, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

admin admin

“তোরে দেইখাও চিনতে পারলাম না, কেন চিনলাম নারে বাপ, জবাব দে

প্রকাশ: ২০১৯-০৩-০৭ ২৩:২০:৩২ || আপডেট: ২০১৯-০৩-০৭ ২৩:২০:৩২

Spread the love

* ডিএনএ পরীক্ষায় ১১ জনের পরিচয় শনাক্ত
* পুড়ে অঙ্গার লাশটাই কাঁধে নেওয়া বাকি ছিল

শেষ বিকেল। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গের সামনে এসে দাঁড়ায় একটি অ্যাম্বুলেন্স। অ্যাম্বুলেন্সটি থেকে ২৬ নম্বর লাশ নামানো শুরু হলে চিৎকার দিয়ে কান্না করতে থাকেন বোরকা পরিহিতা এক নারী। তার হাতে পুড়ে অঙ্গার হওয়া একটি লাশের ছবি। ছবিটি ওপরে তুলে ধরে বাড়তে থাকে তার হৃদয় বিদারক কান্না। লাশের দিকে অপলক চোখে চেয়ে চিৎকার করে বলতে থাকেন, তোমরা দেখো, আমার বাপ আইছে। কতই না কষ্ট পেয়ে চলে গেছে আমার কলিজার টুকরা। কিসের এত অভিমান ছিলরে বাপ। এমনভাবেই গেলি তোরে দেইখাও চিনতে পারলাম না। কেন চিনলাম নারে বাপ, জবাব দে বলেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি।

ওই বোরকা পরিহিতার নাম রুবিনা ইয়াসমিন। চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহত তানজিল হাসান রোহানের মা তিনি। গতকাল ডিএনএ টেস্টে রোহানের লাশ শনাক্তের পরে মর্গে ছেলের লাশ নিতে এসে এভাবেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। তার মতোই মর্গে লাশ নিতে আসে শনাক্ত হওয়া আরো সাতজনের স্বজনেরা। তাদেরও সবার চোখ পুড়ে অঙ্গার হওয়া লাশের নম্বরের দিকে।

কারণ চেহারা আকৃতি সব বিকৃত হয়ে গেলেও স্বজনের লাশ চেনার জন্য ওই কোড নাম্বারই ভরসা। লাশের নাম্বারের সাথে যার স্বজনের ছবির নাম্বার মিলে যাচ্ছে সেই কান্না-আহাজারিতে ভেঙে পড়ছেন। ফলে মুহূর্তের মধ্যেই স্বজন হারানো আর্তচিৎকারে ভারী হয়ে ওঠে মর্গের বাতাস। ঘটনার পরে খুব কাছ থেকে স্বজনকে দেখে চিন্তে না পারাটাই বেশি পোড়াচ্ছে তাদের। আবার অনেকে ফিরে আসবে মনে করে এতদিন যে সান্ত্বনা খুঁজেছেন তার অবসান ঘটাতেও কান্নায় ভেঙে পড়েন।

রোহানের বাবা মো: আবুল হোসেন বলেন, তাদের বাড়ি চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে। বর্তমানে থাকেন বংশালের আগামাসি লেনে। ঘটনার দিন বেলা ৩টায় রোহান বাসা থেকে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে বের হয়। রাতে আগুন লাগার পর তাকে ফোন করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। এরপর আর ফেরেনি বলেও তিনিও মূর্ছা যেতে থাকেন।

শোকাতুর হৃদয়ে গতকাল সন্ধ্যায় রোহানের লাশ কাঁধে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মেডিক্যাল মর্গ ছাড়েন রোহানের বাবা। করুণ দৃশ্যের যেন শেষ নেই। ভাইয়ের কাঁধে ভাইয়ের লাশ। স্বামী হারিয়েছেন স্ত্রীকে। সন্তান হারিয়েছেন মাকে। অবুঝ শিশু জানেই না তার বাবা আর পৃথিবীতে নেই। এমন অসংখ্য বেদনাবিধুর ঘটনা জড়িয়ে আছে চকবাজার ট্র্যাজেডিতে। চুড়িহাট্টার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে হারানো স্বজনদের লাশ পুড়ে এতটাই অঙ্গার হয়েছিল যে দেখে চেনার মতো অবস্থায় ছিল না। দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও স্বজনরা তাই দিন গুনছিলেন, কবে পাওয়া যাবে সন্তান,ভাইবোন ও মা-বাবার লাশটি। অবশেষ শনাক্ত হওয়া ১১টি লাশ বুঝে নিতেই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মর্গে হাজির হন স্বজনেরা। চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডের প্রায় দুই সপ্তাহ পর ঢাকা মেডিক্যাল মর্গের সামনে আসেন অশ্রুসিক্ত স্বজনরা।

