, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

admin admin

টাকার বিনিময়ে এমপি পুত্র শাবাবের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারের প্রস্তাব

প্রকাশ: ২০১৮-০৬-২৩ ১৪:৩৬:৩৭ || আপডেট: ২০১৮-০৬-২৩ ১৪:৩৬:৩৭

Spread the love

টাকার বিনিময়ে এমপি পুত্র শাবাবের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারের প্রস্তাব
সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরীর পরিবারের মালিকানাধীন একটি গাড়ির চাপায় প্রাণহানির ঘটনায় দায়ের করা মমলা প্রত্যাহারের জন্য এমপির পক্ষ থেকে টাকার বিনিময়ে আপসের প্রস্তাব পেয়েছে নিহতের পরিবার। খবর বিডিনিউজ২৪ডটকমের।

গত মঙ্গলবার রাতে ওই দুর্ঘটনায় নিহত সেলিম ব্যাপারীর (৫৫) পরিবার বলছে, অন্তত ‘মাস চলার মত’ কিছু টাকা ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট করে দেওয়ার বিনিময়ে মামলা তুলে নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে তাদের।

নিহত সেলিম ব্যাপারী দুই যুগের বেশি সময় ধরে নাওয়ার প্রোপার্টিজের গাড়িচালক হিসেবে চাকরি করে আসছিলেন। গত মঙ্গলবার রাতে ঢাকার বিমানবন্দর সড়কে একটি গাড়ির ধাক্কায় তিনি নিহত হন।

ওই গাড়ির মালিক নোয়াখালী সদরে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য একরামুল করীম চৌধুরীর স্ত্রী কামরুন্নাহার শিউলীর। এই সাংসদপত্নী নোয়াখালীর কবিরহাট উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান।

দুজন প্রত্যক্ষদর্শী দাবি করেছেন, দুর্ঘটনার সময় ওই গাড়িটি চালাচ্ছিলেন সাংসদপুত্র শাবাব চৌধুরী। অন্যদিকে শাবাবের মায়ের ভাষ্য, দুর্ঘটনার সময় গাড়িটি চালাচ্ছিলেন তাদের একজন ড্রাইভার, শাবাব নয়।

সেলিম ব্যাপারী যেখানে চাকরি করতেন, সেই নাওয়ার প্রোপার্টিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইমরান হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এমপি একরামুল করিম চৌধুরী বৃহস্পতিবার রাতে তাকে ফোন করে ‘সমঝোতার প্রস্তাব’ দেন।

“তিনি চান, নিহতের পরিবারের পাশে থাকার বিনিময়ে তারা কাফরুল থানায় করা মামলা প্রত্যাহার করে নেবে। ফোনে কথা বলার পর এমপি সাহেব আমার বারিধারার অফিসে লোক পাঠিয়েছিলেন সমঝোতার বিষয়ে আলোচনার জন্য।”

ইমরান হোসেন জানান, সাংসদ বা তার পরিবার বা পুলিশের কেউ ওই বৈঠকে ছিল না। তবে নিহত সেলিম ব্যাপারীর স্ত্রী, মেয়ে, মেয়ের জামাইসহ কয়েকজন আত্মীয় সেখানে ছিলেন।

নিহত সেলিম ব্যাপারী নিহত সেলিম ব্যাপারী “সেলিম ছিল পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার পরিবার যেন বাঁচতে পারে সেজন্য ৩০ লাখ টাকার একটা ফিক্সড ডিপোজিট করে দিতে এমপি সাহেবকে অনুরোধ করেছি।”
সেলিমের পরিবার সমঝোতায় রাজি কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “টাকা পয়সা দিয়ে তো জীবনের দাম হবে না। আবার মামলা চালিয়েই বা কী হবে? পরিবারটির দিকে তাকিয়েই মূলত এমপি সাহেবের সমঝোতার প্রস্তাবে সাড়া দিয়েছি। এমপি সাহেব কথা দিয়েছেন, দুই একদিনের মধ্যে এর মীমাংসা করবেন। তার প্রতি আমরা আস্থা রেখেছি।”

