n_carcellar1957
প্রকাশ: ২০১৫-১২-২৬ ০০:২৬:৪১ || আপডেট: ২০১৫-১২-২৬ ১৩:১৭:২৩
এমন তো নয়, মাশরাফি আগে কখনো অধিনায়ক ছিলেন না। ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরেই প্রথমবার পান পূর্ণকালীন দায়িত্ব। কিন্তু ওই যে আততায়ী ইনজুরির সঙ্গে তাঁর চিরসখ্য! মাশরাফির নেতৃত্বকাল শুরু হতে না হতেই শেষ তাই। পরের বছর ইউরোপ সফরে ওই ভূমিকায় খণ্ডকালীন হিসেবে ফেরেন আবার। দেশের মাটিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজেও তাই। কিন্তু ওই সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে আবার ইনজুরির শিকার হয়ে আরেক দফা কান্নাভেজা চোখে মাঠ থেকে বেরিয়ে যাওয়া মাশরাফির। অধিনায়কত্বের রেস থেকে চিরতরে ছিটকে পড়াও কি ছিল না সেটি?
সে কারণেই তো গত বছরের শেষ প্রান্তে মাশরাফির হাতে সীমিত ওভারের দল তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তটি চমকপ্রদ। দুঃসাহসী না হলেও ভীষণ ঝুঁকির তো বটেই! সেই বাজিতে কী দারুণভাবেই না জেতে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)! জেতে আসলে বাংলাদেশ ক্রিকেটই। ওই ঝুঁকি না নিয়ে আসলে খুব একটা উপায়ও ছিল না বিসিবির। ২০১৪ সাল যে প্রায় প্রস্তর যুগে ফিরিয়ে নিচ্ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেটকে! যেখানে আফগানিস্তানের মতো ক্রিকেট-নবিশের কাছে হারতে হয়। নতজানু আত্মসমর্পণ করতে হয় হংকংয়ের কাছে। ২০১২ সালের এশিয়া কাপে একটুর জন্য শ্রেষ্ঠত্বের নিশান ওড়াতে না পেরে হাহাকারের ধ্বনি ওঠে যে দেশজুড়ে, তাদের জন্য এমনটা মেনে নেওয়া কঠিন।
ভাবা যায়, গত বছরের প্রথম ১০ মাসে ওয়ানডেতে একটি জয়ও নেই বাংলাদেশের! একটিও না! টি-টোয়েন্টিতে সম্বল বলতে আফগানিস্তান-নেপালের বিপক্ষে দুই জয়। টেস্টের অবলম্বন শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে এক ম্যাচে ড্র। বাকি সব ম্যাচে পরাজয়ের বেদনা-নীলক্ষত। এই যখন অবস্থা, পরিবর্তনের চিন্তা করবে না কেন বিসিবি! সেই চিন্তাটাই সময়ে প্রমাণিত বাংলাদেশ ক্রিকেটের বাঁকবদলের মূল নিয়ামক হিসেবে।
মুশফিকুর রহিম খারাপ করছিলেন না। ক্রিকেটার হিসেবে তাঁর আত্মনিবেদন বরাবর প্রশ্নাতীত। ব্যাটও হাসছিল প্রতিনিয়ত। কিন্তু দলের মুখের হাসি উধাও যে! ২০১১ সালের অক্টোবর থেকে জাতীয় দলের সর্বেসর্বা অধিনায়ক মুশফিকের ক্ষমতা তাই খর্ব করা হয় সীমিত ওভারের ক্রিকেটে। ফিরিয়ে আনা হয় মাশরাফিকে। নাই বা হলেন তিনি মুশফিকের মতো দুর্দান্ত পারফরমার। কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেটে তখন নেতা হিসেবে ঢের বেশি দরকার এক প্রেরণাদায়ী চরিত্রের। এই জায়গায় তো মাশরাফি অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্ব ক্রিকেটেই। নেতৃত্বের এই বদল