, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

admin admin

২৮ শে অক্টোবরের রক্তাক্ত প্রান্তর থেকে: মানিক

প্রকাশ: ২০১৭-১০-২৮ ০৮:২৮:১৩ || আপডেট: ২০১৭-১০-২৮ ০৮:২৮:১৩

Spread the love

২৮ শে অক্টোবরের রক্তাক্ত প্রান্তর থেকে: মানিক
২৮ শে অক্টোবরের রক্তাক্ত প্রান্তর থেকে: মানিক
ডাঃ মোঃ ফখরুদ্দীন মানিক: এ কোন শয়তান মানুষের সত্তাকে করে চরম পরিহাস
কোন আজাজিল আজ লাথি মারে মানুষের শবে।’

২০০৬ সালের ২৮ শে অক্টোবর ছিল চারদলীয় জোট সরকারের পাঁচ বছর মেয়াদ শেষে ক্ষমতা হস্তান্তরের দিন। সেই উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে সমাবেশের আয়োজন করে। বিকেল ৩টায় সমাবেশ শুরু হওয়ার কথা, তাই সকাল থেকে শুরু হয়েছিল ডেকোরেশনের কাজ। অল্প কিছু ভাই স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য এসেছিল। ক্রমান্বয়ে চলছিল স্টেজ তৈরির কাজ, সেই সাথে শৃঙ্খলা বিভাগের কর্মীদের নির্ধারিত স্থানে সেট করা। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির ঢাকা মহানগরী পশ্চিম শাখার দায়িত্ব ছিল স্টেজ থেকে পল্টন মোড় হয়ে পল্টন মসজিদ পর্যন্ত ১৫ টি স্পটে শৃংখলার।

আমি তখন মহানগরী সেক্রেটারী সেজন্য তদারকির দায়িত্ব পালন করছি সকাল থেকে। সকাল ১০টার দিকে আমরা তখন শেষবারের মতো সবাইকে যার যার নির্ধারিত জায়গায় ঠিকভাবে দাঁড় করিয়ে দেয়ার জন্য পল্টন মসজিদের গলিতে এসে দাঁড়ালাম। এই স্পটে আমাদের মিরপুর পশ্চিম থানার সাথে মহানগরী পূর্ব শাখার কিছু ভাইও ছিল। সাথে ছিলেন পূর্ব শাখারা সেক্রেটারী রফিকুল ইসলাম ভাই। মিছিলের অবস্থা দেখে মনে হয়েছিল দেশের সবগুলো সন্ত্রাসীকে ভাড়া করা হয়েছিল এই মিছিলের জন্য। হঠাৎ করে মিছিলের একটি অংশ কোন কারণ ছাড়াই বিনা উস্কানিতে পল্টন মসজিদের গলিতে দাঁড়িয়ে থাকা আমাদের কর্মীদের আঘাত করতে শুরু করে। সাথে সাথে আহত এবং রক্তাক্ত হয়ে লুটিয়ে পড়ে আমাদের কয়েকজন। পরিস্থিতির ভয়াবহতায় আমরা কিছুটা পেছনে সরে এসে শ্লোগান দিয়ে তাদেরকে ধাওয়া করলে তারা সবাই গলি থেকে বের হয়ে রাস্তায় চলে যায়।

এইভাবে কিছুক্ষণ ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার পর দেখি অব্যাহত মিছিলের একটি অংশ পল্টন মোড়ে গিয়ে সেখানে অবস্থানরত ভাইদের ওপর আক্রমণ করে। তাদের অব্যাহত আক্রমণ ইট, পাথর বৃষ্টির ধাওয়ার মধ্যে এক এক করে শাহাদাত বরণ করেন মুজাহিদ, শিপন, জসিম, হাবীব, মাসুম ও ফয়সাল। তাদের আগ্নেয়াস্ত্রে আহত, রক্তাক্ত ও বুলেটবিদ্ধ হন ইসলামী আন্দোলনের অসংখ্য নেতা-কর্মী। এ যেন আরেক কারবালা! এ কোন রাজনৈতিক অপকৌশল! তিন দিক থেকে আক্রমণ করে আমাদের সমাবেশকে পণ্ড করে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। নাইটেঙ্গেলের দিক থেকে অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন এবং অ্যাডভোকেট রহমত উল্লাহর নেতৃত্বে, প্রেস ক্লাবের দিক থেকে মালিবাগ হত্যাকাণ্ডের নায়ক ডা. এইচ বি এম ইকবালের নেৃতত্বে এবং মুক্তাঙ্গনের দিক থেকে হাজী সেলিমের নেতৃত্বে আক্রমণ চালানো হয়। বেলা যতই বাড়ছিল আক্রমণের তীব্রতাও ততই বাড়ছিল। ততক্ষণে জামায়াত অফিস, শিবির অফিস, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল, ইবনে সিনা হাসপাতাল আহত ভাইদের দ্বারা ভর্তি। কোথাও একটু দাঁড়ানোর জায়গা নেই, যে ২০-২৫ জন নিয়ে সকাল ১০টা থেকে পল্টনের গলিতে ছিলাম, মোটামুটি সবাই আহত।