জানা গেছে, রাজধানীর পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া ১৫টি লাশের মধ্যে ১১ জনের পরিচয় শনাক্ত করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ফরেনসিক বিভাগ। শনাক্তের পর ১১ লাশের স্বজনদের লাশ বুঝে নিতে খবর দেয়া হয়। তবে গতকাল রাত সাড়ে ৭টা পর্যন্ত ৮টি লাশ বুঝে নিয়েছেন তাদের স্বজনরা। বাকি তিনজনের লাশ নিতে তাদের স্বজনরা আজ বৃহস্পতিবার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে আসবেন বলে জানা গেছে।

যে আটজনের লাশ ঢাকা মেডিক্যাল মর্গ থেকে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে তারা হলেন : চকবাজারের প্লাস্টিক ব্যবসায়ী শাহীন আহমেদ (৪২)। তার লাশ বুঝে নেন স্ত্রী ময়না বেগম। শাহীনের লাশ আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হবে বলে জানিয়েছেন তার পরিবার। গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের ছাত্রী ফাতেমা-তুজজোহরা ওরফে বৃষ্টির (২১) লাশ বুঝে নেন তার ভাই সাইদুল ইসলাম সানি। ঘটনার দিন থেকে বৃষ্টি ও তার বান্ধবী দোলা নিখোঁজ ছিল। তবে দোলার লাশ শনাক্ত হয়নি। সালেহ আহমেদ লিপু (৩৬) ও তার স্ত্রী নাসরিন জাহানের লাশ শনাক্ত হলেও (৩০) শনাক্ত হয়নি তাদের শিশু সন্তানের লাশ। ঘটনার দিন তারা রিকশায় বাসায় ফিরছেন। গতকাল লাশ দু’টি গ্রহণ করেন লিপুর ভাই ইসমাইল হোসেন। শনাক্ত হওয়া রিকশাচালক নুরুজ্জামান হাওলাদের (৪৫) লাশ গ্রহণ করেন তার স্ত্রী শিরিন আক্তার। নুরুজ্জামানের গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জ ফতুল্লার বেলপাড়ায়। তিনি ঢাকায় রিকশা চালাতেন। নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএর ছাত্র তানজিল হাসান খান রোহানের লাশ গ্রহণ করেন তার বাবা হাসান খান। রোহান বংশালের আগামসি লেনে থাকতেন। গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর ফরিদগঞ্জ। তার লাশ গ্রামে দাফন করার কথা জানিয়েছেন রোহানের বাবা। প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবসায়ী আহসান উল্লাহ (৩২) লাশ গ্রহণ করেন তার ভাই আনোয়ার হোসেন। আহসান আগামা উল্লাহ চকবাজার সাত রওজা এলাকায় থাকতেন। ঘটনার দিন ওষুধ কিনতে বের হয়ে দগ্ধ হন। তার গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ। নিহত স্টেশনারি দোকানি এনামুল হকের (৩৩) লাশ গ্রহণ করেন তার বাবা আমজাদ হোসেন। ওই দিন দোকান বন্ধ করে কেরানীগঞ্জ আটিবাজার যাওয়ার পথে তিনি দগ্ধ হন।

