, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪

Avatar n_carcellar1957

লিখে রাখুন ৫ জানুয়ারির কথা

প্রকাশ: ২০১৬-০১-০৩ ১৮:০৬:১০ || আপডেট: ২০১৬-০১-০৩ ১৮:১২:১৮

Spread the love

সালাহ উদ্দিন শুভ্র

image_112543_0আবারও এগিয়ে আসছে ৫ জানুয়ারি। বাংলাদেশে রাজনৈতিক ইতিহাসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তারিখ আছে, দিন আছে। তবে ৫ জানুয়ারি আলাদা। এই তারিখ পাকিস্তানি শাসনের অত্যাচার থেকে নিজেদের মুক্ত করার জন্য না, সামরিক জান্তা থেকে রেহাই পাওয়ার তারিখ হিসেবেও স্মরণীয় না। এই তারিখ গণতান্ত্রিক যে পদ্ধতি বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আকাংক্ষা জনমনে, নব্বই পরবর্তী বাস্তবতায়, নতুন বাংলাদেশের দাগ টেনে দেওয়ার তারিখ।

কথাটায় বাড়াবাড়ি তেমন নেই। ২০১৬ সালের ৫ জানুয়ারি এগিয়ে আসতেই টের পাওয়া উত্তাপে তার আঁচ আছে। ঘরপোড়া মানুষদের মনে দুই দলের বাগবিতণ্ডার সিঁদুরে মেঘেও অনেক ভয়ের সঞ্চার হচ্ছে দেখে কথাটা মনে হলো। এই তারিখ খাদ এবং চড়াইয়ের মিলনবিন্দু। এখান থেকে যেকোনো দিকে যাওয়া যাবে। সুযোগ আছে, পরিস্থিতি তাই বলছে। যোগ্যতা, আন্তরিকতা বা উপলব্ধির সমস্যাও আছে।

যেমন ধরা যাক, ‘জঙ্গিবাদ’। ৫ জানুয়ারি আসলে এই ইস্যু ফিকে আর ছোট হয়ে আসে।  বাস্তবিক আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি মাঠে থাকলে এই ইস্যু গৌণ। রাজনৈতিক বাস্তবতায় এ কথা অনেকেই বলেছেন, আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি যদি জোর সক্রিয় থাকে তা জঙ্গিবাদ ঠেকানোর মোক্ষম উপায়। এই দুই দলের উভয়ের, অথবা এক দলের নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়া মানে ‘জঙ্গিবাদের উত্থান’। এটা একটা সহজ রাজনৈতিক হিসাব।

বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল বা মতবাদ অর্থে এই দুই দলই বড়। তাদেরই প্রভাব। অন্যরা পরজীবী বা ছোট। ভেবেচিন্তেই কথাটা বলা। কারণ বাংলাদেশের সমস্ত জনগণের জীবন-রাজনীতি কম-বেশি এদের দ্বারাই প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত। অন্যরা আছেন, চেষ্টা করছেন। ভালো করছেন। তারাও হয়ত একসময় বড় হবেন। কিন্তু সেটা এখনই বলে দেওয়া যাচ্ছে না।

এখন যেটা বলা যায়, তা হলো বাংলাদেশে পরিবর্তিনের যে সূচনা বিন্দু তা এই ৫ জানুয়ারি এবং একে চিনতে পারা। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির হয়ে যাওয়া নির্বাচনের জের সহজে মিটবে না। সারা বছর কিছু না-থাক এই ৫ তারিখ গণ্ডগোলের পরিস্থিতি তৈরি হবেই, হচ্ছেও। বিএনপি সমাবেশ ডাকলে আওয়ামী লীগও ডাকছে। এর আগেও আমরা দেখছি, ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি এবং তার পরের সময়ের বিভীষিকা।  সেসবের আইনি বিচার যেমন হয়নি, রাজনৈতিক বিচারও হয়নি। অনেক প্রশ্নের মিমাংসার, অনেক সম্পর্কের অবসান, অনেক নতুনের শুরু এবং সমাধানের আরম্ভ বিন্দুও যে কারণে এই ৫ জানুয়ারি।

