, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

admin admin

অধ্যাপক মাওলানা ফখর উদ্দীন (রহ): আব্বা হুজুরের আদর্শই আমার অনুপ্রেরণা

প্রকাশ: ২০১৭-০৫-২৭ ১৬:৪৯:১৫ || আপডেট: ২০১৭-০৫-২৭ ১৬:৪৯:১৫

Spread the love
অধ্যাপক মাওলানা ফখর উদ্দীন (রহ): আব্বা হুজুরের আদর্শই আমার অনুপ্রেরণা
অধ্যাপক মাওলানা ফখর উদ্দীন (রহ): আব্বা হুজুরের আদর্শই আমার অনুপ্রেরণা

মোহাম্মদ ইমাদ উদ্দীন

শায়খুল হাদীস আল্লামা ফখর উদ্দীন (রহ:) আমার শ্রদ্ধেয় পিতা।আমি এই পরিবারে জন্ম গ্রহণ করায় মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি। আব্বু জীবনের অর্ধেকের চাইতে বেশী ঢাকা সিলেট অতিবাহিত করেন।তাঁর সুযোগ্য ছেলে হওয়ায় বিশেষ করে তিনি সিলেট আলিয়া মাদ্রাসা থেকে অবসরের পর হতে ইন্তিকালের পূর্ব মূহূর্ত পর্যন্ত তাঁকে জানার অনেক সুযোগ হয়েছে। তিনি উত্তম আদর্শ ও অনুপম চরিত্রের অধিকারী সুমহান ব্যক্তিত্ব ছিলেন। নম্রতা ও বিনয়বনতা, দানশীলতা, তাকওয়া ও পরহেজগারী এবং আশেকানে রাসূল প্রভৃতি গুণাবলীতে তিনি ছিলেন অনন্য ও অসাধারণ।তিনি দান করতেন গোপনে, প্রকাশ্যে, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে।

আমার বাবা কাউকে কষ্ট দিতে চাইতেন না, আর লোক দেখানো কোন কিছু করতেন না। যা কিছু করতেন আল্লাহর ওয়াস্তে  করতেন সব সময় আল্লাহকে ভয় করতেন। ব্যবহার ছিল অমায়িক, সুমধুর এবং নিরহংকার। কোন দিন তিনি বংশীয় ঐতিহ্য এবং ইলমের বাহাদুরী করতেন না। যে কেউ তাঁর সাথে যে কোন ধরনের কথা বলতে পারতেন, এতে তিনি বিন্দুমাত্র বিরক্তিবোধ করতেন না। উনি খুব সহজ সরল একজন মানুষ ছিলেন।দুনিয়াবী প্যাঁজ পোঁজ তিনি বুঝতেন না তেমন নয়, বুঝলেও ওসব তেমন পাত্তা দিতেন না। সব সময় বলতেন তোমরা কারো সাথে বেয়াদবি করবে না। কোনো মানুষ সমালোচনা উর্ধ্বে নয়। কথা আছে না মানুষের সমালোচনা থেকে স্বয়ং আল্লাহও বাঁচতে পারে না।যেমন রোদ-বৃষ্টি বেশী হলেও বলে, এত বেশী কেন? কম হলে বলে কম কেন? তেমনি তিনিও কম সমালোচিত ছিলেন না। এমন কি তিনি চুনতী হাকীমিয়া আলিয়া মাদ্রাসায় যোগদান করায় এলাকার কিছু অশিক্ষিত লোক নবীর আশেক পরিচয়ে তাঁর বিরুদ্ধে যড়ষন্ত্র এবং সমালোচনা করতে দ্বিধা করে নাই!