২৮ অক্টবোরের প্রথম শহীদ মুজাহিদ শাহাদাত বরন করে আমার পাশ থেকে
আমরা সবে মাত্র এসে দাড়িয়েছি। পল্টন মসজিদের এই গ্রুপের একজন হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে এসেছে মুজাহিদ। নাইটেঙ্গেলের দিক থেকে অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন এবং অ্যাডভোকেট রহমত উল্লাহর নেতৃত্বে আসা মিছিলের এ অংশটির হঠাত আক্রমনের কারনে আমরা একটু পিছনে সরে আসলেও মুজাহিদ পড়ে যায় । তাকে তারা টেনে পাশের একটা গলিতে নিয়ে পিটিয়ে শহীদ করে ফেলে রেখে যায়। কিছুক্ষণ পর দেখি আমান ভাইকে রাস্তায় ফেলে খুবই পেটাচ্ছে, তখন যে কয়জন সাথে ছিল তাদেরকে সাথে নিয়ে আমান ভাইকে উদ্ধার করি। সমস্ত শরীর তার রক্তাক্ত, চেনা যাচ্ছে না অথচ পড়ে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত যিনি খুব চিৎকার করে সবাইকে একত্রিত করার জন্য বলেছিলেন, বলেছিলেন শ্লোগান দেয়ার জন্য, সবাইকে নিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য; কিছুক্ষণ পর দেখি একজন ভাই তাদের মধ্য থেকে আমাদের দিকে দৌড়ে আসছেন, কাছে আসার পর দেখি তিনি আর কেহ নন, সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি মজিবুর রহমান মঞ্জু ভাই।

আমাদের কাছে এসে তিনি পড়ে যান। পরে জেনেছিলাম তিনি তাদের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন, আল্লাহ তাকে বাঁচিয়েছিলেন। অসংখ্য আঘাতের পর কোন রকম সুযোগ পেয়ে দৌড়ে আসছিলেন। পরে কয়েক ভাই উনাকে উদ্ধার করে জামায়াত অফিসে পাঠিয়ে দেন। সেই দিন পল্টনকে মনে হয়েছিল অন্য রকম এক জিহাদের ময়দান। আমরা বদর, ওহুদ এবং খন্দকে রাসূল (সা) এর সাথে সাহাবীদের ইতিহাস পড়েছি। পড়েছি হামজা, হানজালা (রা)-দের বীরত্ব এবং দৃঢ়তার কথা, কাফেরদের সংখ্যাধিক্য এবং অত্যধিক অস্ত্র এবং রশদ যাদেরকে সামান্যতম বিচলিত করেনি এবং নিজেদের সামান্য প্রস্তুতি এবং ঈমানের কঠিন মজবুতি নিয়ে শাহাদাতের প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে রাসূল (সা) এর সাথে অটল এবং অবিচল ছিলেন। কাফেরদের সেই বৃহৎ সৈন্য বাহিনীকে পরাজিত করেছেন, ঠিক তেমনিভাবে বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলনের কর্মী ভাইয়েরা সেই ঈমানী দৃঢ়তা নিয়ে আওয়ামী অপশক্তি তথা মহাজোটের লেলিয়ে দেয়া সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ইস্পাত কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।

নিজের পাশের ভাইটি রক্তাক্ত, আহত হয়ে পড়ে যাওয়ার পর নিজে এতটুকু ভীত বা বিচলিত হননি। আওয়ামী লীগের নিক্ষিপ্তি ইট, পাথর, বোতল, লাঠিগুলো কুড়িয়ে নিয়ে তাদেরকে ধাওয়া করেছেন। প্রায় ২ থেকে ৩ ঘণ্টা ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার পর হঠাৎ একটি ইট মাথায় পড়ে। কানের পাশ দিয়ে পড়া রক্তকে প্রথমে ঘাম মনে করে তখনও দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করি, কিন্তু পাশের ভাইয়েরা তখনি ধরে জামায়াত অফিসে পাঠিয়ে দেয়। এখানে এসে দেখলাম আরেক করুণ দৃশ্য! অসংখ্য আহত ভাইয়ের চিৎকার এবং আর্তনাদ, তার সাথে রয়েছে পারস্পরিক সহমর্মিতা ও ভালবাসার এক অনন্য নজির। এ যেন সেই ইয়ারমুক যুদ্ধের ময়দান, যেখানে পিপাসার্ত মুসলিম সৈন্যরা নিজের পিপাসাকে সংবরণ করে পানি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন অপর ভাইয়ের কাছে, এখানেও তাই। নিজেই আহত অথচ রক্তাক্ত জখম নিয়ে সেবা করছেন, অপর ভাইয়ের ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছেন, ড্রেসিং করে দিচ্ছেন, আঘাতের জায়গায় বরফ লাগিয়ে দিচ্ছেন। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম যাদের সবাইকে নিয়ে সকালে শৃঙ্খলার জন্য দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলাম, তাদের অধিকাংশই এখানে। রাস্তায় থাকায় তখনও বুঝতে পারিনি কোথায় কতটুকু আঘাত লেগেছিল। এখানে বসার পর আস্তে আস্তে দেখি সবগুলো জয়েন্ট থেকে ব্যথা শুরু হয়েছে, হাতের দিকে তাকিয়ে দেখি অনেক জায়গাই আহত এবং রক্তাক্ত। পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখি স্ক্রিনটা ফেটে গেছে। অনেক মিস কল। আমার আঘাতটা বেশি মারাত্মক না হওয়ায় হালকা ব্যান্ডেজ নিয়ে নিচে নেমে এসে আযাদ প্রোডাক্টসের গলিতে অবস্থান করি।

