, বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪

admin admin

উম্মে কুলসুম বিনতে উকবা (রা.)

প্রকাশ: ২০১৭-০২-১৬ ০১:০১:৪৭ || আপডেট: ২০১৭-০২-১৬ ০১:০১:৪৭

Spread the love

যার পক্ষে নাজিল হয়েছে কোরআনের আয়াত

উম্মে কুলসুম বিনতে উকবা (রা.)

বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়, তিনি একাকী মক্কা থেকে বের হন এবং পথে খুজাআ গোত্রে এক ব্যক্তিকে সঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করেন। হেঁটে, মতান্তরে উটের পিঠে চড়ে মদিনায় পৌঁছেন। একমাত্র উম্মে কুলসুম (রা.) ছাড়া

উম্মে কুলসুম বিনতে উকবা (রা.)
উম্মে কুলসুম বিনতে উকবা (রা.)আরটিএমনিউজ২৪ডটকম,  অনলাইন সংবাদ:

উম্মে কুলসুম বিনতে উকবা (রা.)। তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন শত্রু পরিবেশে থেকেই। হজরত উম্মে কুলসুম (রা.) এর বাবা ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.) এর মক্কি জীবনের একজন চরম শত্রু। মক্কায় রাসুলুল্লাহ (সা.) ও দুর্বল মুসলমানদের ওপর বাড়াবাড়ি রকমের নির্যাতনের জন্য ইতিহাসে সে খ্যাত হয়ে আছে। বদর যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর হাতে সে বন্দি হয় এবং রাসুলুল্লাহ (সা.) এর নির্দেশে তাকে হত্যা করা হয়। উম্মে কুলসুম (রা.) তখন মক্কায়। পাষ- বাবার হত্যার খবর শোনার পর তার চোখ থেকে এক ফোঁটা পানিও পড়েনি বলে ঐতিহাসিকরা উল্লেখ করেছেন।
এমন ঘরেই জন্ম হয়েছিল হজরত উম্মে কুলসুমের। তিনি মক্কায় অল্প বয়সে পিতৃগৃহে থাকা অবস্থায় ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নেন এবং সেখানেই রাসুলুল্লাহ (সা.) এর হিজরতের আগে তাঁর কাছে বায়াত করেন। আল্লাহ ও রাসুলকে তিনি ভালোবাসতেন মা-বাবা ও অন্য সব মানুষের চেয়ে বেশি। আল্লাহ তায়ালা এ সম্পর্কে এরশাদ করেন,
‘বলো, তোমাদের বাবা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের গোত্র, তোমাদের সে সম্পদ, যা তোমরা অর্জন করেছ, আর সে ব্যবসা, যার মন্দা হওয়ার আশঙ্কা তোমরা করছ এবং সে বাসস্থান, যা তোমরা পছন্দ করছ, যদি তোমাদের কাছে অধিক প্রিয় হয় আল্লাহ, তাঁর রাসুল ও তাঁর পথে জিহাদ করার চেয়ে, তবে তোমরা অপেক্ষা করো  আল্লাহ তাঁর নির্দেশ নিয়ে আসা পর্যন্ত। আর আল্লাহ ফাসেক সম্প্রদায়কে হেদায়েত করেন না।’ (সূরা তওবা : ২৪)।
কেমন ছিল তার বাবা?
উকবা ইবনে আবি মুয়িত ছিল মক্কার মোশরেকদের অন্যতম সর্দার। সে কোনো সফর থেকে ফিরে এলে শহরের গণ্যমান্য লোকদের দাওয়াত করত। একবার নিয়ম অনুযায়ী সে শহরের গণ্যমান্য লোকদের দাওয়াত করল এবং রাসুল (সা.) কেও দাওয়াত করল। হুজুর (সা.) দাওয়াত গ্রহণ করলেন। তারপর হুজুর (সা.) এর সামনে খাবার উপস্থিত করল। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমি ততক্ষণ পর্যন্ত তোমার খাদ্য গ্রহণ করতে পারি না, যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি সাক্ষ্য না দাও যে, আল্লাহ এক, তাঁর কোনো অংশীদার নেই এবং আমি তাঁর রাসুল।’
