, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

admin admin

বাংলাদেশী আজিজ খান সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ধনী

প্রকাশ: ২০১৮-০৮-১৭ ১৩:৩৫:৩৭ || আপডেট: ২০১৮-০৮-১৭ ১৩:৩৬:৫৩

Spread the love

বাংলাদেশী আজিজ খান সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ধনী
আন্তর্জাতিক ব্যবসা সাময়িকী ‘ফোর্বস’ এবছর সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ধনীদের যে তালিকা প্রকাশ করেছে, তাতে ৩৪ নম্বরে আছেন বাংলাদেশের সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান। ফোর্বসের হিসেবে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট সম্পদের পরিমাণ ৯১০ মিলিয়ন ডলার। মিস্টার খান সেই অর্থে বাংলাদেশের প্রথম ডলার বিলিওনিয়ার, অর্থাৎ ডলারের হিসেবে তিনিই বাংলাদেশের প্রথম ‘শত কোটিপতি’। কিভাবে আজিজ খান এই অবস্থানে পৌঁছালেন? তার প্রতিষ্ঠানে মূল ব্যবসা-বাণিজ্যই বা কী? তার সঙ্গে কথা বলেছেন বিবিসি বাংলার মোয়াজ্জেম হোসেন:

স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে সেটি খুব অস্থির এক সময়। চারিদিকে নানা বিশৃঙ্খলা। সেসময় খুব কম মানুষের মধ্যেই ব্যবসা-বাণিজ্যের ঝোঁক ছিল।

মুহাম্মদ আজিজ খান তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সেই ছাত্র অবস্থাতেই আরও কিছু বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে ঝুঁকে পড়লেন ব্যবসার দিকে।

“আমি ব্যবসা শুরু করি ১৯৭৩ সালে পুরোনো ঢাকায়। বাবার কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা নিয়ে শুরু করেছিলাম। মাত্র এক বছরের মধ্যেই ব্যবসা করে সেই টাকা বাবাকে ফেরত দেই। তাই আমি অনেক সময় মজা করে বলি যে আমি ক্যাপিটাল বা পুঁজি ছাড়াই ব্যবসা করে আজকের পর্যায়ে এসেছি।”

পুরোনো ঢাকায় তাঁর প্রথম ব্যবসা ছিল পিভিসি সামগ্রীর।

“আমার ব্যবসায়িক পার্টনার আগে থেকেই ব্যবসায় ছিলেন। পুরোনো ঢাকার চকবাজারে গিয়ে ব্যবসা শুরু করি। সেখানে পিভিসি বা পলি ভিনাইল ক্লোরাইডের ব্যবসায় নামি। এরপর একসময় চিটাগুড়ের ব্যবসাও করেছি। বাংলাদেশ থেকে আমিই প্রথম চিটাগুড় রপ্তানি করি।”

তখন তিনি দিনে ব্যবসা করেন, আর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা প্রশাসন ইনষ্টিটিউটে এমবিএর কোর্স করেন। এভাবে ব্যবসা আর পড়ালেখা- দুটিই পাশাপাশি চলতে থাকে।

“পুরনো ঢাকায় যাদের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করতাম, তাদের কাছ থেকে অনেক সাহায্য পেয়েছি। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোও আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছে। প্রথম শুরু করেছিলাম ট্রেডিং দিয়ে। তারপর ইনফ্রাস্ট্রাকচারে যাই। সেখান থেকেই ব্যবসা করতে করতে আজকের অবস্থানে পৌঁছেছি।”

ফোর্বসের হিসেবে আজিজ খানের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট সম্পদের পরিমাণ ৯১০ মিলিয়ন ডলার। মিস্টার খান সেই অর্থে বাংলাদেশের প্রথম ডলার বিলিওনিয়ার, অর্থাৎ ডলারের হিসেবে তিনিই বাংলাদেশের প্রথম ‘শত কোটিপতি’।

ফোর্বসের এই তালিকা প্রকাশের পর তার সম্পর্কে বিপুল কৌতুহল তৈরি হয়েছে বাংলাদেশে। কে তিনি? কীভাবে তিনি এত বড় ব্যবসায়ীতে পরিণত হলেন?

বিবিসি বাংলার তরফ থেকে সিঙ্গাপুরে অবস্থানরত মিস্টার খানের সঙ্গে যোগাযোগের পর তিনি এ নিয়ে কথা বলতে রাজী হলেন। হংকং এর এক বিমানবন্দরের লাউঞ্জ থেকে যাত্রাপথে তিনি টেলিফোনে দেয়া সাক্ষাৎকারে জানালেন তার ব্যবসায়িক জীবনের কাহিনী।

ফোর্বস তার সম্পদের যে হিসেবে দিয়েছে সেটা কি সঠিক?

