আরটিএমনিউজ২৪ডটকম, অনলাইন ডেস্কঃ সারাদেশে নিখোঁজের তালিকায় ২৬২ জনের মধ্যে কয়েকজন ফিরে এসেছেন। তালিকা প্রকাশের আগেই তারা ফিরে আসেন। কলেজ পালিয়ে বাসায় ফিরে না এসে নিখোঁজ হওয়া এরকম কয়েকজন স্থান পেয়েছেন এই নিখোঁজের তালিকায়। আবার অনেকেই ফিরে আসার পর বিষয়টি পুলিশকে অবহিত করেনি। এতে পুলিশের খাতায় তার নামটি নিখোঁজের তালিকায় রয়ে যায়।
গুলশানে হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর নিখোঁজের বিষয়টি নিয়ে পুলিশের মধ্যে টনক নড়ে। তবে ২৬২ জনের তালিকার মধ্যে বিডিআর বিদ্রোহে নিহত কর্নেল মশিউর রহমানের ছেলে আশিকুর রহমান জিলানী ওরফে আবু জান্দাল বাঙালি সিরিয়ায় আইএসের পক্ষে যুদ্ধ করতে গিয়ে নিহত হন। এ ব্যাপারে আইএসের ম্যাগাজিন ‘দাবিক’-এ একটি ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে। যদিও নিহত কর্নেল মশিউর রহমানের পরিবারের পক্ষ থেকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে এ ব্যাপারে জিলানী নিহত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়নি।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া এন্ড পাবলিক রিলেশনস শাখার উপ-কমিশনার মাসুদুর রহমান বলেন, যে কোনো ব্যক্তির নিখোঁজ হওয়ার কারণ আছে। পারিবারিক কলহ বা দ্বন্দ্ব বা প্রেম ঘটিত কারণ বা নিজেকে আত্মগোপন করতে বা অর্থ লেনদেনের দ্বন্দ্ব থেকে নিখোঁজের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনা তদন্ত করতে অনেক সময় ও যাচাই বাছাইয়ের প্রয়োজন হয়। তাই নিখোঁজের জিডি হলেই যে তাকে জঙ্গি বলা যাবে-এটা ঠিক নয়।
গত ২০ জুন বাবার সঙ্গে কলেজে এসে নিখোঁজ হন মেহেদী হাসান (১৮)। তিনি উত্তরা রাজউক মডেল কলেজে চলতি বছরে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে ভর্তির জন্য ফরম তুলতে এসেছিলেন। নিখোঁজ হওয়ার পর র্যাবের প্রকাশিত ২৬২ জনের তালিকার মধ্যে ১৮ নম্বরে তার স্থান হয়। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় উত্তরা পূর্ব থানার এসআই মোখলেসুর রহমান রাজলক্ষ্মী কমপ্লেক্সের সামনে ফুটপাতে একটি কাপড়ের দোকানে এক ছেলেকে দেখে তার সন্দেহ হয়। ‘এই ছেলেকে কোথায় যেন দেখেছেন’ এমন চিন্তা করতে করতে হঠাত্ মনে হয় যে, তার কাছে একটি জিডি তদন্ত করতে দেওয়া হয়েছে, যেখানে ঐ ছেলের ছবি রয়েছে। তিনি ঐ ছেলেকে আটক করার পর পড়াশুনায় ফাঁকি দেওয়া এক ছাত্রের কাহিনী বের হয়। আটক মেহেদি হাসানকে নেওয়া হয় উত্তরা বিমানবন্দর জোনের সহকারী কমিশনার আব্দুল্লাহিল কাফীর কাছে।
পুলিশের কাছে মেহেদী জানান, কুমিল্লার হোমনা থানার শ্যামপুর গ্রামের মোহসিনের ছেলে। ভালো পড়াশুনার জন্য বাবা তাকে কুমিল্লার মর্ডান স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করিয়ে দেয়। স্কুলের হোস্টেলে থেকে সে পড়াশুনা করতো। নবম শ্রেণিতে সে উত্তীর্ণ হতে পারেনি। স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে ঐ স্কুলে আর পড়াশুনা করতে দেয়নি। কিন্তু বিষয়টি মেহেদী তার বাবা-মার কাছে গোপন রাখে। সে স্কুলের হোস্টেল ত্যাগ করে পাশের একটি মেসে ওঠে। বাড়ি থেকে প্রতি মাসে তার পড়াশুনার খরচ পাঠানো হতো। বিভিন্ন সময়ে বাড়িতে গেলেও সে যে আর পড়াশুনা করছে না— বিষয়টি চেপে