, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

admin admin

কালপরিক্রমায় সেকাল আর একালের ঈদ-আনন্দ”

প্রকাশ: ২০১৯-০৫-২৫ ১৭:৪৮:৪৩ || আপডেট: ২০১৯-০৫-২৫ ১৭:৪৮:৪৩

Spread the love

সাফাত বিন ছানাউল্লাহ্:
জাতীয় কবির অমর বাণী
” ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এল খুশির ঈদ।” একটা সময় ছিল খুশির ঈদকে উৎযাপনের । দীর্ঘ এক মাস সিয়াম-সাধনার দিন শেষে শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই মেতে উটে বাধনহারা আনন্দে। এখন আর সেই দিন নেই, হারিয়ে গেছে স্বৃতির অতল গহীনে। মানুষের মধ্য থেকে চলে গেছে- মায়া, মমতা, শ্রদ্ধা, স্নেহ আর বিশাল দায়িত্ববোধ। বিভিন্ন অনুষ্ঠান উৎযাপনের ক্ষেত্রেও এসেছে ভিন্নতা।

আহা! ছোটবেলার ঈদ কত মধুময় ছিল, ছিল বিচিত্রতা। একা মনে বসলে আজো ফিরে যাই সেই দিনগুলোতে। আমাদের পরিবারের আমেজ ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। দাদা যেহেতু পীর সাহেব ও সম্মানীয় ছিলেন সেহেতু ওনার মুরিদানের মধ্যে ঈদ পালনের রীতি ছিল- প্রতি বছর চাঁদরাতে এক বিশাল ডেকসিতে শিরণী পাকানো হতো। ঈদের দিন সকালে নামাজের আগে খুব ভোর থেকে মুরিদরা এসে শিরণী খেত আর ঈদি-চাউল উপহার দিত। এই রেওয়াজ প্রায় ৫০-৬০ বছর আগে থেকে আজো চালু আছে আমাদের বাড়ীতে, যদিও নেই তখনকার কোলাহল আর প্রাণচাঞ্চল্য।

আমি তো মহান দাদাজানকে পাইনি, মায়ের বিয়ের আগেই ওনি দুনিয়া থেকে পর্দা করেন। জন্মাবার পরের প্রায় দেড়যুগ পেয়েছি দাদু আর বাবার স্নেহ যদিও দুজনই আজ ওপারের যাত্রী। স্বৃতির ক্যানভাস থেকে যতটুকু মনে পরে, রমজানের মাঝখানে সবাই একসাথে শপিং করতে যাওয়া, আমরা সকলেই খুব মজা করতাম। শহর থেকে ঈদের কাপর পাটাতেন দুই ফুফুও। চাঁদরাতের দিনের শুরু থেকে ছিল উত্তেজনা কখন রাত আসবে। সন্ধায় দাদার এক মুরিদানের ছেলে ইসমাইল বদ্দা আসতেন শিরণী পাকাতে। বাবাতো সার্বক্ষণিক থাকতেন, সাথে ঘুরঘুর করতাম আমি আর ছোট্ট ভাই রিফাত। তখনো আর এক ছোটভাই তপু, বোন ঐশি পৃথিবীতে আসেনি। অন্যরকম এক রোমাঞ্চ কাজ করত আমাদের মনে। বাবাদের সঙ্গে থাকত পাড়ার মুসা দাদা, দুলাদাদা প্রমুখ। গভীর রাতে সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে বাবা ফাতেহা দিতেন। তারপর দাদু-আম্মু সামনের বারান্দায় নতুন পাটি বিছানা দিতেন খুশির দিনের জন্য। ঈদের আনন্দে সেই রাত যেন কত দীর্ঘ, শেষ হতোনা কিছুতেই। এপাশ ওপাশ করে কোন রকম রাত শেষে যখন মসজিদে আজানের ধ্বনি তখন বিছানা ছেড়ে উটে গোসল সেরে পাঞ্জাবি-পায়জামা পরে বারান্দায় বসতাম বাবার পাশে। একে একে আসত দাদার শিষ্যরা। ওরা আসার সময় চাউল কেউ ঈদি (বখশিশ) নিয়ে আসতেন। সেই শিরণীর মধ্যে এমন স্বাদ ছিল সেই মজা অন্যান্য খাবারের মধ্যে ছিলনা, সবাই বলত এটা নাকি দাদার কারামাত (অলৌকিক ক্ষমতা)।