সেখান থেকে হাটতে হাটতে আবার পল্টন মসজিদের দিকে এসে দেখি প্রথম যাদের কে নিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম তাদের কেউ আর অবশিষ্ট নাই সবাই আহত হয়ে ফিরে গিয়েছেন। মহানগরী পূর্বের সেক্রেটারী রফিক ভাইকে দেখি মাথায় ব্যান্ডেজ। কিছুক্ষণ পর একটু এগিয়ে এসে দেখি ৪/৫ জন কোলে করে নিয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের তৎকালীন দাওয়া সম্পাদক পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় সভাপতি ডঃ রেজাউল করিম ভাইকে। একটি পা তার ভেংগে নিচের দিকে ঝুলে আছে। আমরা আহত হয়ে চলে যাওয়ার পর উনারা এখানে এসে অবস্থান নিয়েছিলেন। তখনও শোনা যাচ্ছে ধ্রিম ধ্রিম বোমার আওয়াজ আর আহত ভাইদের মিছিল। আযাদ প্রোডাক্টের এই গলিতে আমাদের সাথে লাঠি হাতে অবস্থান করেছিলেন আমাদের প্রিয় নেতা শহীদ মীর কাসেম আলী ভাই। যথানিয়মে জামায়াতের সমাবেশের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। পল্টন মোড়ের কিছু পেছনে আমাদের ভাইয়েরা মানববর্ম তৈরি করে মহাজোটের সন্ত্রাসীদের প্রতিরোধের চেষ্টা করছে আর এক এক করে আহত হয়ে ফিরে আসছে। এর মধ্যে খবর এসেছে আওয়ামী লীগের হামলায় শাহাদাত বরণ করেছেন মুজাহিদ, শিপন, জসিম, রফিক ফয়সাল ও হাবীব।

আমীরে জামায়াতের বক্তব্য শোনা যাচ্ছে, কণ্ঠে দৃঢ়তা। ছয়জন ভাইয়ের শাহাদাত এবং হাজার হাজার ভাইয়ের আহত হওয়ার খবর শোনার পরও তিনি তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে সবাইকে ধৈর্য ধারণ করে পরিস্থিতি মোকাবেলার আহ্বান জানান। কোন রকম হঠকারী বা উসকানিমূলক বক্তব্য দেননি অথচ যার একটি মাত্র অঙ্গুলী হেলনে হাজার হাজার কর্মী শাহাদাত বরণ করতে দ্বিধা করবেন না, ঠিক সেই মুহূর্তেও আমীরে জামায়াত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহযোগিতার স্বার্থে সবাইকে ধৈর্য ধারণ করার জন্য বক্তব্যের মাধ্যমে আহবান জানাচ্ছেন। এই হচ্ছে ইসলামী আন্দোলন তথা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতার দেশপ্রেম এবং দায়িত্বশীলতা। ঠিক একই রকম বক্তব্য এসেছিল বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি, সেক্রেটারি জেনারেল ও অন্যান্য দায়িত্বশীলদের পক্ষে থেকে। বিকেলে একটি ছেলেকে আমাদের ভাইয়েরা ইনফরমার হিসেবে আটক করে আজাদ হোটেলের সামনে যখন মারার জন্য এগিয়ে আসে। সেক্রেটারি জোনারেল সব শুনে তাকে ছেড়ে দেন এবং বলেন আমরা যদি এরকম আচরণ করি তাহলে আমাদের আর তাদের মধ্যে পার্থক্য কোথায়?

অথচ ইতিহাস সাক্ষী এবং ইলেকট্রনিকস ও প্রিন্ট মিডিয়ার মাধ্যমে বিশ্ববাসী হতবাক হয়ে দেখেছে বাংলাদেশের মানবতার বিপর্যয়, যার মূল উসকানি দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি সবাইকে লগি-বৈঠা নিয়ে ঢাকায় আসার নির্দেশ দেন। তিনি এক সময় ২০০১ সালে চট্টগ্রাম গিয়ে জনসভায় প্রকাশ্য ঘোষণা দেন, একটি লাশের বদলে ১০টি লাশ, কর্মীদের উসকানি দেন এই বলে, চট্টগ্রামের নেতাকর্মীরা শাড়ি-চুড়ি পরে বসে আছে। অথচ তিনি ছিলেন তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। আমরা ধিক্কার জানাই এসব নেতাকে যারা তাদের কর্মীদেরকে লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করে সন্ত্রাস নির্মূল অথবা নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে উসকে দেন। সত্যিকারার্থে তাদের কর্মতৎপরতা দেশের কতটুকু কল্যাণের এটি আজকে বড় প্রশ্ন। অবশেষে সন্ধ্যার দিকে শেষ হলো ১৪ দলীয় মহাজোটের ধ্বংসযজ্ঞ। তাদের এই তাণ্ডব এবং ধ্বংসলীলায় প্রাণ হারাল ইসলামী ছাত্রশিবিরের মুজাহিদ, শিপন, মাসুম, ফয়সাল রফিকসহ ইসলামী আন্দোলনের ১৪ জন ভাই। আমাদের মায়েরা হারালেন তাদের নাড়িছেঁড়া ধন প্রিয় সন্তানকে, দেশ হারালো কিছু সম্ভাবনাময়ী তরুণ এবং আগামী দিনের সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার সৎ, দক্ষ এবং দেশপ্রেমিক কিছু নাগরিক।

