, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

admin admin

কেউ কেউ খাচ্ছে, কেউ কেউ তাকিয়ে রয়েছে

প্রকাশ: ২০১৭-০৯-২০ ০৮:৫৯:২০ || আপডেট: ২০১৭-০৯-২০ ০৮:৫৯:২০

Spread the love

কেউ কেউ খাচ্ছে, কেউ কেউ তাকিয়ে রয়েছে
কেউ কেউ খাচ্ছে, কেউ কেউ তাকিয়ে রয়েছে

অঝোর ধারায় বৃষ্টি। জোয়ারের পানিতে ভাসছে চারপাশ। বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ছে। হঠাৎ পাকা সড়কের মাঝখানে ১০ ফুটের মতো ভেঙে গেল। কয়েকজন রোহিঙ্গা নারী পড়ে গেলেন পানিতে। প্রত্যেকের কোলে দুধের শিশু। সারা রাত বৃষ্টিতে ভিজে চিৎকার করার শক্তিও নেই। তীব্র স্রোতের মধ্যে কয়েকজন নেমে তাদের কোনোরকমে উদ্ধার করলেন। বোরকা পরা রোহিঙ্গা নারীরা আর পারলেন না। বোরকা খুলে কাঁদতে লাগলেন। শিশুরা ভয়ে চেঁচাতে লাগল। একটু পরই সেখানে কলা-রুটি নিয়ে পৌঁছল ত্রাণবাহী একটি গ্রুপ। সামান্য এই খাবার সবাই পেল না। কেউ কেউ খাচ্ছে, কেউ কেউ তাকিয়ে রয়েছে। সচিত্র প্রতিবেদন আমাদের সময় পত্রিকার ।

 

গতকাল সকাল ৯টার চিত্র এটি। টেকনাফ সদর থেকে শাহপরীর দ্বীপে ঢোকার আগে চোখে পড়ে এমন দৃশ্য।

বৃষ্টি-কাদায় মাখামাখি রোহিঙ্গা শরণার্থীরা গতকালও এই পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যাচারের হাত থেকে বেঁচে এলেও গত দুদিনের বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত নতুন আসা শরণার্থীরা। টেকনাফ-উখিয়ার বর্তমান বৈরী আবহাওয়ায় রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনায় বড় ধাক্কা লেগেছে। শাহপরীর দ্বীপের আশপাশের বিভিন্ন স্থাপনায় আশ্রয় নিতে দেখা যায় নতুন আসা কোনো কোনো রোহিঙ্গা পরিবারকে। কেউবা দিন-রাত ভিজেই যাচ্ছে। এমনকি পাহাড়ের ঢালে অবস্থান নেওয়া অনেক শরণার্থীর ছাউনিঘর প্রায় ডুবে গেছে। ভিজে গেছে ত্রাণের খাবারসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। আগে থেকেই খাদ্যাভাবে ভুগছে রোহিঙ্গাদের একটি অংশ। কোনো কোনো রোহিঙ্গা পরিবার আবার প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ত্রাণ মজুদ করেছে। ত্রাণ দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবেই এটা হচ্ছে বলে মনে করছেন রোহিঙ্গাদের সেবায় নিয়োজিত দেশি-বিদেশি স্বেচ্ছাসেবীরা।

সরকারি ব্যবস্থাপনায় ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ব্যক্তি ও সংগঠন নিজেদের উদ্যোগে বিচ্ছিন্নভাবে ত্রাণ বিতরণ করছে। সব মিলিয়ে প্রচুর ত্রাণ। কিন্তু বিতরণে অব্যবস্থাপনার কারণে সবার হাতে পৌঁছাচ্ছে না তা।

গতকাল শাহপরীর দ্বীপ ও উখিয়ার নতুন শরণার্থী ক্যাম্প ঘুরে দেখা গেছে, অনেক পরিবারই এক প্রকার না খেয়ে দিন পার করছে। কেউ কেউ ক্ষুধা নিবারণের জন্য পাহাড়ি শাক-পাতা সিদ্ধ করে খাচ্ছে।