উকবা দেখল, রাসুল (সা.) যদি না খায়, তাহলে তার সম্মান নষ্ট হয়ে যাবে। এজন্য সে কালেমা উচ্চারণ করল এবং রাসুল (সা.) শর্ত অনুযায়ী খাদ্য গ্রহণ করলেন।
উবাই ইবনে খালফ ছিল উকবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সে যখন উকবার ইসলাম গ্রহণের কথা জানতে পারল, তখন খুবই রাগান্বিত হলো। উকবা ওজর পেশ করল যে, কোরাইশ বংশের সম্মানিত অতিথি আমার গৃহে আগমন করেছিলেন। তিনি খাদ্য গ্রহণ না করে ফিরে যাওয়াটা আমার জন্য অপমান। তাই আমি এ কালেমা উচ্চারণ করেছি। উবাই বলল, আমি এ ওজর কবুল করব না, যে পর্যন্ত তুমি মুহাম্মদ (সা.) এর মুখে থুথু নিক্ষেপ না করবে। হতভাগা তার বন্ধুর কথায় এ ধৃষ্টতা প্রদর্শনে সম্মত হলো। এ ব্যাপারে উল্লিখিত আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। এ দুইজনের হাশরের দিন একই অবস্থা হবে, তখন উকবা বলবে, ‘হায়! আমি যদি উবাই এর বন্ধু না হতাম, মুহাম্মদের কথা মানতাম, তাহলে আমার এ অবস্থা হতো না।’ (তাফসিরে কাবির : ২৪/৭৫)।
বরকতম-িত হিজরত
হুদায়বিয়ার সন্ধির অব্যবহিত পরে মদিনায় হিজরতের সুযোগ আসে হজরত উম্মে কুলসুম বিনতে উকবা (রা.) এর জীবনে। মক্কা থেকে পালিয়ে মদিনায় উপস্থিত হন তিনি। হুদায়বিয়ার সন্ধির একটি শর্ত ছিল, মক্কার কেউ ইসলাম গ্রহণ করে মদিনায় গেলে তাকে ফেরত পাঠাতে হবে। উম্মে কুলসুম (রা.) মদিনায় পৌঁছার দুই দিন পর তার দুই সহোদর ওয়ালিদ ও উমারা ইবনে আকবা তাকে ফেরত দানের দাবি নিয়ে মদিনায় রাসুলুল্লাহ (সা.) এর কাছে পৌঁছে। তখন নিম্নোক্ত আয়াতটি নাজিল হয়।
‘হে মোমিনরা! তোমাদের কাছে মোমিন নারীরা হিজরত করে এলে তাদের পরীক্ষা করবে; আল্লাহ তাদের ঈমান সম্পর্কে অবগত আছেন। যদি তোমরা জানতে পারো যে, তারা মোমিন তবে তাদেরকে কাফেরদের কাছে ফেরত পাঠাবে না। মোমিন নারীরা কাফেরদের জন্য বৈধ নয় এবং কাফেররা মোমিন নারীদের জন্য বৈধ নয়। কাফেররা যা ব্যয় করেছে, তা তাদের ফিরিয়ে দাও। অতঃপর তোমরা তাদের বিয়ে করলে তোমাদের কোনো অপরাধ হবে না যদি তোমরা তাদের মোহর দাও। তোমরা কাফের নারীদের সঙ্গে দাম্পত্য সম্পর্ক বজায় রেখো না। তোমরা যা ব্যয় করেছ, তা ফেরত চাইবে এবং কাফেররা ফেরত চাইবে, যা তারা ব্যয় করেছে। এটাই আল্লাহর বিধান; তিনি তোমাদের মধ্যে ফয়সালা করে থাকেন। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে যদি কেউ হাতছাড়া হয়ে কাফেরদের মধ্যে থেকে যায় এবং তোমাদের যদি সুযোগ আসে তখন যাদের স্ত্রীরা হাতছাড়া হয়ে গেছে তাদের, তারা যা ব্যয় করেছে তার সমপরিমাণ অর্থ প্রদান করবে। ভয় করো আল্লাহকে, যার প্রতি তোমরা ঈমান এনেছ।’
(সূরা মুমতাহিনা : ১০-১১)।
ওই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর রাসুল (সা.) উম্মে কুলসুম (রা.) কে তার ভাইয়ের হাতে অর্পণ করতে অস্বীকার করেন। তিনি তাদের বলেন, ‘শর্ত ছিল পুরুষের সম্পর্কে, স্ত্রীলোকদের সম্পর্কে নয়।’ (ইসতিআব : ৪/৪৬৫)।