হিসেবটা কমবেশি ঠিকই আছে বলে মনে করেন তিনি।

“ফোর্বস ম্যাগাজিন যেভাবে আমাদের মূল্যায়ন করেছেন, সেটা তাদের সিস্টেমে তারা করেছেন। আমরা এখনো সিঙ্গাপুরের বাজারে তালিকাভুক্ত নই। যদি হতাম, তাহলে আমাদের ইকুইটির বাজার মূল্য হতে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। সেটাকেই তারা হয়তো নয়শো দশ মিলিয়ন ডলার হিসেব করেছে।”

“আমরা মনে করি এই মূল্যায়ন ঠিকই আছে। এটা কিন্তু আমার মূল্যায়ন নয়। এটা আমাদের পরিবারের মূল্যায়ন। পরিবারে আমার ভাই-বোনরা আছেন, মেয়েরা আছেন। ভাইদের মধ্যে অবশ্য ফারুক খান, ফিরোজ খান এবং ইমরান খান আমাদের ব্যবসায় নেই।”

সামিট গ্রুপের এই যে বিশাল ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য, কী কী আছে তাতে? কোন কোন খাতে তারা ব্যবসা করছেন?

“মূলত বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও বন্দর খাতে এবং ইন্টারনেট যোগাযোগের মূল কাঠামো ফাইবার অপটিক খাতেই আমাদের বিনিয়োগ। এছাড়া বাংলাদেশে হোটেল খাতে, এবং শপিং মলেও আমরা বিনিয়োগ করছি।”

বাংলাদেশে বিদ্যুৎ খাতে সবচেয়ে বড় বেসরকারি বিনিয়োগকারী মিস্টার খানের সামিট গ্রুপ
বাংলাদেশে তাদের বিনিয়োগ কত বড় তার একটা ধারণা দিলেন তিনি।

“বাংলাদেশে আমাদের এক দশমিক পাঁচ বিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ বারো হাজার হতে তের হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আছে।আগামী তিন চার বছরে আরও ২৫ হাজার কোটি টাকা আমরা বিনিয়োগ করতে পারবো।”

বাংলাদেশে এখন যত বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়, তার প্রায় পনের শতাংশ আসে সামিট গ্রুপের বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে। সামিট বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী।

“এই মূহুর্তে আমাদের মোট উৎপাদন ক্ষমতায় এক হাজার নয়শো পঞ্চাশ মেগাওয়াট। আরও ৫৮০ মেগাওয়াটের কাজ চলছে। ২০২০ বা ২০২১ সাল নাগাদ শেষ হবে। পাইপলাইনে আছে আরও ২৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প। এর পাশাপাশি কাজ চলছে একটি এলএনজি টার্মিনালের।”

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে সামিট গ্রুপ যে এত বেশি ব্যবসা বাণিজ্য করছে সেটা সরকারের সঙ্গে তাদের রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতার কারণেই সম্ভব বলে অনেকে মনে করেন। মুহাম্মদ আজিজ খানের একজন ভাই অবসরপ্রাপ্ত কর্ণেল ফারুক খান আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা এবং সরকারের একজন সাবেক মন্ত্রী।

বাংলাদেশের মোট উৎপাদনের ১৫ শতাংশ আসে সামিট গ্রুপের বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে
আজিজ খান অবশ্য দৃঢ়তার সাথে একথা অস্বীকার করলেন যে সরকারের কাছ থেকে তারা কোন অন্যায্য সুবিধা নিয়েছেন।

“বাংলাদেশের সব সরকারের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক ছিল। বর্তমানেও খুব ভালো সম্পর্ক। আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদন করছি ১৯৯৮ সাল হতে। তখন থেকে যত সরকার এসেছে, সবার সঙ্গেই আমাদের ভালো সম্পর্ক। কোন সরকারের সময় কমবেশি বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে। কোন সরকারের সময় বেড়েছে, কোন সরকারের সময় কমেছে। কিন্তু আনুপাতিক হারে আমরা সবসময় ১৫-২০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত ছিলাম।”

মিস্টার খানের মতে, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর তারা বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে বিশেষ মনোযোগ দেয়। সেটারই সুফল পেয়েছেন তারা।