টেকনাফের রোইখ্যং শরণার্থী ক্যাম্পের বাসিন্দা আবু তালেকসহ কয়েকজন আমাদের সময়কে বলেন, কিছু চাল পেয়েছিলাম সেটি দিয়ে কয়েকদিন চলেছে। গত দুদিন ধরে খাদ্যপণ্য হিসেবে কোনো ত্রাণ পাইনি। শুধু শাক সিদ্ধ খাচ্ছি। জামা-কাপড় পেয়েছি অনেক। কিন্তু এগুলোর প্রয়োজন নেই। আগে তো বেঁচে থাকার জন্য খাবার দরকার।

নতুন রোহিঙ্গারা জানিয়েছে, তাদের জন্য আসা ত্রাণ নিচ্ছে পুরনো ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গরাও। ফলে নতুন রোহিঙ্গারা ঠিক মতো ত্রাণ পাচ্ছে না। এমনকি স্থানীয় লোকজনদেরও কেউ কেউ ত্রাণ নিচ্ছে।

টেকনাফ-শাহপরীর দ্বীপ সড়কের দুপাশে বৃষ্টিতে ভিজে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় অনেক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে। তাদের মধ্যে কয়েকজন জানান, কুতুপালং ক্যাম্প থেকে কয়েক ঘণ্টা হেঁটে এখানে এসেছেন। কারণ ক্যাম্পে বসে ত্রাণ পাচ্ছিলেন তারা। বিভিন্ন ব্যক্তির উদ্যোগে বৃষ্টির মধ্যে এসব সড়কে ত্রাণ বিতরণ করতে দেখা যায়।

এ বিষয়ে দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের রিফিউজি রিলিফ অ্যান্ড রিপ্যাট্রিয়েশন কমিশনার (যুগ্ম সচিব) মোহাম্মাদ আবুল কালাম গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, ১২টি জায়গা থেকে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে হয়তো সব জায়গায় সমানভাবে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। তবে পর্যাপ্ত ত্রাণ সরবরাহ করা হচ্ছে।

শাক সিদ্ধ খেয়ে থাকার ব্যাপারে তিনি বলেন, দুর্গম কিছু জায়গায় ত্রাণ কম পৌঁছাতে পারে। আশা করছি দ্রুত এসব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

এদিকে গতকাল নতুন করে ঢুকে পড়া শরণার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুরো রাখাইন রাজ্যকেই টর্চার সেলে পরিণত করেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর মগরা। দমন-নির্যাতনের মাত্রা বাড়ানো গেলে শেষ মুহূর্তে সব রোহিঙ্গা বিতাড়িত হতে পারে ভেবে এই ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করেছে মিয়ানমার সেনারা।

তবে এখন বাংলাদেশে আসতে দুই জায়গায় দিতে হচ্ছে মোটা অঙ্কের মিয়ানমারের মুদ্রা কিয়েট। শেষ সম্বল নিয়ে পালিয়ে আসার সময় মিয়ানমার সেনাদের দোসর মগদের এক লাখ কিয়েট দিতে হচ্ছে। টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে ঢোকার সময় দালালদেরও এক লাখ কিয়েট দিতে হচ্ছে।

গতকাল সকালে দেখা যায়, শাহপরীর দ্বীপের একটি মাদ্রাসায় নারী ও শিশুদের খাবার ব্যবস্থা করেছেন স্থানীয়রা। গরুর মাংস ও ভাত খেতে দেওয়া হচ্ছে নতুন আসা শরণার্থীদের। তাদের একজন ইয়াহিয়া। গতকাল ভোরে টেকনাফে ঢুকেছেন। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, সেনারা আমার বড় ভাইকে মেরে ফেলেছে। আরেক ভাইকে জেলে দিয়েছে। আমি তিন ভাইবোন আর বাবা-মাকে নিয়ে জঙ্গলে পালিয়ে ছিলাম। অল্প অল্প করে সীমান্তের দিকে এগিয়ে আসি। এ কারণে আসতে দেরি হয়েছে। শিশুদের জন্যও মাথাপিছু এক লাখ টাকা করে নিয়েছে মগরা।

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের স্বাস্থ্যের বিষয়ে টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক ডা. টিটু চন্দ্র শীল আমাদের সময়কে বলেন, শিশুদের জন্য স্যানিটেশন নেই। গর্ভবতী মায়েরা বিশ্রাম পাচ্ছে না। এ দুই কারণেই অসুস্থ হয়ে পড়ছে তারা। তার ওপর বৃষ্টি। কয়েকজনের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় কক্সবাজার সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।

Logo-orginal