, মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪

admin admin

নবাব বাড়ীর ঐতিহাসিক মসজিদে কখনো বন্ধ হয়না কুরআন তেলাওয়াত

প্রকাশ: ২০১৮-০৫-২৪ ১৪:০৫:৫৮ || আপডেট: ২০১৮-০৫-২৪ ১৪:০৫:৫৮

Spread the love

নবাব বাড়ীর ঐতিহাসিক মসজিদে কখনো বন্ধ হয়না কুরআন তেলাওয়াত
টাঙ্গাইল জেলার ধনবাড়ী উপজেলার প্রাণকেন্দ্রে পৌরসভায় অবস্থিত ধনবাড়ী নওয়াব শাহী জামে মসজিদ। প্রাচীন স্থাপত্য শিল্পের ধারক ও বাহক টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী নওয়াব শাহী জামে মসজিদ ইসলামি ঐতিহ্য ও কালের সাক্ষী হয়ে স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে। এটি ধনবাড়ী উপজেলার ঐতিহাসিক স্থাপত্যের অন্যতম নির্দশন।

ষোড়শ শতাব্দীতে সেলজুক তুর্কি বংশের ইসপিঞ্জার খাঁ ও মনোয়ার খাঁ দুই ভাই ঐতিহ্যবাহী এ মসজিদটির প্রথম খণ্ড (এক কক্ষ বিশিষ্ট মসজিদ) নির্মাণ করেন। জনশ্রুতিতে জানা যায়, সম্রাট আকবরের সময় এ দুই ভাই ধনবাড়ীর অত্যাচারী জমিদারকে পরাজিত করার পর এ অঞ্চলের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং এ মসজিদটি নির্মাণ করেন।

বাংলাভাষার প্রথম প্রস্তাবক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, যুক্ত বাংলার প্রথম মুখ্যমন্ত্রী ধনবাড়ির বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী প্রায় ১১৫ বছর আগে এ মসজিদটি সম্প্রসারণ করে আধুনিক রূপ দেন। মসজিদের ভেতরের দেয়ালে কড়ি পাথরের লতাপাতা আঁকা অসংখ্য রঙিন নকশা ও কড়ি পাথরের মোজাইক করা প্রাচীন স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন পরিলক্ষিত হয় মসজিদটিতে। মসজিদটির দেয়ালের বাইরের অংশেও রয়েছে সিমেন্ট আর কড়ি পাথরের টোরাকাটা নকশা। মসজিদটি প্রায় ১০ কাঠা জমির ওপরে অবস্থিত।

সংস্কারের আগে মসজিদটি ছিল আয়তাকার। তখন এর দৈর্ঘ্য ছিল ১৩.৭২ মিটার (৪৫ ফুট) এবং প্রস্থ ছিল ৪.৫৭ মিটার (১৫ ফুট) কিন্তু সংস্কারের পর মসজিদটির আকার রীতিমতো পরিবর্তিত হয়ে যায়। বর্তমানে এটি একটি বর্গাকৃতির মসজিদ এবং সাধারণ তিনগম্বুজ বিশিষ্ট আয়তাকৃতির মুঘল মসজিদের সাথে বৈসাদৃশ্যপূর্ণ। সংস্কারের পর মসজিদের প্রাচীনত্ব কিছুটা লোপ পেলেও এর চাকচিক্য ও সৌন্দর্য অনেক বেড়েছে। সুন্দর কারুকার্যময় এ মসজিদের পূর্বদিকে বহু খাঁজবিশিষ্ট খিলানযুক্ত তিনটি প্রবেশপথ, এছাড়া উত্তর ও দক্ষিণে আরো একটি করে সর্বমোট পাঁচটি প্রবেশ পথ রয়েছে।

মসজিদটির চর্তুদিক থেকে ৪টি প্রবেশ পথ এবং ৯টি জানালা রয়েছে। ৩৪টি ছোট ও বড় গম্বুজ রয়েছে। বড় ১০টি মিনারের প্রত্যেকটির উচ্চতা ছাদ থেকে প্রায় ৩০ ফুট উঁচু। মসজিদের দোতলার মিনারটির উচ্চতা প্রায় ১৫ ফুট। ৫ ফুট উচ্চতা এবং ৩ ফুট প্রস্থের মেহরাবটি দেখতে আকর্ষণীয় এবং সুপ্রাচীন। এখানে বসে ইমাম খুতবা পাঠ করেন।

