, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

admin admin

জয় হল প্রেমের” হেরে গেল কোটিপতি বাবা-মা

প্রকাশ: ২০১৮-০৮-১৪ ১১:৫১:৫৬ || আপডেট: ২০১৮-০৮-১৪ ১১:৫১:৫৬

Spread the love

জয় হল প্রেমের” হেরে গেল কোটিপতি বাবা-মা
আদালতের রায়ের পর সোমবার আইনজীবীর কার্যালয়ে হাস্যোজ্জ্বল সৈকত পাল ও লিমা সাহা- সমকাল

এ যেন এক রূপকথার প্রেমকাহিনী। পরিচয় থেকে প্রেমের মধুময় ভুবনে হারিয়ে গিয়েছিলেন দুই তরুণ-তরুণী। অবধারিতভাবেই এরপর শুরু হয় বিয়োগান্ত অধ্যায়ের, নেমে আসে বাধার পাহাড়। শুরু হয় হিন্দি সিরিয়ালের মতোই নানা কূটচাল। শেষটা ছিল আরও রুদ্ধশ্বাস নাটকীয়তায় ভরপুর। তবে দুই তরুণ-তরুণীর প্রেমকে বাবা-মা মেনে না নিলেও আইনের চোখে তাদের মিলনে কোনো বাধা ছিল না। অবশেষে বিচারকের রায়ে শেষ হয় বিচ্ছেদ পর্বের সফল সমাপ্তি ঘটে দুর্নিবার প্রেমের। প্রতিবেদন দৈনিক সমকালের।

অবশেষে লিমা সাহাকে (২৮) তার প্রেমিক ও স্বামী সৈকত পালের (২৯) জিম্মায় দিয়েছেন আদালত।

ঢাকা জেলা প্রশাসকের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে তখন পিনপতন নীরবতা। একটু পরই রায় ঘোষণা করা হবে। ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের পুলিশ কনস্টেবল রওশনের পাশে নিশ্চুপ বসে ছিলেন লিমা রানী সাহা। তার কপালে সিঁদুর। হাতে শাঁখা। সবুজ রঙের সালোয়ার-কামিজ পরে মুখে গভীর চিন্তার ছাপ নিয়ে বসে থাকা লিমার মুখে কোনো সাড়া-শব্দ নেই। আদালতের কার্যক্রমের বিরতির সময় পুলিশের একজন সদস্য তাকে এক কাপ চা খাওয়ার প্রস্তাবও দেন। তবে লিমা অনড়। রায়ে ভালো কিছু শোনার আগ পর্যন্ত মুখে কিছু তুলতে চান না তিনি। সকাল থেকেই তার মুখে কিছু পড়েনি।

শেষ পর্যন্ত বিকেল ৫টার দিকে রায় ঘোষণা হলো। রায়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রেণু দাস জানান, লিমা সাহা প্রাপ্তবয়স্ক। বয়স ২৮ বছর। তিনি স্বেচ্ছায় সৈকত পালকে বিয়ে করেছেন। স্বামীর কাছেই তিনি থাকতে চান। একজন ব্যক্তিকে আটক রাখার অধিকার ম্যাজিস্ট্রেটের নেই। লিমা তার স্বামী সৈকত পালের কাছে থাকবেন। স্বামীর জিম্মায় লিমাকে দেওয়ার আদেশ দেওয়া হলো।

রায়টি শোনার পর হাসির আভা ফুটে ওঠে লিমার চোখে-মুখে। আদালত এলাকায় ‘প্রেমের জয়’ বলে হাততালি দেন সৈকতের আইনজীবীরা। সৈকতও তখন আনন্দে আত্মহারা। আদালতের জনাকীর্ণ পরিবেশেও স্ত্রীকে ভালোবাসার আলিঙ্গনে সিক্ত করেন সৈকত। এমন দৃশ্যে আনন্দাশ্রু নেমে আসে অনেকের চোখে।

এই রায়ের মধ্য দিয়ে প্রেম আর দ্রোহের এক অবিশ্বাস্য গল্প লিখে ফেললেন লিমা আর সৈকত। পরাজিত হলো আভিজাত্য আর ক্ষোভের আগুন।

রায়ের পরপরই জিম্মানামায় স্বাক্ষর করে স্ত্রী লিমাকে নিজ হেফাজতে নেন সৈকত। ততক্ষণে সেখানে মিষ্টিদ্রব্য নিয়ে হাজির লিমা ও সৈকতের সুহৃদরা। তারা তাদের মিষ্টি মুখ করাচ্ছেন। কেউ আবার ছবি তুলছেন।

ম্যাজিস্ট্রেট রেণু দাস তার রায়ে বলেন, ১৬ বছর বা তার ওপরের বয়সের যে কোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে তার ইচ্ছা প্রাধান্য পাবে। লিমা সাহার জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি প্রাপ্তবয়স্ক। লিমা তার মা-বাবার কাছে যেতে চান না। স্বামী সৈকত পালের কাছে থাকতে চান। সার্বিক বিবেচনায় ভিকটিমের জবানবন্দি অনুসারে লিমা সাহাকে তার স্বামী সৈকত পালের জিম্মায় প্রদান করা হলো।

রায়ের পর সৈকত পাল বলেন, প্রেমের জয় হলো। আভিজাত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে লিমাকে পেলাম। সবার আশীর্বাদ কামনা করেন তিনি। আদালত এলাকা থেকে বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে বের হওয়ার পর সৈকত ও লিমাকে বহনকারী গাড়িটিকে পেছন থেকে অনুসরণ করছিল দুটি গাড়ি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা পর্যন্ত তাদের অনুসরণ করতে থাকে। এরপর নিউমার্কেট থানা পুলিশকে অবহিত করলে পুলিশি পাহারায় লিমাকে নিয়ে সৈকত তার বোনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসায় ফেরেন।