কিন্ত্ত সামনা সামনি “টু” বলার সাহস কারো ছিল না। তিনিও ভালো করে বুঝতে পারতেন, “সামনে যত ভক্তি, পিছনে থাকতো কটুক্তি”।কিন্তু গহীন পানির মাছের মত দেখেও না দেখতেন। যাক সমালোচিত হওয়াও এক রকম ভালো। হাদীসের ভাষায় যার সমালোচনা করা হয় তার পাপ সমূহ সমালোচনা কারীদের আমল নামায় লিপিবদ্ধ হয়ে যায়।আমাদের উচিৎ তাদের পুরস্কৃত করা পাপ মুছে দেয়ার জন্য।কেউ যদি বড় দোষ করেও তাঁর কাছে ক্ষমা চাইতেন তাহলে ক্ষমা করে ভুলে যেতেন সব কিছু। তিনি সব সময় কুরআন, হাদীস, দালায়েলুল খায়েরাত ও দরুদ শরীফ পাঠে রত থাকতেন। তিনি বড়দের প্রতিযথোপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন এবং ছোটদের প্রতি স্নেহ করতেন। তিনি সত্য ভাষী, সহিষ্ণু, ধৈর্যশীল এবং অসাধারণ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন ছিলেন। লাজুকতায় তাঁর দৃষ্টি সব সময় নিম্নগামী হত। তিনি স্বীয় পিতার ন্যায় আচার ও অভ্যাসে আদর্শ নমুনা ছিলেন। তিনি রাসূল পাক (সাঃ) এর প্রতি গভীর ভালবাসা এবং গাউসুল আযম হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ) সহ অন্যান্য অলীয়ে কেরাম গণের প্রতি ভক্তি এবং শ্রদ্ধা তাঁর জীবনের উন্নত ভূষন। ইসলাম ও শরীয়তের সুরক্ষায় এবং রাসূল পাক (সাঃ) এর মান সম্মান সমুন্নতা রাখার ব্যাপারে আমার আব্বু সব সময় নির্ভীক ভূমিকা পালন করেন। তিনি  ইসলামী আইন চর্চার ও সত্য প্রতিষ্ঠায় অকুতোভয় সৈনিক ছিলেন। তিনি অতিথি পরায়ন ছিলেন। অসংখ্য লোক তার সাথে সাক্ষাতের জন্য এবং বিভিন্ন মাসআলা সম্পর্কে জানার জন্য আগমন করতেন। তিনি তাদেরকে বিনা মেহমানদারীতে ফিরিয়ে দিতেন না। কারো  উপহার লাভের লোভ তাঁর মধ্যে ছিল না।তিনি অত্যন্ত স্বল্পহারী ছিলেন।তবে সামান্য মুখরোচক খাবার তিনি পছন্দ করতেন।তিনি কোনদিনই তার পরিমাণের বেশী খেতেন না। তবে, চা এক কাপ বেশী দিলে তিনি সাধারণত তা না করতেন না।তিনি দুধ চা চইতে রং চা বেশী পছন্দ করতেন। চনাচুর, মুড়ি, বেলা ও টোস্ট বিস্কুট আব্বুর প্রিয় ছিল।তিনি দই পছন্দ করতেন বিধায় তাঁর বাড়িতে প্রায় সময় দই থাকত।আব্বু ঘি দিয়ে দুধ ভাত খেতে পছন্দ করতেন। তিনি ঝাল তরকারী বেশী পছন্দ করতেন এবং পাশাপশি শুটকিও। দেশীয় পিঠা, এমন কি শীত পিঠা বেশী পছন্দ করতেন এবং শখ করে খেতেন।তিনি মাত্রা অনুযায়ী পানও খেতেন।তাঁর চলাফেরা ছিল অত্যন্ত সাধারণ। জাঁকজমকপূর্ণ মূল্যবান বস্ত্র তিনি কখনো পরিধান করতেন না।তাঁর ব্যবহার্য বস্ত্রাদি তিনি নিজেই ধুতেন।ছেঁড়া কাপড় নিজেই সেলাই করে পরিধান করতেন।নিজের কাজ নিজেই করতেন। তাঁর সন্তান-সন্ততি থাকা সত্ত্বেও নিজেই বাজারে গিয়ে পরিবারের জন্য বাজার করে নিয়ে আসতেন। আরাম ও বিলাসিতাকে তিনি ঘৃণা করতেন।

