, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

admin admin

মগের মুল্লুক থেকে উ মং মং খা বলছি

প্রকাশ: ২০১৭-০৯-২৭ ১২:৩৯:৫৪ || আপডেট: ২০১৭-০৯-২৭ ১২:৩৯:৫৪

Spread the love
মগের মুল্লুক থেকে উ মং মং খা বলছি
মগের মুল্লুক থেকে উ মং মং খা বলছি

গোলাম মাওলা রনি:   আপনারা যারা মগের মুল্লুকের ওপর বেজায় চটে রয়েছেন তাদের জন্যই আমার আজকের নিবন্ধটি প্রণীত হয়েছে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা এবং তাদের দুর্ভোগ-দুর্দশা নিয়ে আপনাদের হৃদয়ে আবেগের গভীরতাকে আমি শ্রদ্ধা করি।কিন্তু অদ্ভুত পরিস্থিতির ঐতিহাসিক কারণ এবং আগামী দিনের সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে আপনারা যারা বেখেয়াল রয়েছেন তাদের উদ্দেশে আমি এমন কিছু তথ্য-উপাত্ত নিবেদন করব যা আপনাদের চিন্তা ও চেতনার খোরাক হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। বাংলাদেশ প্রতিদিনে প্রকাশিত বিশিষ্ট লেখক ও সাবেক এমপি গোলাম মাওলা রনির লেখাটি সময়ের নিরিখে চিন্তা ও গবেষণার দাবী রাখে ।

 

এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলার আগে নিজের সম্পর্কে কিছু বলে নেই। আমি আরাকানের মগ সম্প্রদায়ের একজন সাধারণ নাগরিক— যদিও আমার এই নামে আশির দশকে বার্মায় একজন নামকরা এবং দাপুটে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।

আপনারা অনেকে জানেন, শত শত বছর ধরে রোহিঙ্গাদের আবাসভূমি আরাকান একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাজ্য ছিল, যখন বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চল আরাকানিদের দ্বারা শাসিত হতো। সিংহাসনে অন্য ধর্মের রাজা থাকলেও সেনাবাহিনীসহ পুরো প্রশাসন ছিল মুসলমানদের অধীন। সে ঘটনা থেকে আজকের বাংলাদেশ এবং তৎকালীন সুবেবাংলার সঙ্গে আরাকানি রোহিঙ্গাদের যে সমস্যার সূত্রপাত ঘটে, তা সার্বিক বিচারে ইতিহাসের একটি কলঙ্কময় অধ্যায়। এত বড় নিষ্ঠুর, নির্মম গণহত্যা এবং রাজনৈতিক বিশ্বাসঘাতকতা পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি ঘটেছে কিনা তা আমার জানা নেই।

দিল্লির সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলের প্রথম দিকে অর্থাৎ ১৬৬০ সালে সুবেবাংলা থেকে রাজনৈতিক কারণে আশ্রয় নেওয়া ৫০ হাজার বাঙালিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় এবং আরাকান রাজ সান্দা থুঢাম্মা কর্তৃক মোগল শাহজাদী গুলরুখ বানু ধর্ষণের শিকার হয়ে অপমানে আত্মহত্যা করেন। এই খবর ঢাকা এবং দিল্লিতে পৌঁছানোর পর দ্বিতীয় তাণ্ডব শুরু হয়, যেখান থেকে ইতিহাসের মগের মুল্লুক এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলে পাহাড়ি সমস্যা শুরু হয়ে যায়। এ ব্যাপারে সামান্য একটু ইতিহাস না বললে বিষয়টি হয়তো অনেকের বোধগম্য হবে না। সিংহাসন নিয়ে সম্রাট শাহজাহানের পুত্রদের মধ্যে সৃষ্ট ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে পরাজিত হয়ে শাহ সুজা সপরিবারে বাংলায় পালিয়ে আসেন। কিন্তু আওরঙ্গজেবের সুবেদার মীর জুমলার সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তিনি নোয়াখালী হয়ে তৎকালীন রোহিঙ্গা রাজ্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করেন। যেখান থেকে রোহিঙ্গা রাজার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। সপরিবারে মক্কায় হজ পালন ও স্বেচ্ছানির্বাসনে যাওয়ার ব্যাপারে রাজার সাহায্যের আশ্বাস পেয়ে শাহজাদা সুজা রাজধানী মংডুতে পৌঁছেন।

