, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

admin admin

আরকানে মুসলমানদের বর্বর গণহত্যার নায়ক কুখ্যাত জেনারেল মিন অং লাইং

প্রকাশ: ২০১৭-০৯-১৫ ১৯:২৬:২৭ || আপডেট: ২০১৭-০৯-১৫ ১৯:২৬:২৭

Spread the love
আরকানে মুসলমানদের বর্বর গণহত্যার নায়ক কুখ্যাত জেনারেল মিন অং লাইং
আরকানে মুসলমানদের বর্বর গণহত্যার নায়ক কুখ্যাত জেনারেল মিন অং লাইং

আরটিএমনিউজ২৪ডটকম, নিউজ ডেস্কঃ  শান্তিতে নোবেল জয়ী অং সান সু চি মূলত তার সরকারের পুতুলপ্রধান। গণতন্ত্রের আড়ালে প্রকৃত ক্ষমতার চর্চা করেন ২০১১ সালে কমান্ডার ইন চিফের দায়িত্বপ্রাপ্ত মুসলিম-বিদ্বেষী জেনারেল লাইং।

মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গা গণহত্যার সেই মূল হোতা হল  দেশটির সামরিক বাহিনী প্রধান কুখ্যাত জেনারেল মিন অং লাইং।

 

সুচি স্টেট কাউন্সিলর হলেও কার্যত মিয়ানমারের ১১ সদস্য-বিশিষ্ট জাতীয় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা পরিষদের ৬ সদস্যই সেনাবাহিনীর প্রতিনিধি হওয়ায় তার পক্ষে স্বাধীনভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া অসম্ভব।

উপরন্তু, জাতিগত নিধনে মত্ত হয়ে পড়া দেশটির প্রধান তিন উইং স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও সীমান্ত বিষয়ক মন্ত্রণালয় সেনাবাহিনীর হাতে থাকায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সামরিক জান্তাকে এড়িয়ে জনবান্ধব কিছুই করতে পারেন না। যদিও রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা নির্যাতন ও গণহত্যা অতীতের সকল সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার পর খুনি মানসিকতার সামরিক জান্তার বিষয়টি অনেকটাই চাপা পড়ে আছে অং সান সুচির কথিত গণতান্ত্রিক সরকারের আড়ালে।

এই হত্যাকাণ্ড ইস্যুতে শান্তিতে নোবেলজয়ী অং সান সু চি’র সম্প্রতি করা মন্তব্য অনেককেই ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ করেছে। হাজার হাজার মানুষকে হত্যা, শত শত নারীকে ধর্ষণ এবং সেই গণহত্যা-ধর্ষণ থেকে পালিয়ে বাঁচতে লাখ লাখ মানুষের দেশান্তরী হওয়ার প্রেক্ষাপটে সরকারের পক্ষে সু চি সাফাই গাওয়ায় সেই ক্ষোভ-ক্রোধ স্বাভাবিকই হওয়ার কথা।

কিন্তু সারাবিশ্বের শান্তিকামী মানুষ এমনটা ভাবলেও আরাকান থেকে বিড়াড়িত রোহিঙ্গাদের মন ও মানসে কেবল সামরিক জান্তারই ভয়। আর সু চি যেনো তাদের ঘরের মেয়ে। সেনাবাহিনী তার পিতাকে হত্যা করেছে। সেই বাহিনীর কথা না শুনে আর কী উপায় তার?

মিয়ানমারে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র পুনর্প্রতিষ্ঠায় আন্দোলনরত সংগঠন বার্মা ক্যাম্পেইন ইউকে’র পরিচালক মার্ক ফার্মানারও ক্ষোভ-ক্রোধের আঙ্গুল তুলছেন মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ মিন অং লাইংয়ের দিকে। দেশটিতে নিষিদ্ধ বার্মা ক্যাম্পেইনের পরিচালক মনে করেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এ প্রধানই নেতৃত্ব দিচ্ছেন জাতিগত নিধনযজ্ঞে।

গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষে দীর্ঘ সময় আন্দোলন করেও শান্তিতে নোবেলজয়ী সু চি কেন এখন গণহত্যাকারী বাহিনীর পক্ষে সাফাই গাইছেন? উত্তর না পাওয়ার হতাশায় সে প্রশ্ন উবে দিয়ে ফার্মানার তুলে ধরছেন গণহত্যার পেছনের হোতা অং লাইংয়ের চরিত্র।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী একটি সংবাদমাধ্যমে লেখা নিবন্ধে ফার্মানার বলেছেন, গত ২৫ আগস্ট রাখাইনের একটি থানায় সন্ত্রাসী হামলার অযুহাত তুলে সেনাবাহিনীকে জোরদার অভিযানে নামান কমান্ডার ইন চিফ লাইং। ওই আগ্রাসী অভিযান শুরুর পর ৪ লাখ রোহিঙ্গা পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে। প্রবাসী রোহিঙ্গা ও রাখাইনে অবস্থানরতদের ভাষ্য অনুযায়ী, সেনাবাহিনীর সহিংস অভিযানে এবার লাখেরও বেশি মানুষ বাস্তুহারা হয়েছে। গণহত্যার শিকার হয়েছে অন্তত ৫ হাজার মানুষ।

