্থ সমাধান? এ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে সর্বমহলে। কেননা, যাদেরকে উদ্দেশ্য করে এ কাজটি সরকার করেছিল তারা কি সত্যিই হাত-পা গুটিয়ে বসেছিল? যতদূর জানা গেছে তাতে, তারা সরকারের প্রযুক্তি সক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করেই তাদের সক্ষমতা-যোগ্যতাকে প্রমাণ করেছে বীরদর্পে। ফলে ভার্চুয়াল জগতে সরকারের জনবলের সক্ষমতাকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রযুক্তি নির্ভর অপরাধ মোকাবেলা ও দমন প্রযুক্তি দিয়েই করতে হবে। অ্যাপস বন্ধ করে এর সমাধান সম্ভব নয়। বিনামূল্যে মুঠোফোনে কথোপকথন, বার্তা, ছবি ও ভিডিও বিনিময়ে বিশ্বব্যাপী এমন শত শত অ্যাপস ব্যবহার হচ্ছে। মাত্র কয়েকটি অ্যাপস বন্ধ করে কোনো কিছুর সত্যিকার সমাধান হবে না। কোনো অ্যাপস বন্ধ করলে প্রযুক্তির দুনিয়ায় কোনো না কোনোভাবে সেটা ব্যবহারের সুযোগ তৈরি করা যায়। তথ্য-প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ মোস্তাফা জব্বার ঠিকই বলেছেন, ‘এটা মাথা ব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার মতো অবস্থা।’

তাদের মতে, ‘প্রযুক্তি নির্ভর অপরাধ প্রযুক্তি দিয়েই মোকাবেলা করতে হবে। কোনো অ্যাপস বন্ধ করা নয়; বরং সক্ষমতা বৃদ্ধিই সমাধান। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমরা রাষ্ট্রকে দুর্বল দেখতে পাই।’ তাদের মতে, ‘এখন যে অবস্থা হয়েছে সেটা সরকারের অবহেলার জন্য হয়েছে। সরকারের মধ্যে প্রযুক্তিগত অপরাধ মোকাবেলার মতো পর্যাপ্ত প্রযুক্তি ও জনবল নেই। এখনই এ বিষয়ে ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে এ ধরনের অপরাধ আমরা সামাল দিতে পারব না।’

সবশেষে বলবো, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র ছিল মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও  নাগরিকের স্বাধীনতা। স্বাধীনতার পর জাতি পাকিস্তানীদের বঞ্চনা থেকে মুক্ত হয়ে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণের প্রত্যাশা করেছিলো। কিন্তু আজ স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরও জনগণের সেই প্রত্যাশা কী পূরণ হয়েছে? না, সেই প্রত্যাশা যেন আজ দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। আজ বাংলাদেশে বাকস্বাধীনতা এক নজিরবিহীন আক্রমণের সম্মুখীন। নাগরিকের বাকস্বাধীনতা যেন ক্রমেই জিম্মি হয়ে পড়েছে। এটা কোনো সুস্থ ও গণতান্ত্রিক সমাজের পরিচয় নয়। আর যারাই সরকারকে এমন পরামর্শ দিয়ে থাকুক না কেন তারা জনগণের শুভাকাঙ্ক্ষী নন, সরকারেরও নন। ফলে সরকারের উচিত নাগরিকের বাকস্বাধীনতা হরণে অযাচিত হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থেকে নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার বাকস্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখা। কেননা, যতদিন ধরে সরকার নাগরিকের বাকস্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ অব্যাহত রাখবে, ততদিন রাষ্ট্র-সমাজ থেকে অস্থিরতা দূর করার স্বপ্ন দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই পরিগণিত হবে না। কেননা, কিছুসংখ্যক লোকের জন্য গোটা জাতি ‘সাফারার’ হতে পারে না। তাই সরকারের প্রতি আহবান জানাবো, অবিলম্বে বন্ধ সামাজিক মাধ্যমগুলো খুলে দিন। অন্যথা, এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে হিতে বিপরীত তথা তরুণ সমাজের মাঝে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতে পারে। যা সামাল দেয়া বর্তমানের আশঙ্কার চেয়েও জটিল হতে পারে। যদিও সেটা আমাদের কারো কাম্য নয়। উৎস: বাংলামেইল।

লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক। ই-মেইল: sarderanis@gmail.com

Logo-orginal