, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

admin admin

টাকার সঙ্কটে থাকা ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপকদের উদ্বেগ বাড়ছে

প্রকাশ: ২০১৯-০১-১৫ ০৯:৫৩:২৭ || আপডেট: ২০১৯-০১-১৫ ০৯:৫৩:২৭

Spread the love

আগে গ্রাহকদের কাছ থেকে যেসব আমানত নেয়া হয়েছিল ওই সব আমানতের মেয়াদপূর্তিতে এককালীন মুনাফাসহ পরিশোধ করতে হচ্ছে। সেই সাথে বাড়ছে ঋণপ্রবাহ। কিন্তু ব্যাংকের নগদ টাকা ও বিনিয়োগ চাহিদা পূরণ করার প্রধান মাধ্যম আমানত প্রবাহ কমে যাচ্ছে। ফলে তহবিল ব্যবস্থাপনা করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। প্রতিবেদন নয়া দিগন্তের।

বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে সামনে টাকার সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করতে পারে। এতে তহবিল ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। আগাম এসব ঝুঁকি মোকাবেলায় আমানত প্রবাহ বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। বাড়ানো হচ্ছে আমানতের মুনাফার হার। তার দেখাদেখি অন্য ব্যাংকও তার চেয়ে বেশি হারে মুনাফার হার বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে আমানত সংগ্রহে ব্যাংকিং খাতে এক ধরনের অশুভ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। এর ফলে মুনাফা বাড়িয়েও আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। ফলে নগদ টাকার সঙ্কটে থাকা ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপকদের উদ্বেগ দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে।

গতকাল সোমবার কথাগুলো বলছিলেন, দেশের দ্বিতীয় প্রজন্মের একজন তহবিল ব্যবস্থাপক। ওই কর্মকর্তার মতো অনেকেরই এখন একই অবস্থা। নতুন প্রজন্মের একটি ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপক নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, নতুন এক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর নতুন ব্যাংকগুলোর ওপর গ্রাহকদের আস্থা কমে গেছে। এ দিক থেকে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে প্রথম প্রজন্মের ব্যাংকগুলো। নতুন প্রজন্মের ব্যাংকগুলোর কোনো কোনোটি আমানতের মুনাফা ১০ শতাংশের ওপরে নিয়ে গেছে। তবুও মিলছে না আমানত। করর্পোরেট গ্রাহকদের আস্থায় আনার জন্য দ্বারে দ্বারে তারা এখন ঘুরছেন। কাঙ্খিত সাড়া মিলছে না। তাই বাধ্যতামূলক নগদ জমা অর্থাৎ সিআরআর সংরক্ষণ করতে ও দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার অর্থাৎ কলমানি মার্কেটের ওপর তারা নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। যদিও এতে ঝুঁকি ভয়াবহভাবে বাড়ছে। কিন্তু তার পরেও স্থায়ী সমাধানের জন্য আমানত মিলছে না। ফলে পুরনো ব্যাংকগুলোর চেয়ে নতুন ব্যাংকগুলো আছে মহাবিপাকে। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে সামনে ঋণ দেয়া তো দূরের কথা ব্যাংকের লেনদেনের দৈনন্দিন চাহিদা মেটানোও দুস্কর হয়ে পড়বে ব্যাংকগুলোর।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, আমানতের এই পরিস্থিতির মধ্যে নতুন করে দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে সরকারি ঋণ। গত কয়েক বছর ধরে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে অধিকমাত্রায় ঋণ নেয়ায় ও সেই সাথে রাজস্ব আদায় এবং রেমিট্যান্স প্রবাহের প্রবৃদ্ধি মোটামুটি অবস্থানে থাকায় সরকার ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নিয়েছে কম হারে। কিন্তু গত ডিসেম্বর থেকে সরকারের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ গ্রহণের হার বেড়ে গেছে।