আওয়ামী এমপি পুত্র শাবাব

সমঝোতার বিষয়ে জানতে চাইলে সেলিম ব্যাপারীর মেয়ের জামাই আরিফ ভূঁইয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গতকাল রাতে ইমরান স্যারের অফিসে আমরা এমপি সাহেবের লোকজনের সাথে সমঝোতার বিষয়ে কথা বলেছি। এখানে ইমরান স্যার যা সিদ্ধান্ত দেবেন সেটাই আমাদের পরিবারের সিদ্ধান্ত।”

সমঝোতার প্রস্তাবের বিষয়ে কথা বলতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পক্ষ থেকে নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য একরামুল করিম ও তার স্ত্রী কামরুন্নাহার শিউলির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তারা ফোন ধরেননি।

সেই রাতে দুর্ঘটনার পর গাড়ি অনুসরণ করে ন্যাম ভবনে গিয়ে এর সঙ্গে এমপিপুত্র শাবাবের ‘সম্পৃক্ততার কথা’ জানতে পারেন শামীম আশরাফি নামে ধানমণ্ডি এলাকার এক ব্যবসায়ী। রাতেই তিনি কাফরুল থানায় গিয়ে বিষয়টি অবহিত করেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে সেদিন তিনি বলেন, তিনি ও তার এক বন্ধু একটি টয়োটা হ্যারিয়ার গাড়িতে ছিলেন। রাত ১০টার পরে বনানী পার হয়ে ধানমণ্ডি যাওয়ার পথে একটি সাদা অডি গাড়িকে একটা মটরসাইকেল অনুসরণ করছে দেখে কৌতূহলবশত পিছু নেন।

শাবাব চৌধুরী, ফেইসবুক থেকে নেওয়া ছবি শাবাব চৌধুরী, ফেইসবুক থেকে নেওয়া ছবি “এক পর্যায়ে গাড়িটি ন্যাম ভবনে ঢুকে পড়ে। সেই সঙ্গে মোটরসাইকেলটি ঢুকে পড়ে। পরে আমরাও ঢুকে পড়ি। ন্যাম ভবনে প্রবেশ করার আগে গার্ডকে জিজ্ঞাসা করতেই সে জানায়, ওই গাড়িতে নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য একরামুল করিমের ছেলে শাবাব চৌধুরী আছেন।
“গাড়ির কাছে গিয়ে দেখি শাবাব চৌধুরী মটরসাইকেলের আরোহীর মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে তাকে কিল-ঘুষি মারতে চাইছেন। আমি এগিয়ে গিয়ে ওকে মারছেন কেন প্রশ্ন করে নিজের পরিচয় দিই। শাবাব চৌধুরী মোটরসাইকেল আরোহীর ফোন কেড়ে নিয়ে ফোনের দাম দিতে চাইছেন কেন জানতে চাই।

“তখন শাবাব খুব স্বাভাবিক ও ভাবলেশহীনভাবে এগিয়ে এসে বলেন, একটা বাসের সাথে গাড়ির ধাক্কা লেগেছে। পরে মটরসাইকেল আরোহী বলেন, আপনার গাড়ির চাপায় একজন মারা গেছে। তার ভিডিও ফুটেজও আমার কাছে রয়েছে। এরপর ওই যুবক শাবাবকে বলেন, তোমার ভুল হয়েছে। যিনি মারা গিয়েছেন তার পরিবারের কাছে গিয়ে ক্ষমা চাও। তাদের ক্ষতিপূরণ দাও।

“কিন্তু শাবাব তাকে বলেন, আমরা সোসাইটির কোন লেভেল মেইনটেইন করি তা তো জানো। তোমরা চলে যাও। এমনটা হতেই পারে। এরপর মটরসাইকেলআরোহীকে উদ্দেশ করে উনি বলেন, ওর ফোনে ভিডিও আছে, তাই নিয়েছি। কত কোটি টাকা লাগবে বল, বিষয়টা তোমরা চেপে যাও।”