আজ ১০ বছর পার হল ২৮ শে অক্টোবরের। বিচার হয়নি সেই হত্যাকান্ডের হুকুমদাতা, নেতৃত্বদানকারী, সংঘটনকারী সেই সকল নর পিচাশদের। রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহার করা হয়েছে সকল মামলা। মুলত এই হত্যা ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার নীল নকশার সুচনা। যা আজকে ভোটার বিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসেছে জনগনের মাথার উপর। সরকারের এই মামলা প্রত্যাহারের মাধ্যমে একদিকে মানবতাকে লাঞ্ছিত করেছে, আহত নির্যাতিত মানুষের আর্তনাদ, ছেলে হারা, স্বামী হারা, মা-বোনদের হৃদয়ের আকুতিকে পদদলিত করেছে। আর সেই জন্য ২৮ শে অক্টোবরের ক্ষত চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছে সমগ্র বাংলাদেশ।

আজকে হত্যা এবং সন্ত্রাসকে সরকার রাষ্ট্রীয়করণ করেছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদেরকে বাসায় ঘুম থেকে তুলে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধার এবং বন্দুক যুদ্ধের নাটক সাজিয়ে হত্যার উৎসবে মেতে উঠেছে। আজকে একই সময়ে মা যখন তার নবাগত সন্তানের প্রসব বেদনায় চিৎকার করছেন ঠিক সেই মুহূর্তে বাবা চিৎকার করেছেন পুলিশের গুলিতে মৃত্যু পথ যাত্রী হয়ে। মাত্র সাড়ে সাত মাসের ব্যাবধানে এক ঝিনাইদহতে হত্যা করা হয়েছে জামায়াত শিবিরের ১১ জনকে।

তাদের সর্বশেষ স্বীকার ঝিনাইদহ শহর জামায়াতের আমীর জহুরুল ইসলাম ভাই এবং বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাকা মহানগরীর পশ্চিম শাখার সাবেক কলেজ কার্যক্রম সম্পাদক ডাঃ খন্দকার তারেক হাসান সজিব। তার মাত্র ২৪ দিন বয়সী ২টি যমজ মেয়ে কোনদিন দেখতে পারবেনা তাদের জন্মদাতা পিতাকে। আর বাবা দেখে যেতে পারেনি তার প্রিয় সন্তানের মুখ। গত ২৫ শে অক্টোবর সকালে দেড়মাসে আগে বাসা থেকে উঠিয়ে নিয়ে তাদেরকে বন্দুক যুদ্ধের নাটক সাজিয়ে হত্যা করে। আজকে বাংলাদেশের প্রত্যেকটি জনপদ আওয়ামী সন্ত্রাস কবলিত।

সন্ত্রাসের উপর ভর করে দুনিয়ার কোন জালেম স্বৈরাচার তাদের ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে পারেনি, পারবেও না। যে সন্ত্রাসকে প্রশ্রয় দিয়ে ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে চেয়েছে সেই সন্ত্রাসের পথে তাদের ধ্বংস হয়েছে। দুনিয়ার ক্ষমতায় অন্ধ হয়ে মামলা উঠাতে পারেন, হত্যা করে উল্টো ভিক্টিম এবং তাদের পরিবারকে মামালা দিয়ে হয়রানী করতে পারেন। কিন্তু আল্লাহর আযাব থেকে রক্ষা করতে পারবেন না নিজেকে। যাদেরকে হত্যা করেছেন, তাদের বাবা মা, ভাই-বোন, সন্তানদের নির্ঘুম চোখের পানির ফরিয়াদ তোমাদের জন্য কেয়ামতের আযাব হিসেবে দেখা দিবে। আল্লাহ হচ্ছেন উত্তম বিচারক, এই বিচারের ভার আল্লাহর উপর থাকলো।

আমরা হতাশ নই, ভীতসন্ত্রস্তও নই। আমাদের কোন কিছু হারানোর ভয়ও নেই। আমরাতো আমাদের জান মালের বিনিময়ে জান্নাতের প্রত্যাশী। আমরা যার প্রতিনিধিত্ব করি তিনি তো সীমাহীন ক্ষমতার অধীকারী। দুনিয়ার কোন শাসক যতটুকুই ঔদ্ধত্য প্রকাশ করুক কিন্তু আল্লাহর সীমাকে অতিক্রম করার ক্ষমতা বা শক্তি রাখেন না। সুতরাং আজকে রাজনৈতিক বিবেচনায় যাই করেন না কেন একদিন অবশ্যই আপনাদেরকে জনতার আদালতে এবং আল্লাহর আদালতে হাজির হতেই হবে। আল্লাহর আদালত থেকে পালানোর পথ খুঁজে পাবেন না আর জুলুম নির্যাতন করে ইসলামী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকে মিথ্যা মামলা দিয়ে কারাগারে আটক করে, জুড়িশিয়াল কিলিং এর মাধ্যমে আমাদের অগ্রযাত্রাকে রুদ্ধ করে দেয়া ইতঃপূর্বে যেমন কোন জালেম অথবা ইসলামবিরোধী শক্তির দ্বারা সম্ভব হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না ইনশাল্লাহ। বরং জুলুম, নির্যাতন এবং ঈমানী পরীক্ষার এই শাশ্বত কঠিন পথ ধরে অবধারিত সোনালি সূর্য একদিন উদিত হবেই ইনশাআল্লাহ।
তাই আমরা বলছি-