 

তিনি সব সময় সুগন্ধী (আতর) ব্যবহার করতেন। সাহবায়ে কেরামের আড়ম্বরহীন সহজ সরল জীবনই তাঁর অত্যন্ত পছন্দের ছিল এবং তাঁদের অনুসরণ করেই তিনি জীবন অতিবাহিত করার চেষ্টা করতেন।তিনি গৃহস্থালী কাজেও অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন।তিনি জমির আগাছা পরিষ্কার, বীজক্ষেত তৈরী, নানা ফল গাছ চারা রোপণ ও পরিচর্যা,সার দেয়া, গ্রামে ঘরের চারপাশে সীমানা দেয়া, মহিলাদের গোসলের ব্যবস্থার জন্য নিজেই জল ঘাট নির্মাণ সহ ইত্যাদি কাজ অত্যন্ত সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতেন। এমন কি আব্বার ওফাতের ৩ দিন আগে আমাকে সাথে নিয়ে জলঘাটটি মেরামেত করেন।

 

এসব কাজে তিনি অত্যন্ত আনন্দ পেতেন এবং পরিবারকেও এসব কাজ করার উৎসাহ যোগাতেন।তবে এসব কাজ করার সময় আমি তাঁকে সঙ্গ দিতাম। তিনি রাজনীতির সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত কিংবা দলীয় রাজনীতিবিদ ছিলেন না। কিন্ত রাজনীতিতে তাঁর জ্ঞান ছিল প্রখর ও বাস্তবভিত্তিক।  তাঁর একটা ছোট্ট রেডিও ছিলো। তিনি রেডিওতে খবর শুনতেন। নিয়মিত বিভিন্ন পত্রিকা পড়তেন এবং রাজনীতির অত্যন্ত খুটিনাটি বিষয়েও খোঁজ-খবর রাখতেন। তিনি যখনই সিলেট থেকে বাড়ীতে আসতেন তখনই আমার চুল ন্যাড়া করে দিত। তাও আবার নিজ হাতে!!!! আলিমে অধ্যয়নত থাকাবস্থায়ও  আমার চুল তাঁর হাত থেকে রক্ষা পায় নি। চুল ন্যাড়া করার পর আমার সাথে মজা করত “ডাবু ডাবু চেরানা, চাবি দিলে ঘুরেনা”।  এই সব এখনো মনে পড়ে।

 

২০০৯ সালে আমি যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হই।একদিন ক্লাসে ড. আহসান সাইয়্যেদ স্যার (বর্তমান ভিসি, ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয়) আমার পরিচয় জানতে চাইলে চুনতীর মাদ্রাসার কিছু বন্ধু আমার পরিচয় দিয়ে দেয়।আব্বু সিলেট আলিয়া মাদ্রাসা থেকে অবসর নেয়ার পর চুনতী হাকীমিয়া মাদ্রাসায় শায়খুল হাদীস হিসেবে র্কমরত থাকায় তারা আব্বুকে চিনে ও জানে। যাই হোক স্যার আমার আব্বুর নাম শুনার পর কিছুক্ষণ নিরব থাকেন।

এরপর পুরো ক্লাস আমাকে দাড় করিয়ে আব্বুর সম্পর্কে বলতে লাগলেন। ইনি বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ আলেম ও উচুঁ মানের হাদীস বিশারদ। ইনি শুধু বাংলাদেশেই নয় বরং উপমহদেশের সকল ইসলামী চিন্তাবিদ ও আলেম ওলামাদের নিকট সমধিক পরিচিত। তাঁর সুন্দর, সহজ, ও ব্যতিক্রমী শিক্ষাদান পদ্ধতি দেশে বিদেশে সমাদৃত হয়েছে। তিনি হাজার হাজার মুহাদ্দিস, মুফাস্সির, মুফতি, প্রফেসর, ডক্টর গণের ওস্তাাদ। তাঁর ছাত্র এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকাসহ অনেক দেশে প্রতিষ্ঠিত আছেন। তখন আমার মাথা গর্বে উচুঁ হয়ে গেল।সত্যি এই রকম বাবা পাওয়াটাই ভাগ্যের ব্যাপার। যখন স্যার আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল “তুইতো তুর বাবার মত হতে পারলি না” তখন আমার মাথা নিচু করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। স্যার বলল শুধু তুই কেন??? কেউ উনার মত হতে পারবে না এবং ভবিষ্যতে এই রকম আলেম জন্মাবে কিনা সন্দেহ!!!!