রাজার প্রধান সেনাপতি ছিলেন জয়েনউদ্দিন এবং বাংলা ভাষার কবি আলাউল ছিলেন সভাকবি। চক্রান্ত অনুযায়ী শাহ সুজাকে সপরিবারে রাজপ্রাসাদে আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং সফরসঙ্গী সৈন্যসামান্ত ও সাধারণ সমর্থকদের শহরের বাইরে আশ্রয় প্রদান করা হয়। গভীর রাতে জয়েনউদ্দিন এবং তার ভাইয়ের নেতৃত্বে প্রাসাদের ভিতর ও বাইরে যুগপৎ আক্রমণ চালিয়ে নির্বিচারে গণহত্যা, ধর্ষণ এবং লুটতরাজ চালানো হয়। শাহ সুজা কোনো মতে প্রাণ নিয়ে ত্রিপুরায় পালিয়ে যান। তার কন্যা গুলরুখ বানু রাজা কর্তৃক ধর্ষিত হয়ে আত্মহত্যা করেন। সম্রাট আওরঙ্গজেব উপরোক্ত ঘটনা শোনার পর যারপরনাই ব্যথিত, মর্মাহত এবং ক্ষুব্ধ হয়ে বাংলার নবনিযুক্ত শাসক শায়েস্তা খানকে নির্দেশ পাঠান আরাকান রাজ্যের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান এবং প্রতিশোধ গ্রহণ করার জন্য।

শায়েস্তা খাঁর পুত্র বুজুর্গ উমেদ খান এক নৌযুদ্ধে আরাকান রাজকে পরাজিত করে চট্টগ্রাম দখল করে নেন এবং মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। অন্যদিকে মোগল সেনারা আরাকানের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চালায় যার ফলে অনেক সাধারণ নাগরিক ক্ষতিগ্রস্ত হন। আরাকান রাজ্যের শাসন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। লাখ লাখ আরাকানি নাগরিক চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এবং হাজার হাজার আরাকানি রোহিঙ্গা, মগ প্রভৃতি সম্প্রদায়ের লোক আরাকানি জাতীয়তাবাদীতে উদ্বুদ্ধ হয়ে মোগলদের কাছ থেকে চট্টগ্রাম পুনরুদ্ধার করার জন্য গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে যা ব্রিটিশ আমল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। অন্যদিকে কিছু আরাকানি পর্তুগিজ জলদস্যুদের সঙ্গে মিলিত হয়ে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ব্যাপক লুটতরাজ, ডাকাতি, অপহরণ ইত্যাদি অপরাধ চালাতে থাকে, যারা স্থানীয়ভাবে মগ দস্যু নামে পরিচিত হলেও ইতিহাসে তাদের আরাকানি দস্যু বলা হয়। নবাব আলীবর্দী খাঁ অত্যন্ত শক্ত হাতে পর্তুগিজ জলদস্যু এবং আরাকানি জলদস্যুদের দমন করেন।

ইতিহাসের উল্লিখিত ঘটনাবলির সঙ্গে এবার সাম্প্রতিককালের ঘটনাসমূহ এবং মিয়ানমার সরকার ও সামারিক বাহিনীর তৎপরতাগুলো একটু মিলিয়ে নিন। আপনারা অনেকেই জানেন যে, ইউরেনিয়ামসহ বেশ কিছু মূল্যবান খনিজ পদার্থের সর্ববৃহৎ খনি রয়েছে রোহিঙ্গা মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে। ওইসব অঞ্চল থেকে খনিজ সম্পদ উত্তোলনের জন্য অধিবাসীদের অন্যত্র সরানো দরকার। চীন সরকার ইতিমধ্যে আরাকান রাজ্যের অবকাঠামো উন্নয়ন, বন্দর নির্মাণ এবং খনিজ সম্পদ উত্তোলনের জন্য কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। ওই এলাকায় বিনিয়োগের সম্ভাবনায় ভাগ বসানোর জন্য রাশিয়া এবং ভারত উন্মুখ হয়ে বসে আছে।