যায়। এভাবে চলতি বছরে এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ হলে বাসায় জানিয়ে দেয় যে, সে জিপিএ-৫ পেয়েছে। এরপর সে তার বাবাকে জানায় যে, সে ঢাকায় কলেজে ভর্তি হবে। তার আশা ছিল যে, বাবা তাকে টাকা দিবে। আর ঐ টাকা নিয়ে ঢাকায় মেসে উঠে জানিয়ে দিবে সে কলেজে ভর্তি হয়েছে। এ জন্য আগে থেকেই জানিয়ে দেয় সে উত্তরা রাজউক মডেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু ২০ জুন তার বাবা তাকে ঢাকায় নিয়ে আসে।
ঐ দিন মোহসীন তার ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে উত্তরা রাজউক মডেল কলেজে আসেন। ভর্তির ফরম বিতরণ কক্ষে প্রবেশ করার সময় মেহেদী তার বাবাকে জানায় যে, একটু ওয়াশ রুমে যাবে। এরপর মেহেদী হাসান কলেজ থেকে পালিয়ে যায়। কারণ সে তো ৮ম শ্রেণি পাস করতে পারেনি। এসএসসি পরীক্ষা পাস তো দূরের কথা, অংশই নিতে পারেনি। এ অবস্থায় ঐ সন্ধ্যায় মোহসীন উত্তরা পূর্ব থানায় একটি নিখোঁজ সংক্রান্ত জিডি করেন। পুলিশ জিডির তদন্ত করতে উত্তরা রাজউক মডেল কলেজের সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করে। সেখানে পুলিশ দেখতে পায় যে মেহেদী মাথা নিচু করে কলেজ থেকে বের হয়ে যাচ্ছে।
মেহেদী আরো জানায়, ঘটনার দিন সে টঙ্গীতে পালিয়ে যায়। সেখানে রেলস্টেশনে ২/৩ দিন থাকার পর একদিন উত্তরা রাজলক্ষ্মী কমপ্লেক্সে আসে। সেখানে ফুটপাতে কাপড়ের দোকানি নিজাম উদ্দিনের কাছে মিথ্যা পরিচয় দেয়। সে জানায় যে তার মা মারা গেছে। বাবা আরেকটি বিয়ে করেছে। সত্ মা তাকে খেতে দেয় না। বাসা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। নিজাম উদ্দিনের জীবনেও এরকম ঘটনা রয়েছে। তিনি আবেগ তাড়িত হন। শেষে তার দোকানে কাজ করতে দেন। মেহেদীকে তার বাসায় থাকতে দেন। ঈদে মেহেদীকে নিজের সন্তানের মতো আদর দিয়ে নোয়াখালীতে তার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যান। ফিরে আসার পর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পুলিশ ঐ দোকান থেকে মেহেদীকে সনাক্ত করে। গতকাল বুধবার দুপুরে মেহেদী হাসানকে তার বাবার কাছে ফিরিয়ে দেয় পুলিশ।
ছয় মাস আগে ফিরে আসেন ছানাউল্যাহ
নিখোঁজ ২৬২ জনের তালিকায় ৪৩ নম্বরে আছে ছানাউল্যার নাম। তালিকায় তার বাবার নাম লেখা হয়েছে মাওলানা তাজুল। স্থায়ী ঠিকানা লেখা হয়েছে, চিলারচর, থানা-হাজীগঞ্জ, জেলা-চাঁদপুর। বর্তমান ঠিকানায় লেখা হয়েছে, ১৭ মধুবাগ, রমনা, ঢাকা। ‘নিখোঁজ’ এই ছানাউল্যাহ এখন রাজধানীর মগবাজার এলাকার একটি মুদির দোকান চালান।
ছানাউল্যা জানান, ২০০৯ সালে সৌদি আরবে যান তিনি। ২০১২ সালে সৌদি আরব থেকে ফিরে ১০৫, নয়াটোলায় তাজ জেনারেল স্টোর নামে মুদির দোকান দেন। চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি বিকাশে টাকা পাঠাতে পাশের একটি দোকানে যাচ্ছিলেন তিনি। এ সময় একটি মাইক্রোবাসে করে আসা কয়েকজন লোক ঠিকানা জানতে তার হাতে একটি চিরকুট ধরিয়ে দেয়। চিরকুটটি পড়ার সময় মুখে কিছু একটা স্প্রে করে। জ্ঞান ফেরার পর তিনি একটি বাঁশের বেড়ার ঘরে নিজেকে দেখতে পান। এই ঘরের চারপাশেই ছিল পানি। বেড়া ভেঙে তিনি বের হয়ে মূল সড়কে চলে আসেন। ছানাউল্যাহ জানান, স্থানীয়দের জিজ্ঞাসা করে তিনি জানতে পারেন, ওই এলাকার নাম কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম। পরে একটি বাসে করে ঢাকায় ফিরে আসেন।