হজরত উম্মে কুলসুম (রা.) এর মদিনায় হিজরতের ঘটনাটি বেশ চমকপ্রদ ও বিস্ময়কর। বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়, তিনি একাকী মক্কা থেকে বের হন এবং পথে খুজাআ গোত্রে এক ব্যক্তিকে সঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করেন। হেঁটে, মতান্তরে উটের পিঠে চড়ে মদিনায় পৌঁছেন। একমাত্র উম্মে কুলসুম (রা.) ছাড়া অন্য কোনো কোরাইশ মহিলা ইসলাম সহকারে একাকী আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের দিকে হিজরত করেননি। (তাবাকাতে ইবনে সাআদ : ৮/২৩০)।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, হুদায়বিয়ার সন্ধিচুক্তির যে ধারাতে মক্কাবাসীদের ফেরত দানের কথা ছিল, তাতে শুধু পুরুষের কথা উল্লেখ ছিল, মহিলাদের সম্পর্কে কোনো কথা ছিল না। অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সা.) উম্মে কুলসুম (রা.) এবং তার পরে যেসব নারী মদিনায় এসেছেন, তাদের সবাইকে এ আয়াতের আলোকে পরীক্ষা করেছেন। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) কে প্রশ্ন করা হলো, নারীদের পরীক্ষা করার রাসুলুল্লাহ (সা.) এর পদ্ধতি কী ছিল? আব্বাস (রা.) বললেন, তিনি মদিনায় আগত মহিলাদের এভাবে শপথ করাতেনÑ আল্লাহর কসম! স্বামীর প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষবশত আমি ঘর থেকে বের হইনি।
আল্লাহর কসম! এক জমিন থেকে অন্য এক জমিনের প্রতি আকর্ষণবশত বের হইনি। আল্লাহর কসম! পার্থিব কোনো লোভ-লালসাবসত ঘর ত্যাগ করিনি। আল্লাহর কসম! শুধু আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.) এর মহব্বতে ঘর ত্যাগ করেছি।’ (মুখতাসার তাফসির ইবনে কাসির : ৩/৪৮৫; সিরাত ইবনে হিশাম : ২/৩২৫; সিয়ারু আলামিন নুবালা : ২/২৭৬)। উপরোক্ত ঘটনার মাধ্যমে উম্মে কুলসুম (রা.) এর তীক্ষè বুদ্ধিমত্তা ও দৃঢ় ঈমানের পরিচয় পাওয়া যায়। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁকে কেন্দ্র করে ইসলামী শরিয়তের অনেক বিশেষ বিধান জারি করেন। এটি তার জন্য এক বিশেষ মর্যাদার বিষয়।
শুভ পরিণয়
মদিনায় আসার পর প্রখ্যাত চারজন সাহাবি তাকে বিয়ের পয়গাম পাঠান। তারা হলেন, জুবায়ির ইবনুল আওয়াম, জায়িদ ইবনে হারিসা, আবদুল রাহমান ইবনে আউফ ও আমর ইবনুল আস (রা.)। তিনি বৈপিত্রেয় ভাই ওসমান ইবনে আফ ফান (রা.) এর সঙ্গে পরামর্শ করেন। ওসমান (রা.) তাকে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর সঙ্গে পরামর্শ করতে বলেন। তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.) এর কাছে যান এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য তার পরামর্শ চান। রাসুল (সা.) তাকে বলেন, তুমি জায়িদ ইবনে হারিসাকে বিয়ে করো। তোমার জন্য ভালো হবে। তিনি জায়িদকে বিয়ে করেন।
হজরত জায়িদ (রা.) মুতার যুদ্ধে শহীদ হলেন। অতঃপর হজরত জুবায়ির ইবনুল আওয়াম (রা.) তাকে বিয়ে করেন। পরবর্তীতে তাদের ছাড়াছড়ি হয়ে যাওয়ার পর হজরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা.) তাকে বিয়ে করেন। আবদুর রহমান রোগাক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন। তখন হজরত আমর ইবনুল আস (রা.) তাকে বিয়ে করেন। তার ঘরেই হজরত আলী (রা.) এর খেলাফতকালে তিনি ইন্তেকাল করেন। (তাহজিবুত তাহজিব : ১২/৪৭৭; আনসাবুল আশরাফ : ১/৪৭১)। সুত্রঃ আলোকিত বাংলাদেশ ।

Logo-orginal