বাণিজ্যিক স্বার্থকে সামনে রেখে যদি ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে অন্যত্র সরাতে হয় তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে তা প্রায় অসম্ভব। কাজেই দেশি-বিদেশি বেনিয়া চক্র সেখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করে এক ঢিলে দুই পাখি মারার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে, যার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত রয়েছে মিয়ানমারের মহাক্ষমতাধর সেনাবাহিনী। প্রথম ঢিলে তারা কাঙ্ক্ষিত ভূমি জনশূন্য করে ফেলেছে। দ্বিতীয় ঢিলে তারা চট্টগ্রামকে নিজেদের আওতাভুক্ত করার ঐতিহাসিক প্রচেষ্টাকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারীদের সঙ্গে ব্লু প্রিন্ট তৈরি করে ফেলেছে। গত এক মাসে যা কিছু হয়েছে তা পূর্ব প্রণীত নীলনকশা অনুযায়ী হয়েছে আর পরিকল্পনা মতো বাংলাদেশ শুধু ফাঁদে পা দিয়েছে অথবা দিতে বাধ্য হয়েছে।

নীলনকশা অনুযায়ী দেশি-বিদেশি গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমে কোটি কোটি ডলার ব্যয় করে রোহিঙ্গা নির্যাতনের নির্মম ও বিভৎস ছবি ও ভিডিও প্রকাশ করা হয় যাতে বাংলাদেশের জনগণ বিশ্বের মুসলিম সম্প্রদায় এবং বিশ্ববিবেক প্রতিবাদ মুখর হয়ে ওঠে। তারপর বাংলাদেশে ঝড়ের গতিতে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ করানোর জন্য এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়, যখন দেশটির সীমান্ত খুলে দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না। পরবর্তীতে যে কোনো মূল্যে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের পার্বত্য জেলাগুলোতে ছড়িয়ে দেওয়া হবে। ইতিমধ্যে, পরিকল্পনা অনুযায়ী সামাজিক মাধ্যমগুলো থেকে রোহিঙ্গা নির্যাতনের বেশিরভাগ ছবি উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং গলার সুর নরম করে আন্তর্জাতিক মহলকে আরাকান রাজ্য পরিদর্শনের জন্য বলা হচ্ছে। অন্যদিকে, নাসাকা বাহিনী এবং সেনাবাহিনীর মাধ্যমে সীমান্তে রীতিমতো যুদ্ধের মহড়া চালানো হচ্ছে।

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে শত শত মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এজেন্ট ঢোকানো হয়েছে যারা প্রতিদিনকার টাটকা খবর সীমান্তের ওপরের সেনাশিবিরে গিয়ে সরবরাহ করে পুনরায় বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছে। উপরোক্ত অবস্থায় মগের মুল্লুকের মগদের বিরুদ্ধে খিস্তি খেউড় এবং তাদের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার না করে কীভাবে দ্বিতীয় ঢিল প্রতিহত করে প্রথম ঢিলটিকে পাটকেল বানিয়ে ফেরত দেওয়া যায় সে ব্যাপারে বিবেক বুদ্ধি প্রয়োগ করার জন্য বাংলাদেশ যদি চেষ্টা-তদ্বির করে তবে হয়তো বিষয়টি মগদের জন্য আপদ হিসেবে আবির্ভূত হবে। অন্যথায় আমরা হয়তো প্রাক মোগল যুগে পুনরায় প্রবেশ করতে পারব। একেবারে বিনাবাধায়— কারণ সেভাবেই নীলনকশা প্রণীত হয়েছে।

 

Logo-orginal