, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

Avatar rtm

অব্যবস্থাপনা, অতিরিক্ত ভিড় ও আগে পাওয়ার প্রতিযোগিতার কারণে সাতকানিয়ায় পদদলন

প্রকাশ: ২০১৮-০৫-১৭ ০৯:২৭:৩০ || আপডেট: ২০১৮-০৫-১৭ ০৯:৩৪:০৪

Spread the love
অব্যবস্থাপনা, অতিরিক্ত ভিড় ও আগে পাওয়ার প্রতিযোগিতার কারণে সাতকানিয়ায় পদদলন

আরটিএমনিউজ২৪ডটকম: অব্যবস্থাপনা, মানুষের অতিরিক্ত ভিড়, আর ইফতার সামগ্রী ও জাকাতের টাকা আগে পাওয়ার প্রতিযোগিতার কারণে সাতকানিয়ার নলুয়া এলাকায় পদদলনে ১০ নারী-শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় এলাকাবাসী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা।

তারা জানান, বিপুল সংখ্যক মানুষের মধ্যে ইফতার ও জাকাত বিতরণের ক্ষেত্রে যেসব প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া দরকার ছিল কেএসআরএম কর্তৃপক্ষ সেটি করতে পারেনি, যে কারণে ঘটনার সময় সেখানে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এক পর্যায়ে ইফতার নেওয়ার জন্য মহিলারা হুড়োহুড়ি শুরু করেন। এই হুড়োহুড়ি থেকেই প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।

নলুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তসলিমা আবছার বলেন, ‘মাদ্রাসার মাঠটিতে সর্বোচ্চ ১০ হাজার লোক জড়ো হতে পারবে। সেখানে ওই মাঠে ২০ থেকে ৩০ হাজার মানুষের সমাগম হয় সেদিন। অতিরিক্ত লোক সমাগমের বিষয়টি যদি উনারা (কেএসআরএম) আগে থেকে না জেনে থাকেন, তবে আমি বলবো অবশ্যই এখানে উনাদের অব্যবস্থাপনা ছিল। বিষয়টি আরও সুশৃঙ্খল হওয়া উচিত ছিল।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি নিজেও শুনেছি মাঠের একপাশের গেট খুলে দেওয়ার কারণে ঘটনার সময় মাঠে হুড়োহুড়ির ঘটনা ঘটে। এতে পদদলিত হয়ে ওই শিশুসহ ১০ নারী মারা যেতে পারেন। আবার অনেকে আগের দিন রাত থেকে সেখানে অবস্থান করেছিল। অভুক্ত থাকার কারণে মাত্রাতিরিক্ত গরম থেকে হিটস্ট্রোক হয়েও মারা যেতে পারে। তদন্ত শেষে ঘটনার প্রকৃত কারণ রেরিয়ে আসবে।’

তসলিমা আবছার বলেন, ‘ইফতার সামগ্রী ও জাকাতের টাকা বিতরণের সময় অন্যান্য বছর কেএসআরএম কর্তৃপক্ষ গ্রহীতাদের কার্ড দিতো। কিন্তু এবার তারা সেটি করেনি। কার্ড না থাকায় যে কেউ এসে লাইনে দাঁড়াতে পেরেছেন। এতে ঘটনাস্থলে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে।’

আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল ১৪ মে সোমবার কাদেরিয়া মঈনুল উলুম দাখিল মাদ্রাসা মাঠে কেএসআরএম গ্রুপের মালিক মোহাম্মদ শাহজাহানের পক্ষ থেকে ইফতার সামগ্রী বিতরণ করা হবে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, খবর পেয়ে সাতকানিয়ার বিভিন্ন ইউনিয়ন ছাড়াও লোহাগাড়া, চন্দনাইশ, বাঁশখালী ও পার্বত্য জেলা বান্দরবানের অসচ্ছল লোকজনও রবিবার বিকাল থেকে ওই এলাকায় ভিড় করতে শুরু করেন। সকাল সকাল লাইনে দাঁড়ানোর জন্য অনেকে রাস্তায় রাত কাটিয়ে দিয়েছেন। কেউ কেউ রবিবার বিকালে এসে আত্মীয়–স্বজনদের বাড়িতে অবস্থান নেন। মাদ্রাসার মাঠ ছাড়াও এলাকার প্রত্যেকটি রাস্তায় মানুষের ভিড় ছিল। ফজরের নামাজের আগে থেকে কাদেরিয়া মাদ্রাসা মাঠে লোকজন আসতে শুরু করেন। সকাল হতে না হতেই পুরো মাঠ এবং আশপাশের রাস্তা ও অলি-গলিতে লোকজনের ভিড় জমে যায়। সকাল ৮টা থেকে জাকাত ও ইফতার সামগ্রী বিতরণ শুরু হয়। তখন উপস্থিত লোকজনের মধ্যে কার আগে কে নেবে এ নিয়ে হুড়োহুড়ি লেগে যায়।

মাদ্রাসার মাঠে যে শামিয়ানা খাটানো হয়েছে তাতে সর্বোচ্চ ৫ থেকে ৬ হাজার লোক অবস্থান নিতে পারবেন। অথচ প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ঘটনার সময় ওখানে লোক ছিল ২৫ থেকে ৩০ হাজার। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিশাল সংখ্যক এই মানুষের জন্য সেখানে মাত্র ৫০টি স্টান্ড ফ্যানের ব্যবস্থা ছিল। পর্যাপ্ত স্বেচ্ছাসেবকও ছিল না। প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন জানিয়েছেন, বিশাল সংখ্যক এই লোক সমাগম নিয়ন্ত্রণে মহিলা পুলিশের মাত্র ৫০ থেকে ৬০ জন সদস্য নিয়োজিত ছিলেন। এর বাইরে কেএসআরএম এর ২০০ জনের মতো নিজস্ব স্টাফ ছিলেন। তারাই সব লোকের শৃঙ্খলার দায়িত্ব পালন করেছেন।