ন্যাম ভবনের ৫ নম্বর ব্লকের নৈশপ্রহরী নজরুল ইসলাম সেদিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রাতে ন্যাম ভবনের ৫ ও ৪ নম্বর ব্লকের মাঝামাঝি শাবাব সাহেবকে ৫-৬ জন ছেলে-মেয়েসহ দেখা যায়। সেখানে কোনো ঝামেলা হয়েছে বলে মনে হয়। পরে তাদের গাড়িচালক নুরুল আমিন বলেন, তিনি সেদিন গাড়ি নিয়ে বের হননি। শাবাব সাহেব গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করেছেন।

“ন্যাম ভবনের নিচে শাবাব সাহেবই গাড়ি রেখে যান। নুরুল আমিনকে বলি, আপনি গাড়িতে থাকলে তো সমস্যা হয়ে যেত।”

অবশ্য শাবাবের মা শিউলী সেদিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে দাবি করেন, নুরুল আমিনই দুর্ঘটনার সময় ‘গাড়ি চালাচ্ছিলেন’।

নুরুল আমিন কোথায়- জানতে চাইলে শিউলী বলেন, তারাও ওই গাড়িচালককে এখন ‘খুঁজে পাচ্ছেন না’।

দুর্ঘটনার বিষয়ে নুরুল আমিন বা শাবাব চৌধুরী- কারও বক্তব্যই জানতে পারেনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।

সমঝোতার আলোচনার সময় দুর্ঘটনায় শাবাবের সম্পৃক্ততার বিষয়ে কথা হয়েছে কি না জানতে চাইলে নাওয়ার প্রোপার্টিজের এমডি ইমরান হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এমপি সাহেব সেটা সরাসরি স্বীকার না করলেও তাদের গাড়িতেই যে দুর্ঘটনা ঘটেছে এটা স্বীকার করেছেন। তিনি ভবিষ্যতেও সেলিম ব্যাপারীর পরিবারের পাশে থাকবেন বলে কথা দিয়েছেন।”

এদিকে গাড়িচাপায় একজনের মৃত্যুর পর মামলা হলে টাকার বিনিময়ে আপস রফার আইনি বৈধতা আছে কি না- সে প্রশ্নও উঠেছে।

ফৌজদারী মামলার অভিজ্ঞ আইনজীবী প্রকাশ বিশ্বাস বলেন, “এটি জামিনযোগ্য মামলা হলেও আপসযোগ্য নয়। মামলায় বাদীর টেকনিক্যাল সাক্ষ্য দিয়ে বাদীকে রিলিফ নিতে হবে।”

সমঝোতার ব্যাপারে জানতে কাফরুল থানার ওসি সিকদার মোহাম্মদ শামিমের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হলে ব্যস্ততার কথা বলে তিনি এড়িয়ে যান। পরে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই সুজন কর্মকারের মোবাইলে একাধিকবার কল করলেও তিনি ধরেননি।

তবে পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, যেহেতু নিহতের পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো না, বেশি দিন মামলা চালানোর সামর্থ্য তাদের নেই, সেহেতু অর্থের বিনিময়ে সমঝোতার একটি সম্ভাবনা এখানে আছে।

মামলার সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাইলে মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম শাখার উপ কমিশনার মো. মাসুদুর রহমান বলেন, সিসিটিভি ফুটেজ দেখে জড়িতদের শনাক্ত করার চেষ্টা করছেন তারা।

“গাড়ির নম্বর দেখে আগামী রোববার বিআরটিএ থেকে কাগজপত্র তোলা হবে। এরপর গাড়িটি জব্দ করে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া শুরু করবে পুলিশ।”

উভয়পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হয়ে গেলে সেক্ষেত্রে আইনি প্রক্রিয়াটা কী হবে জানতে চাইলে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “সেটি আদালতের বিষয়। সমঝোতা হয়ে গেলে সেই কাগজপত্রসহ মামলা আদালতে পাঠানো হবে। আদালত যে সিদ্ধান্ত দেবে সেটি সবাইকে মানতে হবে। তবে সমঝোতার ক্ষেত্রে পুলিশ কোনো ভূমিকা পালন করছে না। পুলিশ তদন্তের কাজ করছে।

Logo-orginal