লিমা সাহা বলেন, ‘এমন দিনের অপেক্ষায়ই ছিলাম। প্রেমের কথা জানার পর প্রথম দুই বছর নরসিংদীতে নিজ বাড়িতে আমাকে গৃহবন্দি রাখে পরিবার। সেখান থেকে কৌশলে মুক্তি পাওয়ার পর সৈকতকে বিয়ে করেছি। বিয়ের পর আবার পরিবার আমাকে তাদের জিম্মায় নেয়। এরপর মানসিক রোগী সাজিয়ে গুলশানের একটি রিহ্যাবিলেটশন সেন্টারে ভর্তি করায়।

সত্য ও বিশুদ্ধতার জয় হয়েছে। শুরু থেকে সৈকত পাশে থেকে সহায়তা না করলে প্রতিকূলতা আর ষড়যন্ত্রের পাহাড় পেরিয়ে এতদূর আসা সম্ভব হতো না।’

লিমা সাহা আরও বলেন, ‘বাবাকে ভুল বুঝিয়ে কিছু লোক তাকে বিপদগামী করেছে। তারা বাবার একগুয়েমি আচরণকে কাজে লাগায়। তার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ করতে চেয়েছে। এখনও মা-বাবার জন্য মনটা খারাপ লাগছে। তারা হয়ত এক সময় ভুল বুঝতে পারবেন। আমাদের সম্পর্ক সামাজিকভাবে মেনে নেবেন।’

২০১০ সালে নরসিংদী সরকারি কলেজে পড়ার সময় সৈকত পালের সঙ্গে পরিচয় হয় লিমা সাহার। ওই বছরই তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়। ২০১৫ সালে লিমার প্রেমের বিষয়টি জানতে পারে তার পরিবার। এরপর থেকে প্রায় দুই বছর লিমাকে কার্যত তাদের বাসায় গৃহবন্দি করে রাখা হয়। চলতি বছরের ২৩ মে লিমাকে তার বাবা কলকাতায় নিয়ে যান। কলকাতা পুলিশের সহায়তায় দেশে ফিরে ২৪ মে লিমা ও সৈকত বিয়ে করেন। এরপর কৌশলে লিমাকে আবার সুধীর সাহা তার হেফাজতে নিয়ে মানসিক রোগী সাজিয়ে গুলশানের বিকন পয়েন্ট নামে একটি রিহ্যাবেলিটেশন সেন্টারে ভর্তি করা হয়।

পরে স্ত্রীকে উদ্ধারের জন্য আদালতে মামলা করেন সৈকত পাল। আদালতের নির্দেশে গত ২৫ জুলাই গুলশান থানা পুলিশ বীকন পয়েন্ট থেকে লিমাকে উদ্ধার করে। এরপর তাকে আদালতের নির্দেশে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে ভর্তি করা হয়। পরিবারের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে বিয়ে করায় নিজ জামাতা সৈকত পালকে অপহরণ করতে কোটি টাকার চুক্তিতে নরসিংদীর শহর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক সোহেল ভুঁইয়াসহ অন্তত ৯ জনকে ভাড়া করেন লিমার বাবা সুরেশ সরিষার তেল কোম্পানির কর্ণধার সুধীর চন্দ্র সাহা। গত ১২ জুন রাজধানীর নিউমার্কেট থেকে সৈকতকে অপহরণের সময় সোহেলসহ তিনজন হাতেনাতে ধরা পড়েন। ওই মামলায় গত রোববার সুধীর সাহাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিন দিনের রিমান্ডে নেয় নিউমার্কেট থানা পুলিশ।

অপহরণ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিউমার্কেট থানার এসআই আলমগীর হোসেন বলেন, সুধীর সাহার ভাষ্য, সৈকতের পরিবারের সঙ্গে তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে খাপ খায় না। তাই মেয়েকে সেই পরিবারে বিয়ে দিতে আপত্তি তার।

সৈকতের মা ইতি পাল বলেন, লিমার বাবা সুধীর সাহার সঙ্গে এক সময় তাদের পরিবারের ভালো সম্পর্ক ছিল। তার এক মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ায় নরসিংদীতে কয়েকমণ মিষ্টি খাওয়ান সুধীর। তখন সুধীর বলছিলেন, এলাকার একটি মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছেন এই খুশি সবাইকে নিয়ে উপভোগ করতে চান তিনি। তবে পরে লিমার সঙ্গে সৈকতের প্রেমের কথা জানার পরই তিনি পাল্টে যেতেন থাকেন। এক পর্যায়ে তাদের নানাভাবে হুমকি-ধমকি দেন তিনি। লোক ভাড়া করে সৈকতকে অপহরণের চেষ্টা করা হয়।

সৈকতের আইনজীবী ব্যারিস্টার দীপঙ্কর কুমার ঘোষ বলেন, সুধীর সাহার পক্ষে নানাভাবে আইনি দীর্ঘসূত্রতা তৈরি লিমাকে স্বামীর কাছ থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করা হয়। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের রায়ের মধ্য দিয়ে সব বাধা দূর হয়ে গেছে।

পুলিশের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের ডিসি ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, আদালতের রায় শোনার পরপরই লিমা ও সৈকতকে ফোন করে শুভেচ্ছা জানিয়েছি। লিমা ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে সবাইকে আপন করে নিয়েছিলেন। নতুন সংসার গুছিয়ে নেওয়ার পর এই দম্পতিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে আমন্ত্রণ জানানো হবে।

Logo-orginal