জানা যায়, ‘ইফতার সামগ্রী ও জাকাত নেওয়ার জন্য ওই দিন দূর-দূরান্ত থেকে যেসব মহিলা এসেছেন তাদের প্রথমে মাঠে প্রবেশ করানো হয়। মাঠের এক পাশে ইফতার সামগ্রী ছিল। ইফতার সামগ্রী দিয়ে ওই পাশ দিয়ে তাদের বের করে দেওয়া হয়। সকাল ৯টা পর্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে ইফতার সামগ্রী বিতরণ চলছিল। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সমাগম বাড়তে থাকে। তখনই বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, ‘ইফতার সামগ্রী বিরতণ শুরুর পর চারদিক থেকে প্রচুর পরিমাণ মানুষ আসতে থাকে। এসময় মাঠে প্রবেশ করতে গিয়ে মহিলারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। হুড়োহুড়ি করে ইফতার সামগ্রী নিতে আসার চেষ্টা করলে নিরাপত্তাকর্মীরা তাদের লাঠি চার্জ করে। এসময় কিছু মহিলা চাপাচাপিতে মাটিতে পড়ে যান। অন্যরা তাদের চাপা দিলে এ ঘটনা ঘটে।’

স্থানীয় এক মাদ্রাসার শিক্ষক শামসুল আলম বাদশা বলেন, ‘হুড়োহুড়িতেই হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। বার বার নিষেধ করার পরও মহিলারা কারও কথা শোনেননি। কার আগে কে ইফতার সামগ্রী গ্রহণ করবেন এই নিয়ে তারা প্রতিযোগিতা শুরু করে দেন। কার্ড না দেওয়ায় একজন মহিলা একাধিকবার নেওয়ারও চেষ্টা করেছেন।’ তিনি জানান, ইফতার সামগ্রী নেওয়ার জন্য ওই সময় লোকজন একটি পুকুরের হাঁটু পরিমাণ পানিতে ভিজে মাঠে প্রবেশের চেষ্টা করেন।

কেএসআরএম’র কারখানার উপ-মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘আমাদের পরিকল্পনা ছিল মোট ২০ হাজার মানুষকে ইফতার সামগ্রী ও জাকাত প্রদান করবো। এর মধ্যে প্রথম দিন ১০ হাজার মানুষকে ইফতার সামগ্রী দেওয়া হবে। সেই অনুযায়ী আমরা সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। আমরা মাঠে ডাক্তার, অ্যাম্বুলেন্স ব্যবস্থাও রেখেছিলাম। কিন্তু, হঠাৎ মানুষের চাপ বেড়ে যাওয়ায় মাঠে আমাদের পরিকল্পনার বাইরে মানুষ অবস্থান নেয়। তখন অতিরিক্ত গরমের কারণে ডিহাইড্রেশন ও হিটস্ট্রোকে তারা মারা যেতে পারেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘শৃঙ্খলার দায়িত্বে ওই দিন পুলিশের ১০০ জন সদস্যের বাইরে ২৫০ জনের মতো আমাদের নিজস্ব স্টাফ ছিল। তারা সবাই শৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। প্রথম দিকে মহিলারা ঠিকমতোই লাইনে এসে ইফতার সামগ্রী গ্রহণ করেছিলেন। তখন মসজিদের সামনে থেকে ইফতার সামগ্রী বিতরণ করা হয়। পরে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যখন মানুষের চাপ বেড়ে যাওয়ায় তখন আমরা পাশের গেটসহ আরও দুইটি জায়গা থেকে ইফতারি বিতরণ শুরু করি।’

সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘কার্ড না দেওয়ায় একই পরিবারের একাধিক লোক ইফতার সামগ্রী সংগ্রহ করতে এসেছিলেন। যে কারণে এবার আমাদের পরিকল্পনার বাইরে জনসমাগম হয়েছে।’

উল্লেখ্য, গত ১৪ মে সোমবার সকাল সাড়ে ১০টায় সাতকানিয়া উপজেলার নলুয়া ইউনিয়নের গাটিয়াডেঙ্গা গ্রামে কাদেরিয়া মুঈনুল উলুম দাখিল মাদ্রাসা মাঠে ইফতার সামগ্রী ও জাকাত বিতরণের সময় পদদলনে শিশুসহ ১০ নারী নিহত হন। ঘটনার  সময় পুলিশ ওই ১০ জন হিটস্ট্রোকে মারা গেছেন বলে সংবাদ মাধ্যমকে জানায়। পরে জানা যায়, কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনার কারণে পদদলনে তারা মারা গেছেন।

এ ঘটনায় ১৫ মে মঙ্গলবার সকালে নিহত হাসিনা আক্তারের স্বামী মোহাম্মদ ইসলাম থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলায় কেএসআরএমের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ শাহজাহানকে প্রধান আসামি করে ইফতার সামগ্রী বিতরণের সঙ্গে জড়িতদের অজ্ঞাত আসামি করা হয়। ওই মামলায় থানা পুলিশ একই দিন বিকালে ইফতার সামগ্রী বিতরণ কাজে নিয়োজিত থাকা চারজনকে গ্রেফতার করেছে। পরদিন বুধবার তাদের চট্টগ্রামের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হলে চারজনের আইনজীবীরা জামিনের আবেদন করেন। পরে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মাহমুদুল হাসান আদালতে চার্জশিট দাখিল না হওয়া পর্যন্ত ওই চারজনের জামিন আবেদন মঞ্জুর করেন।

Logo-orginal