‘‘আমাদের গতি সত্যের পথে
কোন বাধা আজ মানবে না
বিজয় আছে সম্মুখে তাই
মুক্তির এ মিছিল থামবে না।”২৮ শে অক্টোবরের রক্তাক্ত প্রান্তর থেকে…
-ডাঃ মোঃ ফখরুদ্দীন মানিক

‘এ কোন শয়তান মানুষের সত্তাকে করে চরম পরিহাস
কোন আজাজিল আজ লাথি মারে মানুষের শবে।’

২০০৬ সালের ২৮ শে অক্টোবর ছিল চারদলীয় জোট সরকারের পাঁচ বছর মেয়াদ শেষে ক্ষমতা হস্তান্তরের দিন। সেই উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে সমাবেশের আয়োজন করে। বিকেল ৩টায় সমাবেশ শুরু হওয়ার কথা, তাই সকাল থেকে শুরু হয়েছিল ডেকোরেশনের কাজ। অল্প কিছু ভাই স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য এসেছিল। ক্রমান্বয়ে চলছিল স্টেজ তৈরির কাজ, সেই সাথে শৃঙ্খলা বিভাগের কর্মীদের নির্ধারিত স্থানে সেট করা। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির ঢাকা মহানগরী পশ্চিম শাখার দায়িত্ব ছিল স্টেজ থেকে পল্টন মোড় হয়ে পল্টন মসজিদ পর্যন্ত ১৫ টি স্পটে শৃংখলার।

আমি তখন মহানগরী সেক্রেটারী সেজন্য তদারকির দায়িত্ব পালন করছি সকাল থেকে। সকাল ১০টার দিকে আমরা তখন শেষবারের মতো সবাইকে যার যার নির্ধারিত জায়গায় ঠিকভাবে দাঁড় করিয়ে দেয়ার জন্য পল্টন মসজিদের গলিতে এসে দাঁড়ালাম। এই স্পটে আমাদের মিরপুর পশ্চিম থানার সাথে মহানগরী পূর্ব শাখার কিছু ভাইও ছিল। সাথে ছিলেন পূর্ব শাখারা সেক্রেটারী রফিকুল ইসলাম ভাই। মিছিলের অবস্থা দেখে মনে হয়েছিল দেশের সবগুলো সন্ত্রাসীকে ভাড়া করা হয়েছিল এই মিছিলের জন্য। হঠাৎ করে মিছিলের একটি অংশ কোন কারণ ছাড়াই বিনা উস্কানিতে পল্টন মসজিদের গলিতে দাঁড়িয়ে থাকা আমাদের কর্মীদের আঘাত করতে শুরু করে। সাথে সাথে আহত এবং রক্তাক্ত হয়ে লুটিয়ে পড়ে আমাদের কয়েকজন। পরিস্থিতির ভয়াবহতায় আমরা কিছুটা পেছনে সরে এসে শ্লোগান দিয়ে তাদেরকে ধাওয়া করলে তারা সবাই গলি থেকে বের হয়ে রাস্তায় চলে যায়।

এইভাবে কিছুক্ষণ ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার পর দেখি অব্যাহত মিছিলের একটি অংশ পল্টন মোড়ে গিয়ে সেখানে অবস্থানরত ভাইদের ওপর আক্রমণ করে। তাদের অব্যাহত আক্রমণ ইট, পাথর বৃষ্টির ধাওয়ার মধ্যে এক এক করে শাহাদাত বরণ করেন মুজাহিদ, শিপন, জসিম, হাবীব, মাসুম ও ফয়সাল। তাদের আগ্নেয়াস্ত্রে আহত, রক্তাক্ত ও বুলেটবিদ্ধ হন ইসলামী আন্দোলনের অসংখ্য নেতা-কর্মী। এ যেন আরেক কারবালা! এ কোন রাজনৈতিক অপকৌশল! তিন দিক থেকে আক্রমণ করে আমাদের সমাবেশকে পণ্ড করে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। নাইটেঙ্গেলের দিক থেকে অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন এবং অ্যাডভোকেট রহমত উল্লাহর নেতৃত্বে, প্রেস ক্লাবের দিক থেকে মালিবাগ হত্যাকাণ্ডের নায়ক ডা. এইচ বি এম ইকবালের নেৃতত্বে এবং মুক্তাঙ্গনের দিক থেকে হাজী সেলিমের নেতৃত্বে আক্রমণ চালানো হয়। বেলা যতই বাড়ছিল আক্রমণের তীব্রতাও ততই বাড়ছিল। ততক্ষণে জামায়াত অফিস, শিবির অফিস, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল, ইবনে সিনা হাসপাতাল আহত ভাইদের দ্বারা ভর্তি। কোথাও একটু দাঁড়ানোর জায়গা নেই, যে ২০-২৫ জন নিয়ে সকাল ১০টা থেকে পল্টনের গলিতে ছিলাম, মোটামুটি সবাই আহত।