 

সেদিন ছিল ২৬ শে মে ২০১১/২১ জমাদিউস সানি ১৪৩২ হিজরি রোজ বৃহস্পতিবার দুপুরে বুখারী শরীফের দাওয়াতে বোয়ালখালীতে গমন করেন এবং দাওয়াতে অংশগ্রহণ কারী আলেমদের কাছে শুনেছি তিনি সেদিন ইমাম বুখারী ও সহী বুখারী শরীফের ফজিলত ও মহাত্মের উপর মূল্যবান বক্তব্য রাখেন। বিকেলে তিনি স্বীয় গৃহে ফিরেন।স্বাভাবিকভাবে তিনি প্রত্যেক দিনের মত তাঁর কার্যকালাপ শেষ করেন। হঠাৎ রাত ৯.০০দিকে খারাপ লাগলে তাঁকে স্থানীয় চন্দনাইশ মেডিকেল নিয়ে যেতে চেষ্টা করলে তিনি যান নি। তিনি নিজে নিজে দরুদ শরীফ, কলেমা পাঠ করেন। সেদিন দিবাগত রাত ১২.১৫ মিনিটে অল্লাাহু আকবর বলে তাঁর প্রভুর ডাকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

 

পরে তাঁকে আমাদের পারিবারিক কবরস্থান মাওলানা মঞ্জিলে দাফন করা হয়।মৃত্যুর আগে আব্বুর চেহারায় কোন কষ্ট দেখে নি। তবে জান যাওয়ার আগে তাঁর মুখ থেকে কিছু ফেনা বের হয়। আব্বুর ইন্তিকালের দৃশ্য আমার এখনো মনে পড়ে। আব্বুকে এত তাড়াতাড়ি হারিয়ে ফেলব তা কোন দিন ভাবিনি। যে হারে সেই বুঝে সেটা কত কষ্টকর।বাবা হারনোর বেদনা আমাকে প্রতি মূহূর্ত কাঁদায়। আল্লাহ পাক আমার শ্রদ্ধেয় আব্বাজানকে আন্বিয়া, সোলাহা ও শুহাদার সাথে জান্নাতুল ফেরদাউসের আলা ইল্লিয়িনে মর্যাদাপূর্ণ স্থান নসীব করুন।

 

সত্যি  তিনি একজন মহান বন্ধু, বাবা ও শিক্ষক। ইতিহাসে তিনি অস্লান ও বিরল ব্যক্তিত্ব হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবেন। তাঁর জীবন ছিল সত্যিকারভাবে মানবতার কল্যাণে নিবেদিত। তাই এ দেশের মানুষের মনের মণিকোঠায় তিনি বেঁচে থাকবেন। তিনি এমন একজন মানুষ , যাঁর জ্ঞানের পরিধি সুবিস্তৃত ও সুবিশাল। শিক্ষক সমাজে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সম্মানিত ও শ্রদ্ধাভাজন একজন আদর্শ শিক্ষক। ছাত্র সমাজের কাছে একজন প্রাণপ্রিয় মান্যবর ওস্তাাদ আর সাধারণ জনগণের কাছে সম্মানিত, মান্যগণ্য ব্যক্তিত্ব।

 

লেখক: শায়খুল হাদীস প্রফেসর আল্লামা ফখর উদ্দীন (রহ:)’র তৃতীয় পুত্র

Logo-orginal