বদলে দেয় বাংলাদেশ দলকে। সেই সঙ্গে কোচের বদলও। চন্দ্রিকা হাতুরাসিংহে অনানুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব নেন গত বছরের মাঝামাঝি ভারতের বিপক্ষে সিরিজে। এরপর আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে। এই সময়টায় বাংলাদেশ ক্রিকেটের দুঃস্বপ্ন প্রলম্বিত হয়েছে সত্যি, কিন্তু একটু একটু করে শিষ্যদের মনস্তত্ত্ব বোঝা শুরু করেছেন কোচ। শক্তি-দুর্বলতা চিহ্নিত করে কাজ করছেন সে অনুযায়ী।
এসবের যোগফলে মুশফিকের নেতৃত্বে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ জেতে ৩-০ ব্যবধানে। মাশরাফির অধিনায়কত্বে ওয়ানডে সিরিজ ৫-০ ব্যবধানে। বছর শেষে স্বস্তি নিঃসন্দেহে। তবে পরের বছরের ময়ূরপঙ্ক্ষীতে চড়া সুবর্ণ-সফরের পূর্বাভাস ছিল না তাতেও। কারণটা নিহিত ক্রিকেটসূচিতে। বছরের শুরুতে বিশ্বকাপের বিশ্বমঞ্চে লড়াই। সেটিও অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের প্রায় অপরিচিত কন্ডিশন-উইকেটে। এরপর দেশের মাটিতে পর পর চারটি পরাশক্তির সফর। শুরুতে পাকিস্তান, এরপর পর্যায়ক্রমে ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা-অস্ট্রেলিয়া।
২০১৪ সালে চোরাবালিতে আটকে পড়া বাংলাদেশ দলের ২০১৫ সালে চোরাবালিতে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছিলেন তাই অনেকে। তাদের ভুল প্রমাণ করতে একটু সময়ও যে নেয়নি বাংলাদেশ! ওই উইকেট-কন্ডিশনের কারণে বিশ্বকাপে একটা জুজুর ভয় ছিলই। নিজেদের ‘রাঘব-বোয়াল’ শিকার দূরে থাক, আফগানিস্তান-স্কটল্যান্ডের কাছে তো আবার শিকারে পরিণত হবে না বাংলাদেশ!
প্রস্তুতি ম্যাচ দুটিতে হারায় বেড়ে যায় সে শঙ্কা। কিন্তু বড় মঞ্চে ঠিকই শিকারি হয়ে ওঠে মাশরাফির দল। প্রত্যাশিত জয় দুটি তো পায়ই, সেই সঙ্গে করে ইংরেজ-সিংহ বধ। ফল? বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে যায় বাংলাদেশ। সেখানে ভারতের কাছে হারলেও এ নিয়ে শতেক প্রশ্নবোধক চিহ্নের ভিড়। যেটি একই সঙ্গে বাংলাদেশের সামর্থ্যের সূচকও বটে। এক বিশ্বকাপ থেকে তাই হাজার অর্জন নিয়ে ফেরেন মাশরাফিরা। তাতেও কি চ্যালেঞ্জ ফুরোয়! জ্বলন্ত উনুন থেকে ফুটন্ত কড়াইয়ে পড়ে বড়জোর। দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করে যে পরাশক্তিরা! কিন্তু বিশ্বকাপ থেকে টগবগে আত্মবিশ্বাস নিয়ে ফেরা বাংলাদেশকে তখন থামায় সাধ্যি কার! পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ জেতে প্রতিপক্ষকে চুনকাম করে। ভারতের করে দর্পচূর্ণ।