২৮ অক্টবোরের প্রথম শহীদ মুজাহিদ শাহাদাত বরন করে আমার পাশ থেকে
আমরা সবে মাত্র এসে দাড়িয়েছি। পল্টন মসজিদের এই গ্রুপের একজন হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে এসেছে মুজাহিদ। নাইটেঙ্গেলের দিক থেকে অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন এবং অ্যাডভোকেট রহমত উল্লাহর নেতৃত্বে আসা মিছিলের এ অংশটির হঠাত আক্রমনের কারনে আমরা একটু পিছনে সরে আসলেও মুজাহিদ পড়ে যায় । তাকে তারা টেনে পাশের একটা গলিতে নিয়ে পিটিয়ে শহীদ করে ফেলে রেখে যায়। কিছুক্ষণ পর দেখি আমান ভাইকে রাস্তায় ফেলে খুবই পেটাচ্ছে, তখন যে কয়জন সাথে ছিল তাদেরকে সাথে নিয়ে আমান ভাইকে উদ্ধার করি। সমস্ত শরীর তার রক্তাক্ত, চেনা যাচ্ছে না অথচ পড়ে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত যিনি খুব চিৎকার করে সবাইকে একত্রিত করার জন্য বলেছিলেন, বলেছিলেন শ্লোগান দেয়ার জন্য, সবাইকে নিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য; কিছুক্ষণ পর দেখি একজন ভাই তাদের মধ্য থেকে আমাদের দিকে দৌড়ে আসছেন, কাছে আসার পর দেখি তিনি আর কেহ নন, সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি মজিবুর রহমান মঞ্জু ভাই।

আমাদের কাছে এসে তিনি পড়ে যান। পরে জেনেছিলাম তিনি তাদের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন, আল্লাহ তাকে বাঁচিয়েছিলেন। অসংখ্য আঘাতের পর কোন রকম সুযোগ পেয়ে দৌড়ে আসছিলেন। পরে কয়েক ভাই উনাকে উদ্ধার করে জামায়াত অফিসে পাঠিয়ে দেন। সেই দিন পল্টনকে মনে হয়েছিল অন্য রকম এক জিহাদের ময়দান। আমরা বদর, ওহুদ এবং খন্দকে রাসূল (সা) এর সাথে সাহাবীদের ইতিহাস পড়েছি। পড়েছি হামজা, হানজালা (রা)-দের বীরত্ব এবং দৃঢ়তার কথা, কাফেরদের সংখ্যাধিক্য এবং অত্যধিক অস্ত্র এবং রশদ যাদেরকে সামান্যতম বিচলিত করেনি এবং নিজেদের সামান্য প্রস্তুতি এবং ঈমানের কঠিন মজবুতি নিয়ে শাহাদাতের প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে রাসূল (সা) এর সাথে অটল এবং অবিচল ছিলেন। কাফেরদের সেই বৃহৎ সৈন্য বাহিনীকে পরাজিত করেছেন, ঠিক তেমনিভাবে বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলনের কর্মী ভাইয়েরা সেই ঈমানী দৃঢ়তা নিয়ে আওয়ামী অপশক্তি তথা মহাজোটের লেলিয়ে দেয়া সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ইস্পাত কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।

নিজের পাশের ভাইটি রক্তাক্ত, আহত হয়ে পড়ে যাওয়ার পর নিজে এতটুকু ভীত বা বিচলিত হননি। আওয়ামী লীগের নিক্ষিপ্তি ইট, পাথর, বোতল, লাঠিগুলো কুড়িয়ে নিয়ে তাদেরকে ধাওয়া করেছেন। প্রায় ২ থেকে ৩ ঘণ্টা ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার পর হঠাৎ একটি ইট মাথায় পড়ে। কানের পাশ দিয়ে পড়া রক্তকে প্রথমে ঘাম মনে করে তখনও দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করি, কিন্তু পাশের ভাইয়েরা তখনি ধরে জামায়াত অফিসে পাঠিয়ে দেয়। এখানে এসে দেখলাম আরেক করুণ দৃশ্য! অসংখ্য আহত ভাইয়ের চিৎকার এবং আর্তনাদ, তার সাথে রয়েছে পারস্পরিক সহমর্মিতা ও ভালবাসার এক অনন্য নজির। এ যেন সেই ইয়ারমুক যুদ্ধের ময়দান, যেখানে পিপাসার্ত মুসলিম সৈন্যরা নিজের পিপাসাকে সংবরণ করে পানি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন অপর ভাইয়ের কাছে, এখানেও তাই। নিজেই আহত অথচ রক্তাক্ত জখম নিয়ে সেবা করছেন, অপর ভাইয়ের ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছেন, ড্রেসিং করে দিচ্ছেন, আঘাতের জায়গায় বরফ লাগিয়ে দিচ্ছেন। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম যাদের সবাইকে নিয়ে সকালে শৃঙ্খলার জন্য দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলাম, তাদের অধিকাংশই এখানে। রাস্তায় থাকায় তখনও বুঝতে পারিনি কোথায় কতটুকু আঘাত লেগেছিল। এখানে বসার পর আস্তে আস্তে দেখি সবগুলো জয়েন্ট থেকে ব্যথা শুরু হয়েছে, হাতের দিকে তাকিয়ে দেখি অনেক জায়গাই আহত এবং রক্তাক্ত। পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখি স্ক্রিনটা ফেটে গেছে। অনেক মিস কল। আমার আঘাতটা বেশি মারাত্মক না হওয়ায় হালকা ব্যান্ডেজ নিয়ে নিচে নেমে এসে আযাদ প্রোডাক্টসের গলিতে অবস্থান করি।