স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্য অনুযায়ী, অভিযানের নামে ভয়ঙ্করভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়ে চলেছে রাখাইনে। চলছে হত্যা, শিরশ্ছেদ, লোকজনকে ঘরে বন্দি করে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা, নির্বিচারে ধর্ষণ। এমনকি শিশুরাও সেনাবাহিনী, নিরাপত্তা বাহিনী, সরকার সমর্থক সশস্ত্র গোষ্ঠী ও দাঙ্গাবাজদের সহিংস আক্রমণ থেকে রেহাই পাচ্ছে না। সেজন্য রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীর অভিযানকে ‘পাঠ্যবইয়ের জাতিগত নির্মূল অভিযানের নৃশংস উদাহরণ’ বলে জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনের প্রধান জেইদ রাদ আল হুসেইনের করা মন্তব্য কাউকে অবাক করেনি।

কিন্তু এই গণহত্যায় যখন বিশ্ব সম্প্রদায় মিয়ানমারের ‘ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর’ বলে পরিচিত সু চি’র দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তোলে, তখন আড়ালে বেঁচে যাওয়ার সুযোগ পান মূল হোতা। গণহত্যার নেতৃত্বদাতা লাইং তখন আড়ালে হাসেন, তিনি যে এটাই চাইছেন। বিশ্ব আরও বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ুক সু চিকে নিয়ে, আর তিনি আরও বেশি নাঙ্গা হাতে আরও ভয়ঙ্করভাবে অভিযান চালিয়ে যাবেন একটি জাতিকে পুরোপুরি নির্মূল করতে।

সু চি এক তরফা সমালোচনার শূলে চড়লেও বাস্তবতা হলো—সামরিক বাহিনীর সংশোধিত সংবিধান অনুযায়ী সশস্ত্র বাহিনীর ওপর তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, এমনকি তিনি বর্তমান সরকারের স্টেট কাউন্সেলর বা কার্যত প্রধান হলেও। সামরিক বাহিনী তার বেসামরিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের সরকারের থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন। বরং সেনাবাহিনীই নিয়ন্ত্রণ করে পুলিশ, অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনী, কারাগার, সীমান্ত সমস্যা ও অন্যান্য বেসামরিক সংস্থা-দফতর। এমনকি সংসদেও ২৫ শতাংশ প্রতিনিধিত্ব আছে সরাসরি সেনাবাহিনীর। সাবেক সেনা কর্মকর্তার প্রতিনিধিও আছে ঢের। সামরিক বাহিনীর কর্তৃত্ব কমাতে সু চি’র সরকার সংবিধান সংশোধনে উদ্যোগ নিলেও পারবে না। কারণ সংবিধান সংশোধনে দরকার ৭৫ শতাংশ সংসদ সদস্যের ভোট। এই অবস্থায় সেনাবাহিনীর প্রতিনিধিরা ভেটো দিলেই আটকে যায় যে কোনো উদ্যোগ। অর্থাৎ প্রকাশ্যে সু চি’র ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) সরকার চালালেও দ্বিতীয় সরকার চালায় সামরিক বাহিনী, বন্দুকবাজ সরকার।

কমান্ডার ইন চিফ লাইংকে এখন বর্বর পারিয়াহ’র সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে, যারা কিনা দলিত জনগোষ্ঠীকে হিংস্র আক্রমণে নিঃশেষ করে দিতে চায়। বিশ্বের সবচেয়ে নিকৃষ্ট মানবাধিকার লঙ্ঘনের রেকর্ড করা একটি বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন লাইং। তাদের সহিংসতা এমন পর্যায়ে গেছে যে, চলতি সামরিক আগ্রাসন শুরুর আগেই লাইংয়ের নেতৃত্বাধীন বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের তদন্ত শুরু করে জাতিসংঘ। মিয়ানমারে গত বছর সু চি’র নেতৃত্বে রাজনৈতিক সংস্কার শুরু হওয়ার পরও সামরিক বাহিনী অভ্যন্তরীণ সংঘাতে জড়িয়েছে একাধিক রাজ্যে। রাখাইনের আগে তাদের হাতে রক্তাক্ত হয়েছে কাচিন ও শান রাজ্য, যেখানে প্রাণ গেছে শত শত বেসামরিক মানুষের।