প্রবেশপথ। সোর্স: Biddut Khoshnobish’s Blog

আর মসজিদের নকশা দেখে তো মাথা ঘুরে গেছে। পুরো মসজিদের মেঝে আর দেয়াল কাঁচের টুকরো দিয়ে নকশাদার মোজাইক করা। মেঝেতে মার্বেল পাথরে খোদাই করা নিপুণ কারুকার্য অসাধারণ। ভেতরের সব জায়গাতেই চীনামাটির টুকরো দ্বারা মোজাইক নকশায় অলংকৃত, যার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফুলের নকশা দৃশ্যমান। এতগুলো বছরে একটু ফাটল পর্যন্ত ধরেনি সেই নকশায়। মসজিদটির সুউচ্চ ৩০ ফুট উচ্চতার মিনারের চূড়ায়, ১০টি তামার চাঁদ মিনারের সৌন্দর্যকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এর সংরক্ষিত কক্ষে শোভা পাচ্ছে ১৮টি হাড়িবাতি, যা নারিকেল তেল দ্বারা আলো জ্বালানোর কাজে ব্যবহৃত হতো। রয়েছে মুঘল আমলে ব্যবহৃত ৩টি ঝাড়বাতিও। মসজিদ নির্মাণে চুন, সুরকি, সাদা সিমেন্ট, কড়ি পাথর, লোহার খাম ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়েছে।

মসজিদের পাশেই রয়েছে শান বাঁধানো ঘাট ও কবরস্থান। যেখানে দাফন করা হয়েছে নওয়াব বাহাদুর সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরীকে। নবাব নওয়াব আলী মৃত্যুর আগে তার এ স্টেট ওয়াকফ করে যান। ওয়াকফকৃত সম্পদেই মসজিদ ও পাশে অবস্থিত মাদ্রাসা, ঈদগাহ ইত্যাদি পরিচালিত হয়ে আসছে। সুপ্রাচীন এ মসজিদটিতে একসঙ্গে ২০০ মুসল্লির নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা রয়েছে।

মসজিদের গম্বুজ।

৭০০ বছরের পুরোনো এই মসজিদে ১৯২৯ সালে নবাবের মৃত্যুর পর থেকে ২৪ ঘণ্টা কোরআন তিলাওয়াত হচ্ছে, যা এখনো এক মিনিটের জন্য বন্ধ হয়নি। বর্তমানে সাতজন কারি নিযুক্ত রয়েছেন। তাঁরা প্রতি দুই ঘণ্টা পরপর একেকজন কোরআন তিলাওয়াত করে থাকেন। এটি বিশ্বের বুকেও একটি বিরল ঘটনা।

সুন্দর কারুকার্যময় এ মসজিদের পূর্বদিকে বহু খাঁজবিশিষ্ট খিলানযুক্ত তিনটি প্রবেশপথ, এ ছাড়া উত্তর ও দক্ষিণে আরো একটি করে সর্বমোট পাঁচটি প্রবেশপথ রয়েছে। মসজিদটি বর্ধিতকরণ ও সংস্কার সাধনের পরেও এর ওপরের তিনটি গম্বুজ ও পাঁচটি প্রবেশপথে প্রাচীনত্বের ছাপ লক্ষ করা যায়।

প্রচলিত নিয়মে এ মসজিদের পূর্বদিকের তিনটি প্রবেশপথ বরাবর এর অভ্যন্তরে কিবলা দেয়ালে তিনটি মিহরাব নির্মিত। কেন্দ্রীয় মিহরাবের কুলুঙ্গিটি অষ্টভুজাকার ও বহু খাঁজবিশিষ্ট খিলান সহযোগে ফুলের নকশায় অলংকৃত। উভয় পাশের দুটিও বহু খাঁজবিশিষ্ট খিলানযোগে গঠিত, তবে অলংকারহীন। কেন্দ্রীয় মিহরাবের পাশে একটি মিম্বার রয়েছে।

মসজিদের পাশে রয়েছে ৭ বিঘা আয়তনের এক বিশাল আয়তাকার দীঘি। খাড়া সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে দীঘি দর্শন করলাম। এরকম চারকোনা দীঘি আমি কখনোই দেখিনি।

কিন্তু বর্তমানে ময়লা-আবর্জনায় ঐতিহ্য হারাচ্ছে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী নওয়াব বাড়ির ঐতিহ্যবাহী দীঘিটি। শতাধিক বছরের পুরনো এ দীঘির পাড়ে নির্মিত বসতবাড়ির নিত্য ব্যবহার্য আবর্জনা ফেলে ও পয়ঃনিষ্কাশনের পাইপ লাইনের নোংরা পানিতে দূষিত হচ্ছে পানি।

