, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

admin admin

টানা দরপতনে পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন ২৮ লাখ বিনিয়োগকারীরা”

প্রকাশ: ২০১৯-০৪-১৯ ০০:৩৯:২৫ || আপডেট: ২০১৯-০৪-১৯ ০০:৩৯:২৫

Spread the love

টানা দরপতনে ধীরে ধীরে পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন শেয়ারবাজারের সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর আশ্বাস সত্ত্বেও কোনোভাবেই কাটছে না লেনদেন খরা। পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি দফায় দফায় সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করলেও বাজার পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না। ফলে দেশের পুঁজিবাজারে সাড়ে ২৮ লাখ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক, আস্থাহীনতা ও হতাশা। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে বিক্ষোভ করেছেন বিনিয়োগকারীরা। প্রতিবেদন দৈনিক মানবজমিনের ।

তাদের দাবি, পতন ঠেকাতে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। অবশ্য সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কঠোর আন্দোলনের হুমকির পর সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) মূল্যসূচকের উত্থান হয়েছে। বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের শেয়ারবাজারে আস্থা সংকটের কারণে টানা দরপতন দেখা দিয়েছে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে বাজারে বড় মূলধনি কোম্পানিকে নিয়ে আসতে হবে।

আর ভালো ও বড় মূলধনি কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত করতে হলে স্টক এক্সচেঞ্জ ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন। অর্থাৎ মানসম্মত প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) আনতে হবে বলে মনে করেন তারা।

তাদের মতে, বাজারে সক্রিয় কারসাজি চক্র। এতে ভালো প্রতিষ্ঠান থেকে দুর্বল প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম বেশি বাড়ে। বাজারে এমন কারসাজি চললেও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি তা বন্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। তবে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বলছে, বাজার স্থিতিশীল।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, শেয়ারবাজারের মূল সমস্যা বিনিয়োগকারীদের আস্থা সংকট। এ সংকট দূর করতে হবে। কারসাজির মাধ্যমে কেউ পুঁজি হাতিয়ে নিলে তার বিচার হবে, বিনিয়োগকারীদের এ নিশ্চয়তা দিতে হবে। পুঁজিবাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এতে বাজারে নতুন পুঁজি আসবে। পাশাপাশি তারল্য সংকট কাটাতে সহায়তা করবে বলে আশা করেন তিনি।

বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত ১৪ই মার্চ ডিএসই‘র বাজার মূলধন ছিল ৪ লাখ ১৯ হাজার কোটি টাকা। গতকাল পর্যন্ত ৩ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকায় নেমে এসেছে। এ সময়ে ডিএসই’র বাজারমূলধন প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা কমেছে। একই সময়ে ডিএসই’র মূল্যসূচক ৫ হাজার ৬৫৫ পয়েন্ট থেকে কমে ৫ হাজার ৩২১ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। ডিএসই’র সব কোম্পানির শেয়ারের দাম কমেছে গড়ে ৫ শতাংশেরও বেশি।

বিনিয়োগকারী আবদুর রাজ্জাক বলেন, গত কয়েক দিনে আমার সব শেষ হয়ে গেছে। গত নির্বাচনের পর বাজারের চাঙ্গাভাব দেখে ৩০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলাম। সেই টাকা কমে এখন দাঁড়িয়েছে ২০ লাখ টাকায়। বুঝে উঠার আগেই আমার ১০ লাখ টাকা হাওয়া হয়ে গেল। তিনি বলেন, এভাবে কেনো শেয়ারবাজার চলতে পারে না। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কার্যকর পদক্ষেপ নেবেনে বলে আশা করেন তিনি।