ছানাউল্যাহর নিখোঁজের পর তার বাবা মগবাজার টিঅ্যান্ডটি মসজিদের খতিব মো. তাজুল ইসলাম রমনা থানায় ৫ জানুয়ারি একটি সাধারণ ডায়রি করেন। তাতে তিনি জানান, ৪ জানুয়ারি নিখোঁজ হয়েছে তার ছেলে। আর ৬ জানুয়ারি সানাউল্যাহ বাড়ি ফিরলেও এ বিষয়ে থানায় আর কিছু জানাননি তাজুল বা ছানাউল্যাহ। আর পুলিশও সে সময় ওই জিডির বিষয়ে কোনও তদন্ত বা অনুসন্ধান চালায়নি।
এ ব্যাপারে রমনা থানার ওসি মশিউর রহমান গতকাল রাতে ইত্তেফাককে বলেন, ‘আসলে র্যাব আমাদের কাছে নিখোঁজের তালিকা চেয়েছিল, ঐ হিসাবে তালিকা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কোন কারণে ভুলে পূর্বের জিডির সূত্র ধরে ঐ তালিকায় সানাউল্লাহর নামটি দেওয়া হয়েছিল।’
জিলানী ওরফে আবু জান্দাল সিরিয়ায় নিহত :
২৬২ জন নিখোঁজ ব্যক্তির নামের তালিকায় ২৬১তম নামটি আশিকুর রহমান জিলানী ওরফে আবু জান্দাল। তিনি সিরিয়ায় যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হয়েছেন। আইএসের ম্যাগাজিন দাবিক এর দাবি, তিনি (জিলানী) আবু জান্দাল আল বাঙালি। জিলানীর বাবা কর্নেল মশিউর রহমান বিডিআর বিদ্রোহের সময় নিহত হন। জিলানী মিলিটারি ইন্সটিটিউশন অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে (এমআইএসটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর শিক্ষার্থী ছিলেন। দাবিকের ১৪৩৭ রজব এর ১৪তম ইস্যুতে দাবি করা হয়, জিলানী বাংলাদেশ সেনা কর্মকর্তার সন্তান যিনি ‘বিডিআর বিদ্রোহের’ সময় নিহত হয়েছেন। সেই প্রবন্ধে বলা হচ্ছে, ‘জিলানী তার তরুণ বয়সের শেষ সময়ে আসল ইসলামি ডাক পান, যখন তিনি শায়েখ আনোয়ার আল আওলাকির বক্তৃতা শুনতেন। যখন সিরিয়ায় খালিফা ঘোষণা দেয়া হয়, সেই শুরুর সময়েই জিলানী তাওহিদ ও খলিফার বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ করতে শুরু করেন।
এছাড়া ঢাকা সেনানিবাসের কানিশালি এলাকার বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত মেজর আব্দুল মান্নান চৌধুরীর ছেলে আফিফ মানসিফ চৌধুরী ও কাফরুলের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত মেজর ডা. কবিরের ছেলে শামীম রেদোয়ান ফিরে এসেছেন।
উপ-সহকারী কৃষি অফিসার ফরহাদ বাড়ি ফিরেছেন
জীবননগর (চুয়াডাঙ্গা) সংবাদদাতা জানান, ২৬২ জনের নিখোঁজ তালিকায় চুয়াডাঙ্গার জীবননগর ও দামুড়হুদার দুই ব্যক্তির নাম আছে। এদের মধ্যে সামসুল হক মানসিক প্রতিবন্দ্বি ও পেশায় রাজমিস্ত্রী বলে পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে। অপর ব্যক্তি ফরহাদ হোসেন বর্তমানে দামুড়হুদা উপজেলা কৃষি অফিসে উপ-সহকারী কৃষি অফিসার হিসেবে কর্মরত। রাজমিস্ত্রি সামসুল হক গত ২৯ জুন শ্বশুরবাড়ি গোয়ালপাড়া থেকে নিখোঁজ হয়েছেন এবং ফরহাদ হোসেন ঢাকা থেকে ফেরার পথে অজ্ঞান পার্টির খপ্পড়ে পড়ে ৩ দিন ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিত্সাধীন ছিলেন। তিনি দামুড়হুদা উপজেলা শহরের গুলশানপাড়ার বাসিন্দা। তবে সামসুল হকের এখন পর্যন্ত কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি জীবননগর থানার ওসি হুমায়ুন কবির জানিয়েছেন।
উৎসঃ ইত্তেফাক