সরকারের ঋণ দিতে বাধ্য থাকবে এমন চুক্তিবদ্ধ ব্যাংকগুলোকে প্রাইমারি ডিলার বা পিডি ব্যাংক বলে। ওই পিডি ব্যাংকগুলোর এখন অবস্থা শোচনীয়। ইতোমধ্যে সরকারের রাজস্ব কমে গেছে। কমে গেছে রেমিট্যান্স প্রবাহ। কিন্তু সরকারের ব্যয় বেড়ে গেছে। এর ফলে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের হার বেড়ে গেছে। কোনো ব্যাংক সরকার ঋণ না দিলেও পিডি ব্যাংকগুলো সরকার ঋণের জোগান দিতে বাধ্য থাকবে। এখানেই ব্যাংকগুলোর ওপর বাড়তি চাপ বেড়ে গেছে বলে মনে করছেন একটি পিডি ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপক।

সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, গত কয়েক বছর ধরে বিনিয়োগে মন্দার কারণে ঋণের চাহিদা কম ছিল। নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর এখন ঋণের চাহিদা বাড়বে। কিন্তু ব্যাংকগুলোর হাতে পর্যাপ্ত অর্থ নেই। ফলে ঋণের জোগান কিভাবে দেয়া হবে সেটা নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে। এ দিকে সরকারের রাজস্ব আদায়ও কম হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে রাজস্ব আদায় বেড়েছে মাত্র ৬ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছিল সাড়ে ২২ শতাংশ। রাজস্ব আদায় কম হওয়ায় সরকারি হিসাবে যথেষ্ট অর্থ জমা নেই। যে কারণে সরকারকে ঋণ নিয়ে চলতে হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বরে সরকারের ঋণ বেড়েছে প্রায় ১ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে সরকার ব্যাংক থেকে নতুন কোনো ঋণ তো নেয়ইনি, উল্টো আগের ঋণ বাবদ ৫ দশমিক ৫২ শতাংশ পরিশোধ করেছিল। এ কারণে সরকারের হিসাবে অর্থ না থাকায় তারল্য সঙ্কট আরো প্রকট হচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনচ্ছিুক রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাংকের সাবেক একজন শীর্ষ কর্মকর্তা উল্লেখ করেছেন। সুশাসনই এখন ব্যাংকিং খাতের মূল সমস্যা। সরকারি বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে যারা পরিচালক বা চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন তারা পেশাদারিত্বের ভিত্তিতে কাজ করেন না অথবা করতে পারেন না। সরকারি ব্যাংকগুলোতে ঋণ দানের জন্য থাকে প্রভাবশালীদের চাপ। এধরনের চাপের মুখে ঋণ দেয়া হলে সে ঋণ ফেরত আসে না অধিকাংশ ক্ষেত্রে। অন্যদিকে বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায়ও নানা ধরনের চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। চাপের মুখে শীর্ষ ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তনের একাধিক ঘটনার পর এখন ব্যাংকিং খাতে একধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়ে আছে। এসব বিষয়ের প্রতিকার করা না গেলে ব্যাংক খাতে সুশাসন আনা অথবা জনগণের আস্থা-বিশ্বাস বজায় রাখা দুষ্কর হতে পারে।

ব্যাংকিং তারল্য বাড়ানোর ক্ষেত্রে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স ও বৈদেশিক অনুদান বড় ভূমিকা রাখে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধির হার কমে গেছে। গত অর্থবছরের ওই সময়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছিল প্রায় ১১ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছে ৯ শতাংশ। এর মধ্যে গত নভেম্বরে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে প্রায় ৪ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই মাসে রেমিট্যান্স বেড়েছিল প্রায় ২৮ শতাংশ।

গত অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরে বৈদেশিক অনুদান বেড়েছিল ১৩২ শতাংশের বেশি। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে অনুদান তো বাড়েইনি বরং কমেছে প্রায় সাড়ে ৭ শতাংশ। এসব কারণে ব্যাংকিং খাতে তারল্যের জোগান কমে গেছে। ফলে তারল্য সঙ্কটের আশঙ্কা প্রকট হচ্ছে।

Logo-orginal