ফলে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে এটি। ভরাট হয়ে যাচ্ছে দীঘির তলদেশও। নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ, ছড়াচ্ছে রোগ-জীবাণু। একসময় এতে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষ হতো, চলতো মাছ ধরার প্রতিযোগিতা। এখন আর আগের মতো মাছ চাষ হয় না। ধনবাড়ীর নওয়াব বাড়ির এই দীঘি উত্তর টাঙ্গাইলের সবচেয়ে বড় দীঘি। শুষ্ক মৌসুমে সব পুকুরের পানি শুকিয়ে গেলেও এ দীঘির পানি স্থির থাকে।

প্রায় ৩০ বিঘা জমির উপর বিশাল এ দীঘির রয়েছে সুন্দর শান বাঁধানো ঘাট। এখানে মুসল্লিরা অজু করেন। মসজিদ পরিচালনার জন্যই এ দীঘি নির্মাণ করা হয়েছিল। দীঘিতে দর্শনার্থীদের ঘোরার জন্য রয়েছে দুটি সাম্পান, চড়তে পারেন আপনিও। কিন্তু দয়া করে ওতে ময়লা ফেলবেন না।

নওয়াবদের বাড়ি-মসজিদ দেখা শেষ করে ভ্যানে চড়ে বাসস্ট্যান্ডে ফিরলাম। পাবনার মতো টাঙ্গাইলেও ভ্যান চলে। তিন ঘন্টার বিরক্তিকর জার্নি শেষে যখন বাসায় পৌঁছালাম, তখন আর শরীরে এতটুকু শক্তি নেই।

কীভাবে যাবেন:

মহাখালীর টাঙ্গাইল বাসস্ট্যান্ড থেকে ঢাকা-ধনবাড়ী সরাসরি বাস সার্ভিস চালু আছে। বিনিময়, মহানগর কিংবা শুভেচ্ছা পরিবহনে ১৫০-২০০ টাকা ভাড়ায় পৌঁছাতে পারবেন ধনবাড়ী। ধনবাড়ী বাসস্ট্যান্ড থেকে অদূরেই জমিদারবাড়ি, ইচ্ছে করলে হেঁটে, ভ্যানগাড়ি কিংবা রিকশায় পৌঁছাতে পারেন সেখানে।

আলাদা করে মসজিদ, দীঘি দেখতে আসার দরকার নেই। জমিদারবাড়ির সাথেই এসব দেখতে পারবেন। বাসস্ট্যান্ড থেকে পায়ে হেঁটে ৫/৭ মিনিট লাগবে নবাব প্যালেসে যেতে। শুধু ধনবাড়ী বেড়ানোর উদ্দেশ্য হলে দিনে গিয়ে দিনেই ফেরা সম্ভব, সে জন্য সাতসকালে যাত্রা শুরু করতে হবে। টাঙ্গাইল হয়ে ধনবাড়ীর পথ একটু বেশি। সে ক্ষেত্রে নিজস্ব বাহন ভালো।

দীঘি এবং শানবাঁধানো ঘাট।

এখানে থাকতে পারবেন নবাবি স্টাইলে। তবে সেটা নির্ভর করবে আপনার সামর্থ্যের ওপর। রয়েছে চার ধরনের আবাসন ব্যবস্থা। মঞ্জিল (মূল রাজপ্রাসাদ), প্যালেস (কাচারি ঘর), ভিলা (২০০ বছরের পুরোনো টিনশেড ভবন) এবং কটেজ (সম্প্রতি নির্মিত টিনশেড বাংলো)। মঞ্জিল এবং প্যালেসের খাট, সোফাসহ সব আসবাবপত্র সেই প্রাচীন আমলের যা নবাবরা ব্যবহার করতেন। কিন্তু ভিলা এবং কটেজে নবাবদের আসবাবপত্র পাওয়া যাবে না।

ভাড়া এক থেকে পাঁচ হাজার টাকা। দল বেঁধে গেলে পাওয়া যাবে বিরাট ছাড়। তা ছাড়া থাকতে পারেন ধনবাড়ী নওয়াব প্যালেসের অদূরে মধুপুর উপজেলা সদরে অবস্থিত আদিত্য, সৈকত এবং ড্রিমটাচ নামের তিনটি আবাসিক হোটেলে। এগুলোতে রয়েছে এসি এবং নন এসি রুমের সুন্দর ব্যবস্থা।

রিসোর্টের ভেতরে প্রবেশ করতে আপনাকে খরচ করতে হবে মাত্র ৩০ টাকা। মসজিদ-দীঘি ওই একই টিকিটে ঘুরতে পারবেন। সুত্র: ইন্টারনেট।

Logo-orginal