সেখান থেকে হাটতে হাটতে আবার পল্টন মসজিদের দিকে এসে দেখি প্রথম যাদের কে নিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম তাদের কেউ আর অবশিষ্ট নাই সবাই আহত হয়ে ফিরে গিয়েছেন। মহানগরী পূর্বের সেক্রেটারী রফিক ভাইকে দেখি মাথায় ব্যান্ডেজ। কিছুক্ষণ পর একটু এগিয়ে এসে দেখি ৪/৫ জন কোলে করে নিয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের তৎকালীন দাওয়া সম্পাদক পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় সভাপতি ডঃ রেজাউল করিম ভাইকে। একটি পা তার ভেংগে নিচের দিকে ঝুলে আছে। আমরা আহত হয়ে চলে যাওয়ার পর উনারা এখানে এসে অবস্থান নিয়েছিলেন। তখনও শোনা যাচ্ছে ধ্রিম ধ্রিম বোমার আওয়াজ আর আহত ভাইদের মিছিল। আযাদ প্রোডাক্টের এই গলিতে আমাদের সাথে লাঠি হাতে অবস্থান করেছিলেন আমাদের প্রিয় নেতা শহীদ মীর কাসেম আলী ভাই। যথানিয়মে জামায়াতের সমাবেশের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। পল্টন মোড়ের কিছু পেছনে আমাদের ভাইয়েরা মানববর্ম তৈরি করে মহাজোটের সন্ত্রাসীদের প্রতিরোধের চেষ্টা করছে আর এক এক করে আহত হয়ে ফিরে আসছে। এর মধ্যে খবর এসেছে আওয়ামী লীগের হামলায় শাহাদাত বরণ করেছেন মুজাহিদ, শিপন, জসিম, রফিক ফয়সাল ও হাবীব।

আমীরে জামায়াতের বক্তব্য শোনা যাচ্ছে, কণ্ঠে দৃঢ়তা। ছয়জন ভাইয়ের শাহাদাত এবং হাজার হাজার ভাইয়ের আহত হওয়ার খবর শোনার পরও তিনি তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে সবাইকে ধৈর্য ধারণ করে পরিস্থিতি মোকাবেলার আহ্বান জানান। কোন রকম হঠকারী বা উসকানিমূলক বক্তব্য দেননি অথচ যার একটি মাত্র অঙ্গুলী হেলনে হাজার হাজার কর্মী শাহাদাত বরণ করতে দ্বিধা করবেন না, ঠিক সেই মুহূর্তেও আমীরে জামায়াত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহযোগিতার স্বার্থে সবাইকে ধৈর্য ধারণ করার জন্য বক্তব্যের মাধ্যমে আহবান জানাচ্ছেন। এই হচ্ছে ইসলামী আন্দোলন তথা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতার দেশপ্রেম এবং দায়িত্বশীলতা। ঠিক একই রকম বক্তব্য এসেছিল বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি, সেক্রেটারি জেনারেল ও অন্যান্য দায়িত্বশীলদের পক্ষে থেকে। বিকেলে একটি ছেলেকে আমাদের ভাইয়েরা ইনফরমার হিসেবে আটক করে আজাদ হোটেলের সামনে যখন মারার জন্য এগিয়ে আসে। সেক্রেটারি জোনারেল সব শুনে তাকে ছেড়ে দেন এবং বলেন আমরা যদি এরকম আচরণ করি তাহলে আমাদের আর তাদের মধ্যে পার্থক্য কোথায়?

অথচ ইতিহাস সাক্ষী এবং ইলেকট্রনিকস ও প্রিন্ট মিডিয়ার মাধ্যমে বিশ্ববাসী হতবাক হয়ে দেখেছে বাংলাদেশের মানবতার বিপর্যয়, যার মূল উসকানি দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি সবাইকে লগি-বৈঠা নিয়ে ঢাকায় আসার নির্দেশ দেন। তিনি এক সময় ২০০১ সালে চট্টগ্রাম গিয়ে জনসভায় প্রকাশ্য ঘোষণা দেন, একটি লাশের বদলে ১০টি লাশ, কর্মীদের উসকানি দেন এই বলে, চট্টগ্রামের নেতাকর্মীরা শাড়ি-চুড়ি পরে বসে আছে। অথচ তিনি ছিলেন তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। আমরা ধিক্কার জানাই এসব নেতাকে যারা তাদের কর্মীদেরকে লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করে সন্ত্রাস নির্মূল অথবা নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে উসকে দেন। সত্যিকারার্থে তাদের কর্মতৎপরতা দেশের কতটুকু কল্যাণের এটি আজকে বড় প্রশ্ন। অবশেষে সন্ধ্যার দিকে শেষ হলো ১৪ দলীয় মহাজোটের ধ্বংসযজ্ঞ। তাদের এই তাণ্ডব এবং ধ্বংসলীলায় প্রাণ হারাল ইসলামী ছাত্রশিবিরের মুজাহিদ, শিপন, মাসুম, ফয়সাল রফিকসহ ইসলামী আন্দোলনের ১৪ জন ভাই। আমাদের মায়েরা হারালেন তাদের নাড়িছেঁড়া ধন প্রিয় সন্তানকে, দেশ হারালো কিছু সম্ভাবনাময়ী তরুণ এবং আগামী দিনের সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার সৎ, দক্ষ এবং দেশপ্রেমিক কিছু নাগরিক।