“আমার মনে হয় তারা সময়োপযোগী এবং খুব ভালো কাজ করেছে। বিদ্যুৎ খুব জরুরী অবকাঠামো। তারা বিদ্যুৎ উৎপাদন তিন হাজার তিনশো মেগাওয়াট থেকে এখন পনেরো হাজার মেগাওয়াটে নিয়ে এসেছে। স্বাভাবিকভাবেই আমরা সবচেয়ে বেশি কাজ পেয়েছি। আমরা বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে কোন অন্যায্য সুবিধা নেইও নি, পাইও নি। আমরা আমাদের মেরিটের ভিত্তিতে সর্বনিম্ন মূল্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করেই কাজ পেয়েছি।”

সামিট গ্রুপের অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সিঙ্গাপুরের শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত করার প্রক্রিয়া চলছে। মিস্টার খান নিজেও স্থায়ীভাবে সিঙ্গাপুরেই থাকেন। কেন তিনি সিঙ্গাপুরকে তার ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে বেছে নিয়েছেন?

“দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ফাইন্যান্সিয়াল ক্যাপিটাল কিন্তু সিঙ্গাপুর। তাদের ক্রেডিট রেটিং খুব ভালো। সেখানে কোম্পানি খুললে আমার ব্যবসার জন্য অর্থ সংগ্রহ করা সহজ। বাংলাদেশের তুলনায় সিঙ্গাপুরে ব্যাংক ঋণের সুদ অনেক কম। বাংলাদেশে যদি সুদের হার হয় ছয় শতাংশ, সিঙ্গাপুরে সেটা চার শতাংশ। আমাদের ব্যবসাটা ক্যাপিটাল ইনটেনসিভ। যেখানে বিলিয়ন ডলার ইনভেস্টমেন্ট, সেখানে কিন্তু এই দুই শতাংশ বিরাট ব্যাপার। এই দুই শতাংশ কম হারে যে আমরা ঋণ পাই, সেটার কারণেই আমরা সর্বনিম্ন দরে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারি।”

ব্যবসা-বাণিজ্যের বাইরে মুহাম্মদ আজিজ খানের আরেকটি পরিচয় আছে। তিনি বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় শিল্প সংগ্রাহকদের একজন। তার সংগ্রহে আছে বাংলাদেশের সব নামকরা শিল্পীদের শিল্পকর্ম।

আজিজ খান: ‘সরকারের কাছ থেকে অন্যায্য ব্যবসায়িক সুবিধা নেই নি’শিল্প জগতের সঙ্গে তার যোগাযোগটা ছাত্র জীবন থেকেই।

“শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের ছেলে মইনুল আবেদীন আমার সঙ্গে পড়তো। সেই সুবাদে তাদের বাড়িতে আসা-যাওয়া ছিল। আমাদের বাড়িতে সেভাবে শিল্পের চর্চা ছিল না। জয়নুল আবেদীনকে দেখেই এই জগতের সঙ্গে পরিচয়।”

তবে নিজে শিল্প জগতের কেউ না হলেও নিজের তৈরি বিদ্যুৎ কেন্দ্র, বন্দর, সেগুলোকে তিনি নিজের ‘শিল্পকর্ম’ বলে গণ্য করেন। ‘সেখানে গিয়ে সময় কাটাতে আমি আনন্দ পাই।”

বাংলাদেশ এক সময় বিশ্বের দরিদ্রতম একটি দেশ বলে পরিচিত ছিল। সেই দেশে ব্যবসা করে তিনি বাংলাদেশের প্রথম ডলার বিলিওনিয়ার হয়েছেন। এই বিষয়টি বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা সম্পর্কে কী কোন ইঙ্গিত দেয়?

আজিজ খানের মতে, বাংলাদেশের অর্থনীতি কেবল খুব দ্রুত গতিতে চলা শুরু করেছে। এটার গতি আরও দ্রুততর হবে। বাংলাদেশ আগামী দু-তিন বছরে দশ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে পৌঁছাবে।

“বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের ৩৪ কোটি হাত কিন্তু কাজ খুঁজছে। প্রতিটি লোক কাজ চায়। প্রত্যেকটা লোক কাজ করে খেতে চায়। কেউ ভিক্ষার হাত বাড়াতে চায় না। আমরা যদি কেবল ভৌত অবকাঠামো এবং সামাজিক অবকাঠামো, বিশেষ করে সময়োপযোগী শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারি, বাংলাদেশ কিন্তু বিশ্বের অন্যতম ভালো দেশ হিসেবে, সোনার বাংলা হিসেবে উঠে দাঁড়াবে।”

তার মানে বাংলাদেশে তার মতো আরও ডলার বিলিওনিয়ার তৈরি হওয়ার সুযোগ আছে?”নিশ্চয়ই আছে। ১৭ কোটি মানুষের সবকিছু হওয়ার সুযোগ আছে।
উৎসঃবিবিসি বাংলা ।

Logo-orginal