, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

Avatar rtm

দুর্নীতিরোধে কঠোর অবস্থানে সরকার

প্রকাশ: ২০১৯-০১-১৬ ১১:১৬:৪৬ || আপডেট: ২০১৯-০১-১৬ ১১:১৬:৪৬

Spread the love

‘আবার ক্ষমতায় গেলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স’—নির্বাচনী ইশতেহারে দেওয়া আওয়ামী লীগের এ ঘোষণার বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। রাষ্ট্রের বড়-ছোট দুর্নীতিবাজদের দমন ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে নতুন পথে হাঁটছে দমন কমিশন (দুদক)। দুর্নীতিবাজদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির মুখোমুখি করতে কাজ শুরু করেছে সংস্থাটি। বিভিন্ন সময় দুদকের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ ও অভিযোগের কড়া জবাব দিতে চায় কাজের মাধ্যমে। এরই মধ্যে লক্ষ্যপূরণে সংস্থাটির গোয়েন্দা ইউনিটের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ কাজ অনেকটা গুছিয়ে এনেছে কমিশন। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের তালিকা সংগ্রহ, জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থীদের নির্বাচনী হলফনামা সংগ্রহ, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ, মন্ত্রণালয় ও সেক্টরভিত্তিক দুর্নীতির ফিরিস্তি জোগাড় ও করণীয় ইত্যাদি বিষয়ে নিজেদের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে সংস্থাটি।

এরই মধ্যে ২৪ বছরের চাকরি জীবনে ১৫ হাজার কোটি টাকার সম্পদ অর্জনকারী স্বাস্থ্য অধিদফতরের মেডিকেল এডুকেশন শাখার অ্যাকাউন্টস অফিসার মো. আবজাল হোসেনের বিরুদ্ধে তদন্তে নেমেছে দুদক। অন্যদিকে ৫ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে নৌপরিবহন অধিদফতরের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী ও সার্ভেয়ার ড. এস এম নাজমুল হককে আত্মসমর্পণের আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। তাছাড়া টানা তৃতীয়বার সরকার গঠন করে দুর্নীতির বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন সরকারের একাধিক মন্ত্রী। নতুন সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যরা তাদের প্রথম কর্মদিবসেই দুর্নীতি নির্মূলের বিষয়ে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে বক্তব্য রেখেছেন। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নিজেই দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালানোর দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।

দেশের অন্যতম বড় দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে চিহ্নিত ভূমি মন্ত্রণালয়। গতকাল মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী বলেছেন, ভূূমি মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মকর্তা ও কর্মচারী যদি দুর্নীতি করে থাকেন, তাহলে তাদের বিচার ও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যদি আমিও দুর্নীতি করি, আমারও বিচার হবে। আমি মন্ত্রী হওয়ার পরে আওয়ামী লীগের ইশতেহারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছি। তাই মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কাছ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সম্পদের হিসাব চেয়েছি। সাভার ও আশুলিয়াসহ সারা দেশে যারা নদী-নালা ও খালবিল দখল করেছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে সরকারি সম্পত্তি উদ্ধার করা হবে বলে জানান ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান। এছাড়া ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থাও নেওয়া হবে বলে আশ্বস্ত করেছেন তিনি।

স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম দায়িত্ব গ্রহণ করেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, দুর্নীতির ক্ষেত্রে তার অবস্থান হচ্ছে জিরো টলারেন্স। কারণ তিনি নিজেও দুর্নীতি করেন না, অন্যকেও এ কাজে ছাড় দেবেন না।

এদিকে নিজ মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতিকে সহ্য করবেন না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন নতুন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন। দুর্নীতি প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন প্রথম দিনই বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছেন। এবার আমরাও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিতে যেতে চাচ্ছি। গণতন্ত্রের ভিতকে মজবুত করতে, দুর্নীতি দমনের কোনো বিকল্প নেই। এরই মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন অত্যন্ত শক্তিশালী হয়েছে, আগামীতে আরও শক্তিশালী হবে। সেক্ষেত্রে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় একটি ভালো দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন নতুন গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলসহ অনেকে।

বড় দুর্নীতিবাজদের ধরতে দুদকের নতুন উদ্যোগ : দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, বর্তমান সরকারের ম্যান্ডেট ছিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের ম্যান্ডেট বাস্তবায়নের জন্য যা যা করা দরকার আমরা করব। নিয়োগ বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্য, স্বাস্থ্য-শিক্ষা বাণিজ্যসহ সব জায়গায় যেসব দুর্নীতি-অনিয়ম রয়েছে তা প্রতিরোধ এবং দমনেরও চেষ্টা করা হবে। কোনো বাধাই মানব না। দুর্নীতিবাজ হিসেবে পরিচিতি সাবেক মন্ত্রী বা বর্তমান বলে কথা নেই, আমরা সবাইকে একই পাল্লায় মাপতে চাই।