বাংলাদেশের রাজনীতি নির্বাচন নির্ভর। এর বাইরে এ দেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেনি। এই না-ঘটা ঘটনার নিন্দা করা যায়। পশ্চিমা রাজনীতির সঙ্গে মেলাতে গেলে হতাশও হতে হবে।  তবে সব দেশেই নির্বাচন হলো দরজা।  এটা দিয়ে ঢুকতে হয় মূল কাজে।  সেই শুরুর গলদ আমরা মেটাতে পারিনি। না-পারার ফল ভোগ করছি। আমাদের এমন একটা ব্যবস্থা দরকার যেটা নির্বাচনকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলবে। সেই না-পারার দায় অনেক।

এই দায় দুই রাজনৈতিক দলের একার নয়। এই দায় নাগরিক সমাজ, বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ, শিক্ষকদেরও। রাজনৈতিক দল এসব শ্রেণীর মানুষ নিয়েই গড়ে ওঠে। দলের বাইরে এই শ্রেণীর মানুষদের খুঁজে পাওয়াও যায় না সাধারণত। কাজ বা আদর্শগতভাবে কোনো-না-কোনো দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা থাকে তাদের। এটা স্বাভাবিক। যে কারণে কোনো দল ক্ষমতায় থাকা মানে এসব মানুষদেরও ক্ষমতায় থাকা। কিন্তু তাদের যে স্বভাব, যে পেশা সেটা ভুলে যান না, বা সেই আচরণ স্থগিত রাখেন না। তাদের প্রভাবে সরকার গণমুখী থাকেন।

বাংলাদেশে এই জিনিসটার বড় অভাব।  এখানে স্বভাব ভুলে যাওয়ার রোগ আছে। ক্ষমতায় বিলীন হয়ে যাওয়ার অভ্যাস আছে। ফলে এই ৫ জানুয়ারিকে রক্ষা কিম্বা একে ভুলে যাওয়ার দলে অনেক চিন্তক, লেখক, বুদ্ধিজীবী আছেন। তাদেরসহ জড়িয়ে এই তারিখ প্রকাণ্ড হয়ে উঠেছে। এই তারিখের চাইতে বড় তারিখের জন্মের ফলাফল হবে এসব মানুষদের বিস্মৃত হয়ে যাওয়া।

সেই সঙ্গে বদলে যাবে ইতিহাসও, মিথও। নানা বিশ্বাস, ইতিহাসের বিভিন্ন বয়ান। এসব ধরে রাখার সঙ্গে ৫ জানুয়ারিকে ধরে রাখা আবশ্যিক হয়ে উঠেছে। এটা খুব প্রাকৃতিক ঘটনা। ফলে যারা চান ৫ জানুয়ারি থেকে রেহাই পেতে, তাদের অন্য সব বিষয়েও ভাবনা বদলের প্রস্তুতি নিতে হবে। নইলে পরিবর্তন ঘটবে না। সারা বছর শান্তি কায়েম করলেও ঐ একটি দিনের জন্য ফিরে যেতে হবে সংঘাতে।

৫ জানুয়ারি তাই সহজ হিসাবে ফিরবার দিন। রাজনৈতিক দলকে মিছিল করতে দেওয়ার দিন, সমাবেশ করতে দেওয়ার দিন, ভোট দেওয়ার দিন। সেই হিসাবের গরমিলে আটকা পড়েছে বাংলাদেশ। রাজনৈতিক সদিচ্ছার বদৌলতে এ থেকে বের হয়ে আসা যাবে না। আরও অনেক চিন্তার ও মানসিকতার বদলও এখানে প্রাসঙ্গিক।

এই তারিখকে তাই ভুলে গেলে চলবে না। আপাতত ভুলে যাওয়া হচ্ছেও না। তবে পরে যখন ভাবতে বসব, তখন যেন মনে থাকে। নতুন বাংলাদেশেও বসে যেন ভাবা যায় কোত্থেকে এসেছি আমরা, কী কারণে এলাম। সেই ভবিষ্যতের দুনিগুলোর জন্য ৫ জানুয়ারির কথা লিখে রাখা দরকার।

লেখক, সাংবাদিক  

 

Logo-orginal