আজ ১০ বছর পার হল ২৮ শে অক্টোবরের। বিচার হয়নি সেই হত্যাকান্ডের হুকুমদাতা, নেতৃত্বদানকারী, সংঘটনকারী সেই সকল নর পিচাশদের। রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহার করা হয়েছে সকল মামলা। মুলত এই হত্যা ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার নীল নকশার সুচনা। যা আজকে ভোটার বিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসেছে জনগনের মাথার উপর। সরকারের এই মামলা প্রত্যাহারের মাধ্যমে একদিকে মানবতাকে লাঞ্ছিত করেছে, আহত নির্যাতিত মানুষের আর্তনাদ, ছেলে হারা, স্বামী হারা, মা-বোনদের হৃদয়ের আকুতিকে পদদলিত করেছে। আর সেই জন্য ২৮ শে অক্টোবরের ক্ষত চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছে সমগ্র বাংলাদেশ।

আজকে হত্যা এবং সন্ত্রাসকে সরকার রাষ্ট্রীয়করণ করেছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদেরকে বাসায় ঘুম থেকে তুলে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধার এবং বন্দুক যুদ্ধের নাটক সাজিয়ে হত্যার উৎসবে মেতে উঠেছে। আজকে একই সময়ে মা যখন তার নবাগত সন্তানের প্রসব বেদনায় চিৎকার করছেন ঠিক সেই মুহূর্তে বাবা চিৎকার করেছেন পুলিশের গুলিতে মৃত্যু পথ যাত্রী হয়ে। মাত্র সাড়ে সাত মাসের ব্যাবধানে এক ঝিনাইদহতে হত্যা করা হয়েছে জামায়াত শিবিরের ১১ জনকে।

তাদের সর্বশেষ স্বীকার ঝিনাইদহ শহর জামায়াতের আমীর জহুরুল ইসলাম ভাই এবং বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাকা মহানগরীর পশ্চিম শাখার সাবেক কলেজ কার্যক্রম সম্পাদক ডাঃ খন্দকার তারেক হাসান সজিব। তার মাত্র ২৪ দিন বয়সী ২টি যমজ মেয়ে কোনদিন দেখতে পারবেনা তাদের জন্মদাতা পিতাকে। আর বাবা দেখে যেতে পারেনি তার প্রিয় সন্তানের মুখ। গত ২৫ শে অক্টোবর সকালে দেড়মাসে আগে বাসা থেকে উঠিয়ে নিয়ে তাদেরকে বন্দুক যুদ্ধের নাটক সাজিয়ে হত্যা করে। আজকে বাংলাদেশের প্রত্যেকটি জনপদ আওয়ামী সন্ত্রাস কবলিত।

সন্ত্রাসের উপর ভর করে দুনিয়ার কোন জালেম স্বৈরাচার তাদের ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে পারেনি, পারবেও না। যে সন্ত্রাসকে প্রশ্রয় দিয়ে ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে চেয়েছে সেই সন্ত্রাসের পথে তাদের ধ্বংস হয়েছে। দুনিয়ার ক্ষমতায় অন্ধ হয়ে মামলা উঠাতে পারেন, হত্যা করে উল্টো ভিক্টিম এবং তাদের পরিবারকে মামালা দিয়ে হয়রানী করতে পারেন। কিন্তু আল্লাহর আযাব থেকে রক্ষা করতে পারবেন না নিজেকে। যাদেরকে হত্যা করেছেন, তাদের বাবা মা, ভাই-বোন, সন্তানদের নির্ঘুম চোখের পানির ফরিয়াদ তোমাদের জন্য কেয়ামতের আযাব হিসেবে দেখা দিবে। আল্লাহ হচ্ছেন উত্তম বিচারক, এই বিচারের ভার আল্লাহর উপর থাকলো।

আমরা হতাশ নই, ভীতসন্ত্রস্তও নই। আমাদের কোন কিছু হারানোর ভয়ও নেই। আমরাতো আমাদের জান মালের বিনিময়ে জান্নাতের প্রত্যাশী। আমরা যার প্রতিনিধিত্ব করি তিনি তো সীমাহীন ক্ষমতার অধীকারী। দুনিয়ার কোন শাসক যতটুকুই ঔদ্ধত্য প্রকাশ করুক কিন্তু আল্লাহর সীমাকে অতিক্রম করার ক্ষমতা বা শক্তি রাখেন না। সুতরাং আজকে রাজনৈতিক বিবেচনায় যাই করেন না কেন একদিন অবশ্যই আপনাদেরকে জনতার আদালতে এবং আল্লাহর আদালতে হাজির হতেই হবে। আল্লাহর আদালত থেকে পালানোর পথ খুঁজে পাবেন না আর জুলুম নির্যাতন করে ইসলামী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকে মিথ্যা মামলা দিয়ে কারাগারে আটক করে, জুড়িশিয়াল কিলিং এর মাধ্যমে আমাদের অগ্রযাত্রাকে রুদ্ধ করে দেয়া ইতঃপূর্বে যেমন কোন জালেম অথবা ইসলামবিরোধী শক্তির দ্বারা সম্ভব হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না ইনশাল্লাহ। বরং জুলুম, নির্যাতন এবং ঈমানী পরীক্ষার এই শাশ্বত কঠিন পথ ধরে অবধারিত সোনালি সূর্য একদিন উদিত হবেই ইনশাআল্লাহ।
তাই আমরা বলছি-

‘‘আমাদের গতি সত্যের পথে
কোন বাধা আজ মানবে না
বিজয় আছে সম্মুখে তাই
মুক্তির এ মিছিল থামবে না।”

Logo-orginal