জানা গেছে, দুদক এবার সরকারি বা বিরোধী দল হিসেব না করে দুর্নীতিবাজ হিসেবে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেবে। এরই মধ্যে হলফনামা যাচাই-বাছাই করে কয়েকজন প্রভাবশালীর ব্যাংক হিসাবে কোটি কোটি টাকার সন্ধান পাওয়া গেছে। প্রাথমিক যাচাই-বাছাইয়ে অবৈধ উৎস থেকে অর্জিত অর্থ বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। এবার আর সরকারি দল-সংশ্লিষ্টদেরও মুক্তি মিলবে না।

দুদক সূত্র জানায়, দুর্নীতিবাজদের বেশ কয়েকটি তালিকা প্রস্তুত রয়েছে। তালিকা ধরে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। শিগগিরই অভিযান চালানো হবে। সবচেয়ে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে আর্থিক দুর্নীতি। বিগত সময়ে এই খাতের ভয়াবহ দুর্নাম রয়েছে। সরকারও চাচ্ছে এই খাতে শুদ্ধি অভিযান চালানো হোক। এরপরই রয়েছে, ভূমি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত। এভাবে পর্যায়ক্রমে সব সেক্টরের দুর্নীতি নিয়ে দৃশ্যমান কাজ করবে দুদক।

২৪ বছরে ১৫ হাজার কোটি টাকার সম্পদ অর্জন স্বাস্থ্য কর্মকর্তার : ২৪ বছরের চাকরি জীবনে ১৫ হাজার কোটি টাকার সম্পদ অর্জন করেছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মেডিকেল এডুকেশন শাখার অ্যাকাউন্টস অফিসার মো. আবজাল হোসেন। উত্তরার এক সড়কেই রয়েছে তার পাঁচটি বাড়ি। গুলশান, বনানী, বারিধারায় ২০টি, সারা দেশে প্লট-বাড়ি কেনায় সেঞ্চুরি করেছেন তিনি। শুধু দেশেই নয়; সম্পদের পাহাড় গড়েছেন মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রেও। দেশে-বিদেশে তার মোট সম্পদকে টাকায় হিসাব করতে হিমশিম খাচ্ছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কর্মকর্তারা।

জানা গেছে, অধিদফতরের সিনিয়রদের যোগসাজশে কেনাকাটার টেন্ডারের নিয়ন্ত্রণ ছিল তার হাতে। বদলি বাণিজ্যও করতেন। তবে দুর্নীতি আর অবৈধ আয়ে সিনিয়রদেরও টপকে গেছেন আবজাল। বাংলাদেশের সাজাপ্রাপ্ত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে হাজার, দুই হাজার, তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের প্রমাণ থাকলেও আবজাল ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রতি বছর হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। এরই মধ্যে সেগুলোর সন্ধান পেতে শুরু করেছে দুদক।

এদিকে দুদকে জিজ্ঞাসাবাদের পর ১৪ জানুয়ারি আবজালকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করার নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। আবজালের ‘সহযোগী’ হিসেবে কাজ করার অভিযোগে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক ও লাইন ডিরেক্টর ড. কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন, লাইন ডিরেক্টর (চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি) অধ্যাপক ডা. মো. আবদুর রশিদ ও সহকারী পরিচালক ডা. আনিছুর রহমানকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক। আবজালসহ এ চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদের পর একটি মামলা করবে দুদক।

৫ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণকারী নৌ প্রকৌশলীকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ : ৫ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে নৌপরিবহন অধিদফতরের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী ও সার্ভেয়ার ড. এস এম নাজমুল হককে আত্মসমর্পণের আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। গতকাল মঙ্গলবার বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কে এম হাফিজুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন। দুদকের ফাঁদে ২০১৮ সালের ১২ এপ্রিল ৫ লাখ টাকা ঘুষসহ হাতেনাতে গ্রেফতার হন নাজমুল হক। পরে একই বছরের ১৩ আগস্ট ঢাকার মেট্রোপলিটন জজ আদালতের সিনিয়র স্পেশাল জজ আসামিকে ৫০ হাজার টাকা বন্ডে জামিন দেন।

Logo-orginal