স্পষ্টতই জাতিগত নিধনযজ্ঞের মূল অপরাধী লাইং। যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে তদন্তাধীন এই জেনারেলই মিয়ানমারের রাজনৈতিক সংস্কারের সবচেয়ে বড় অন্তরায়। অথচ আশ্চর্যজনকভাবে তাকে কোনো আন্তর্জাতিক চাপে পড়তে হচ্ছে না, বরং বিশ্বনেতাদের আলিঙ্গনে সিক্ত হচ্ছেন লাইং।

যেমন গত অক্টোবরেই যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ওপর আরোপিত বেশিরভাগ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। এরপর ব্রিটিশ সরকার মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে একটি প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়। চলতি বছরের শুরুতেই লাইংকে জার্মানি ও অস্ট্রিয়াতে লাল-গালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হয়। তার আগে তাকে নেওয়া হয় ইতালিত। লাইংকে সেসব দেশে সামরিক প্রশিক্ষণের আলোচনায় অতিথি করা হয়, পরিদর্শন করানো হয় সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহের কারখানাগুলো। এমনকি ইউরোপীয় দেশগুলো তাদের সামরিক বাহিনীর প্রধানদের সম্মানজনক বার্ষিক সভায়ও ভাষণ দেওয়ার সুযোগ করে দেয় গণহত্যায় অভিযুক্ত এই জেনারেলকে।

কেবল ইউরোপে নয়, যে এশিয়ায় লাইং বিতর্কিত, সেই মহাদেশরই রাষ্ট্র ভারত ও জাপান তিনি সফর করেন চলতি বছর, এমনকি দু’দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকও করেন। রোহিঙ্গা জাতিকে নির্মূল করার অভিযান শুরুর প্রাক্কালেই তিনি থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়াদি নিয়ে বৈঠক করেন।

এটা স্পষ্ট যে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভয়ানক রেকর্ড থাকা সত্ত্বেও জেনারেল লাইং রোহিঙ্গা নির্মূল অভিযান শুরুর সাহস করেছেন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ‘আলিঙ্গন’র এসব যোগ-বিয়োগ করেই। তিনি হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছেন এবং এখন পর্যন্ত তার যোগ-বিয়োগই সঠিক বলে প্রমাণ হচ্ছে।

ফার্মানারের বক্তব্য, এমনটা চলতে পারে না। এই অবস্থা অবশ্যই বদলাতে হবে। দায়মুক্তি পেয়ে যাবেন বলে লাইংয়ের যে ধারণা, সেটা মিথ্যা প্রমাণ করতে হবে। সব পথ খোলা — কূটনেতিক, আইনি, অর্থনৈতিক — লাইংয়ের বিরুদ্ধে চাপ প্রয়োগ করতে এই সব উপায় অবলম্বন করতে হবে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে বিশ্ব সম্প্রদায়ের সবরকমের সহযোগিতা ও প্রশিক্ষণ দেওয়া বন্ধ করতে হবে এবং এ বিষয়ে স্পর্শকাতর সম্পৃক্ততার নীতি গ্রহণ করতে হবে। লাল-গালিচার বদলে লাইংয়ের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে। জাতিসংঘকে মিয়ানমারের ওপর বৈশ্বিক অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হবে। তার আগেই সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করে ফেলতে হবে। সামরিক বাহিনীর অস্ত্র-সরঞ্জামে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য খাতেও নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হবে। নিষেধাজ্ঞার লক্ষ্যবস্তু করতে হবে সামরিক বাহিনী পরিচালিত কোম্পানিগুলোকে। প্রয়োজনে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের দ্বারস্থ হতে পারে।

কেননা, ল্যান্ড মাইনে রোহিঙ্গা নিধন, রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন খনিতে কৃতদাসের মতো খাটানো, সম্পত্তি, ধর্মপালন, শিক্ষা, চিকিৎসার মতো অধিকার বঞ্চিত করে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন ইত্যাদি ইস্যুতে আইনি লড়াইয়ের ভিত্তি পাওয়া খুবই সহজ হবে। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে তাই জাতিগত নিধনযজ্ঞ বন্ধে লাইংকে থামাতে দরকার কেবল রাজনৈতিক সদিচ্ছা। রোহিঙ্গাসহ অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর বেঁচে থাকা এবং সত্যিকারার্থে মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক প্রেক্ষাপট তৈরি নির্ভর করছে এই সদিচ্ছার ওপরই।

সু চি বা তার এনলডি অথবা মিয়ানমারের অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব কি পারবেন সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে এই সদিচ্ছা দেখাতে? সুত্রঃ ইন্টারনেট।

Logo-orginal