দক্ষিণ আফ্রিকাও হালে পানি পায় না। বিশ্বকাপের বিস্ময় অব্যাহত রেখে পরাশক্তিদের বিপক্ষে পর পর তিনটি ওয়ানডে সিরিজ জয়—বিশ্ব ক্রিকেটে নতুন পরিচয়ে পরিচিত হয় বাংলাদেশ। নতুন এক পরাশক্তির উন্মেষ পর্বে যেন সাক্ষী হয় মহাকাল। এরপর বাংলাদেশ সফরে আসার কথা ছিল অস্ট্রেলিয়ার। নিরাপত্তাহীনতার ধোয়া তুলে আসে না তারা। তাতে আগের দিনগুলোর মতো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে না বাংলাদেশের ১৬ কোটি ক্রিকেটপ্রাণ। পোড়ে বরং আক্ষেপের আগুনে—ইস্, এ অবস্থায় অস্ট্রেলিয়াকে পেলেই তো…। আসে জিম্বাবুয়ে। তত দিনে তাদের বিপক্ষে জয় কেবলই আনুষ্ঠানিকতার অপেক্ষা। মাশরাফির দল সেই আনুষ্ঠানিকতা সারে দৌর্দণ্ড প্রতাপে।
২০১৫ সালে বিশেষত ওয়ানডে ক্রিকেটে ক্রোশের পর ক্রোশ পথ পাড়ি দেয় বাংলাদেশ। অন্য দুই ফরম্যাটে হয়তো ততটা নয়। কিন্তু সেখানেও তো ক্ষণে ক্ষণে ঝিলিক দিয়ে ওঠে সম্ভাবনার সূর্যকিরণ। পাকিস্তানের বিপক্ষে খুলনা টেস্টে যেমন ২৯৬ রানে পিছিয়ে থাকা অবস্থায় দ্বিতীয় ইনিংসে ৩১২ রানের ওপেনিং জুটি গড়েন তামিম ইকবাল ও ইমরুল কায়েস। যেটি বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য ইডেন গার্ডেনসে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ভিভিএস লক্ষণ ও রাহুল দ্রাবিড়ের ওই মহাকাব্যিক জুটির সমতুল্য।
টি-টোয়েন্টিতে হারায় পাকিস্তানকে। এই দুই ফরম্যাটে প্রত্যাশিত উন্নতি না হলেও অপ্রত্যাশিত হোঁচটও তো খুব বেশি খায়নি বাংলাদেশ। দলের এমন আলো ঝলমলে সাফল্যে ব্যক্তিগত পারফরমেন্সের ঝলকানিও অগুনতি। আগের চার বিশ্বকাপে কোনো সেঞ্চুরি ছিল না বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের, এবার মাহমুদউল্লাহ ভাঙেন সেই চক্র। তা-ও এক না, টানা দুই ম্যাচে তিন অঙ্কের জাদুকরি সংখ্যা ছুঁয়ে। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের ক্রিকেটখনিতে সন্ধান মেলে মুস্তাফিজুর রহমান নামের এক হীরার টুকরোর। যিনি অভিষেকে পাঁচ উইকেট নিয়ে স্তব্ধ করে দেন ভারতকে, পরের ম্যাচে ছয় উইকেট নিয়ে নিস্তব্ধ।
সৌম্য সরকারের ব্যাটের আগুনে পুড়ে ছারখার হয় একের পর এক প্রতিপক্ষ। সকালের সূর্যের মতো নিয়ম করে হাসে সাকিব আল হাসানের ব্যাট-বল। মুশফিকুর রহিম রান করে যান ঋষির মগ্নতায়। রানমেশিন তামিম ইকবাল টেস্টে করেন ডাবল সেঞ্চুরি। বরাবর পার্শ্বনায়ক হয়ে থাকা ইমরুল কায়েসের ব্যাট থেকে আসে ১৫০ রানের ইনিংস। আর তাঁদের সবাইকে ছায়া দেওয়ার জন্য বটবৃক্ষ হয়ে দুজন তো আছেনই।
অধিনায়ক মাশরাফি ও কোচ হাতুরাসিংহে। ২০১৫ সাল নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ ক্রিকেটের সেরা বছর। মানচিত্রজুড়ে বছর ধরে তা খুশির তুফান ছোটায় বটে। সেই সঙ্গে তা উসেক দেয় প্রত্যাশার আগুনও। আশায় জ্বলজ্বলে স্বপ্নাতুর চোখ নিয়ে তাই সামনের বছরের দিকে তাকিয়ে রইবে এ দেশের পাগলপারা সমর্থকরা।
তাদের নিশ্চয়ই আবার ২০১৪ সালে ফিরিয়ে নেবেন না বাংলাদেশ ক্রিকেটের সূর্যসন্তানরা!
আরটিএমনিউজ২৪ডটকম/এন এ কে