আরেক বিনিয়োগকারী মোস্তাক মিয়া জানান, গত কয়েক দিনে ৫ লাখ টাকা নাই হয়ে গেছে তার।
জানা গেছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ধুঁকতে থাকা পুঁজিবাজারে সূচকের উত্থান দেখা দেয়। টানা বাড়তে থাকে মূল্য সূচক। সেই সঙ্গে লেনদেনেও দেখা দেয় তেজিভাব। কিন্তু তেজিভাব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। নতুন সরকারের মেয়াদ এক মাস পার না হতেই দরপতনের কবলে পড়ে পুঁজিবাজার। প্রায় তিন মাস ধরে এ দরপতন অব্যাহত রয়েছে। এতে প্রতিনিয়ত পুঁজি হারানোর আতঙ্কে ভুগছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এ সময়ে দরপতন ঠেকাতে বাস্তব কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করেনি ডিএসই। এতে বাজারের ওপর চরম আস্থাহীনতার সঙ্গে দেখা দিয়েছে তারল্য সংকট। লেনদেন কমতে কমতে একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। ১০ই এপ্রিল থেকে ১৫ই এপ্রিল পর্যন্ত টানা তিন কার্যদিবস লেনদেন হয়েছে ৩০০ কোটি টাকার নিচে। ১৪ মার্চের পর গত এক মাসে ডিএসইর লেনদেন ৫ কোটি টাকার ঘর স্পর্শ করতে পারেনি।

এ বিষয়ে ডিএসইর এক সদস্য বলেন, বাজারের মন্দাভাব কাটাতে ডিএসইর পক্ষ থেকে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যাচ্ছে না। অথচ বাজার উন্নয়নের জন্য ক্ষেত্র-বিশেষে বিএসইসি থেকে ডিএসইর ভূমিকা বেশি থাকার কথা। তিনি বলেন, ডিএসইর বর্তমান ম্যানেজমেন্টের কর্মকাণ্ডে বোঝা যায়, বাজার সম্পর্কে তাদের দক্ষতার বেশ অভাব আছে।

এর আগে এক অনুষ্ঠানে বিএসইসির চেয়ারম্যান ড. এম খায়রুল হোসেন বলেন, ২০১০-১১ সালের পর শেয়ারবাজারের উন্নয়নে নানা সংস্কার করা হয়েছে। ফলে ৮ বছরে শেয়ারবাজারে অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়নি। বাজার আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি স্থিতিশীল। তিনি বলেন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের মাধ্যমে শেয়ারবাজার এখন সমৃদ্ধ ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশ বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজান-উর রশিদ চৌধুরী বলেন, বাজারের মন্দাভাবের কারণে বিনিয়োগকারীরা নিঃস্ব হয়ে আত্মহত্যাও করছেন। কিন্তু বিএসইসি বা ডিএসই কেউ পুঁজিবাজার ও বিনিয়োগকারীদের রক্ষায় পদক্ষেপ নিচ্ছে না। তিনি বলেন, বাজার এখন যেভাবে চলছে তা স্বাভাবিক নয়। এর প্রতিবাদে আমরা নিয়মিত রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করছি। আমাদের দাবি, যেসব কোম্পানির শেয়ারের দাম ইস্যুমূল্যের নিচে নেমে গেছে, সেগুলো সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে বাই-ব্যাক করতে হবে। এজন্য প্রয়োজনীয় আইন জরুরি। কারসাজি চক্রের খপ্পরে পড়ে শেয়ারবাজারে এমন টানা দরপতন হচ্ছে। বাজারের এমন অবস্থার পরও বিএসইসি কিংবা ডিএসই কেউই কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না।

শেয়ারবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, বাজার এখন যে অবস্থায় চলছে তা হতাশাজনক। বিনিয়োগকারীদের পুঁজি আস্তে আস্তে শেষ হয়ে যাচ্ছে। ফলে তাদের বিশ্বাসের জায়গা কমে যাচ্ছে। তাদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে নতুন ও ভালো প্রতিষ্ঠান শেয়ারবাজারে আনার বিকল্প নেই।

বাজার পর্যালোচনায় জানা গেছে, গত বুধবার দরপতনের প্রতিবাদে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সামনে বিক্ষোভ করে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন। সেই সঙ্গে আগামী ২৩শে এপ্রিলের মধ্যে বাজারের স্বার্থে দাবি মেনে না নেয়া হলে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ অ্যান্ড কমিশনের (বিএসইসি) সামনে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা হবে বলে হুমকি দেন। বিক্ষোভ থেকে বিনিয়োগকারীরা বিএসইসির চেয়ারম্যান খায়রুল হোসেনের পদত্যাগ, জেড ক্যাটাগরি এবং ওটিসি মার্কেট বন্ধ, খন্দকার ইব্রাহীম খালেদের তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী দোষীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা এবং আইপিও ও প্লেসমেন্ট শেয়ারের অবৈধ বাণিজ্য বন্ধের দাবি জানান।

বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বিনিয়োগকারীদের এই হুমকির মধ্যেই বৃহস্পতিবার শেয়ারবাজারে লেনদেন শুরু হয়। তবে আগের কয়েক কার্যদিবসের মতো এদিনও লেনদেন শুরুর দিকে পতনের আভাস দিতে থাকে। কিন্তু বেলা ১১টার পর থেকে ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার আভাস মেলে। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সূচক ঊর্ধ্বমুখী হতে থাকে। ফলে দিনের লেনদেন শেষে দেখা মেলে বড় উত্থান।
লেনদেন চলাকালেই বাজারে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে শেয়ারবাজারের চলমান সমস্যা সমাধানে ডিএসই থেকে বিএসইসির কাছে একগুচ্ছ প্রস্তাব দেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে- ভালো কোম্পানি আনতে আইপিও প্রক্রিয়ায় সংস্কার ও সঠিক দর নির্ধারণে বুক বিল্ডিং সংশোধনীর প্রস্তাব, প্রাইভেট প্লেসমেন্টে কম ও আইপিওতে বেশি শেয়ার ইস্যু, উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের লক-ইন শেয়ারে সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি অব বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল) এর মাধ্যমে বিশেষভাবে নজরদারি রাখা, গ্রামীণফোনের ওপর এনবিআর আরোপিত কর জটিলতার সমাধান ইত্যাদি।

ডিএসই’র এই উদ্যোগের ইতিবাচক প্রভাব পড়ে সার্বিক শেয়ারবাজারে। ফলে একের পর এক প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম বাড়তে থাকে। দিন শেষে ডিএসইতে লেনদেনে অংশ নেয়া ২৪৮টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম বাড়ার তালিকায় নাম লেখায়। বিপরীতে দাম কমেছে ৫৭টির। অপরিবর্তিত রয়েছে ৪০টির দাম। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম বাড়ায় ডিএসই’র প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স আগের কার্যদিবসের তুলনায় ৬১ পয়েন্ট বেড়ে ৫ হাজার ৩২১ পয়েন্টে উঠেছে। অপর দুটি সূচকের মধ্যে ডিএসই-৩০ আগের দিনের তুলনায় ১৭ পয়েন্ট বেড়ে ১ হাজার ৮৯৭ পয়েন্টে এবং ডিএসই শরিয়াহ সূচক ১০ পয়েন্ট বেড়ে ১ হাজার ২২৭ পয়েন্টে অবস্থান করছে।

মূল্যসূচকের এই উত্থানের পাশাপাশি ডিএসইতে বেড়েছে লেনদেনের পরিমাণ। দিনভর বাজারটিতে লেনদেন হয়েছে ৩৫২ কোটি ১৩ লাখ টাকা। আগের কার্যদিবসে লেনদেন হয় ৩১৪ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। সে হিসেবে আগের কার্যদিবসের তুলনায় লেনদেন বেড়েছে ৩৭ কোটি ৫৯ লাখ টাকা।

অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের সার্বিক মূল্যসূচক সিএসসিএক্স ১১০ পয়েন্ট বেড়ে ৯ হাজার ৮৪২ পয়েন্টে অবস্থান করছে। বাজারটিতে লেনদেন হয়েছে ১৮ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। লেনদেন হওয়া ২৩৬টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৭৬টির দাম বেড়েছে। বিপরীতে দাম কমেছে ৪৪টির। দাম অপরিবর্তিত রয়েছে ১৬টির।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত শেয়ারগুলোর দরের ভিত্তিতে সূচক ওঠানামা করবে এটাই স্বাভাবিক। তবে বাজারে স্থিতিশীলতার জন্য এ ধরনের বড় মূলধনি কোম্পানির তালিকাভুক্তি বাড়ানো প্রয়োজন।

Logo-orginal