জানা গেছে, শনাক্ত হলেও গতকাল দুলাল, নুরুল হক ও ইব্রাহিমের লাশ নিতে তার স্বজনরা মর্গে আসেননি। আজ তারা লাশ নেবেন বলে জানিয়েছেন।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে স্বজনদের কাছে লাশগুলো হস্তান্তর করেন ঢাকা জেলার অতিরিক্ত প্রশাসক শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, পুলিশের সহায়তায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শনাক্ত হওয়া আটটি লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। সকালেই স্বজনদের ফোন করে মর্গে আসতে অনুরোধ করা হয়েছে। লাশগুলো বিভিন্ন হাসপাতালের মর্গের ফ্রিজে ছিল। সেগুলো ঢাকা মেডিক্যাল মর্গে আনার পর সন্ধ্যায় স্বজনদের বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। তিনি আরো জানান, লাশ দাফনের কাজে সহায়তার জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রতিটি পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে দেয়া হয়েছে। বাকি তিন লাশ তাদের স্বজনদের কাছে আজ হস্তান্তর করার কথা জানান তিনি।

এর আগে গতকাল বেলা সাড়ে ১১টায় সিআইডি সংবাদ সম্মেলন করে ১১ লাশ শনাক্তের খবর জানায়। লাশগুলো বুঝে নিতে তাদের স্বজনদের ঢাকা মেডিক্যাল মর্গেও আসতে বলে সিআইডি।

গতকাল সংবাদ সম্মেলনে সিআইডির অ্যাডিশনাল ডিআইজি রেজাউল হায়দার জানান, ২০ ফেব্রুয়ারি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৬৭ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে ১৯ জনের লাশ শনাক্ত করা যায়নি। ঘটনার পর থেকে নিখোঁজদের সন্ধানে ৪৮ জনের কাছ থেকে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়। প্রথম ধাপে সেগুলোর সাথে ৪৮ জন দাবিদারের ডিএনএ প্রোফাইল মেলানো হলে সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ২৩ জনের সাথে ১১টি লাশ নমুনা মিলেছে। বাকি চারজনের পরিচয় নির্ণয়ের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তিনি জানান, দ্বিতীয় ধাপে চারটি অজ্ঞাত লাশের হাড় থেকে ডিএনএ পরীক্ষার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এই প্রক্রিয়াটি দুই সপ্তাহের মধ্যে সম্পন্ন হবে। অগ্নিকাণ্ডে নিহত ব্যক্তিদের পরিচয় শনাক্তের জন্য ফরেনসিক ডিএনএ ল্যাবরেটরিতে একটি বিশেষজ্ঞ দল ডিএনএ নমুনা ( রক্ত, টিস্যু, হাড় ও বাক্কাল সোয়াব) সংগ্রহ করে কাজ শুরু করে সিআইডির ফরেনসিক বিভাগ। এ জন্য ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) ফরেনসিক মেডিসিন বিশেষজ্ঞ দলের সাথে যৌথভাবে ঢামেক মর্গ থেকে মোট ৬৭টি লাশ থেকে ২৫৬টি ক্রাইম সিন ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়। পরে ২৩ ফেব্রুয়ারি একটি বিচ্ছিন্ন হাতকে পৃথক আলামত হিসেবে গণ্য করে সেটি থেকে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়। ফলে মোট সংগৃহীত ক্রাইমসিন ডিএনএ নমুনা সংখ্যা ২৫৭তে দাঁড়ায়।

তিনি আরো জানান, আমরা প্রতিবেদনটি সংশ্লিষ্ট থানার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে পাঠিয়েছি। ওই কর্মকর্তা আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে লাশগুলো হস্তান্তরের প্রক্রিয়া গ্রহণ করবে। শনাক্ত করা ৯ জন পুরুষের পরিচয় সম্পর্কে তিনি বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা যাচাই-বাছাই করে বলতে পারবেন। শনাক্ত করা দুই নারী নিখোঁজ দুই বান্ধবী কি নাÑ জানতে চাইলে তিনি জানান, আমরা সেটি বলতে পারব না। তবে দাবিদার পরিবার যে নাম দিয়েছে সেই নাম আমরা প্রকাশ করেছি।

উল্লেখ্য, চকবাজারের চুড়িহাট্টায় গত ২০ ফেব্রুয়ারি বুধবার রাতে ভয়াবহ আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয় ৬৭ প্রাণ। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আরো চারজন। উৎসঃ সংবাদ২৪ডটকম।

Logo-orginal