এইসব আনুষ্ঠানিকতার মাঝখানে সকাল ৮টায় সবাই চলে যেতাম আমাদের মাদ্রাসার ঈদগাহে। নামাজ শেষে পুরা এলাকার যারা বিভিন্ন কারণে দেশের নানা প্রান্তে সবার সাথে দেখা হতো সালাম বিনিময় ও কোলাকুলিতে ধনী-গরিব-সাদা-কালো-লম্বা-বেটে সবাই এক ও অভিন্ন। ঈদগাহ থেকে কবর জিয়ারত করে মা-বাবাকে সালাম করে বেড়িয়ে পরতাম প্রতিবেশী বড়দের সালাম করতে। ওরাও ভালবেসে দিতো ঈদি, কেউ ১০টাকা কেউ ২০ টাকা সেইসময় অনেক বেশী। সকাল থেকেই বাড়ীতে মেহমানদারি করতে হতো সমানতালে দম রাখার সময়টুকু পাওয়া যেতনা। শহর থেকে বড় আব্বুও আসতেন, সব আনন্দের মাঝে বড়দের কাছ থেকে ঈদ সম্মানী নেয়াটা নতুন মাত্রা যোগ করত।

একটি স্বৃতির কথা আজো মনে পরে, আমি ছোট ছিলাম তাই আশেপাশের পাড়াতো ফুফুদের সাথে প্রতিবছর বেড়াতে যেতাম। রহিমা আন্টি, মরিয়ম আন্টি, রোকেয়া আন্টি, পারভিন আন্টিরা আমাকে নিয়ে যেত কোথাও গেলে। একবার হল কী- সবাই আমাকে তৈরি হতে বলল, আসলে তাদের উদ্দ্যেশ্য ছিল আমাকে না নিয়ে যাওয়ার। তো আমি কাপর পরে বসে আছি ওদের জন্য অনেক সময় অপেক্ষা করার পর শুনলাম আন্টিরা চলে গেছে। সেদিন কিযে খারাপ লেগেছিল, সারাদিন কেঁদেছিলাম। দিনগুলোর কথা ভাবলে ফিরে যাই অন্য এক জগতে। ফুফুরাও এখন এক জায়গায় নেই, পৃথিবীর চিরায়ত নিয়মে যার যার সংসার জীবন নিয়ে ব্যস্ত। যা হোক, নিজ বাড়ীর ঈদ আনন্দ শেষে দুই দিন পর চলে যেতাম নানাবাড়ি, কোন এক কবি তো বলেছেন “নানাবাড়ি রসের হাড়ী” ওখানে নানা,নানু,মামা আন্টিদের আদর কখনও ভুলার নয়। মামাত ভাই-বোন, খালাতো ভাই-বোন আর ভাগ্নে ভাগ্নিদের সাথে একটা অন্যরকম ঈদ কাটতো আমাদের।
আমার নানাভাই ছিলেন মহান একজন ব্যক্তিত্ব। বীর মুক্তিযোদ্ধা, বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, লেখক-কলামিষ্ট বহু গুণে গুণান্বিত নানা সবকিছু ছাপিয়ে ছিলেন অসাধারণ একজন মজার মানুষ। প্রতি ঈদে আমাদের
(ভাই-বোনদের) কোলাহলের প্রধান আকর্ষন ছিলেন তিনি। সবাই একত্রিত
(আমি, রিফাত, শেফা,এশা,আদিবা,পলি আপু,শাকিল,সৌরভ,তপু,আনিকা, আশফাক, নিসা, সাকিব ভাই সাথে ছোট্ট কয়েকজন ভাগ্নে-ভাগ্নি) হলেই আড্ডা জমাতাম ওনার রুমে। একের পর এক গল্প, কৌতুক, ধাধা সবকিছু যেন মুহূর্তের মধ্যে নিত্যনতুন বানাতে পারতেন তিনি। আমাদের সাথে যোগ আড্ডায় যোগ দিন নানু আন্টিরা। নানুর মত রত্নগর্ভা একজন মহীয়সী রমণীও আমাদের আদরে আগলে রাখতেন পরম মমতায়।

এরপর নতুন মাত্রা আনন্দে নতুন মাত্রা যোগাতে সবাই মিলে বেড়িয়ে পরতাম ঘুরতে। পটিয়া ফারুকী পাড়ার বিখ্যাত দিঘীর পাড় ছিল বেড়ানোর পছন্দের জায়গা। চারদিকের নজরকারা পরিবেশ আর গ্রামীণ পথে যেন চোখ জুড়ান নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মন কারবেই। ঘুরতে ঘুরতে সবাই চলে যেতাম এলাকার আরেক জনপ্রিয় দোকান গুয়াতলীর “মিষ্টি” খেতে। এই দোকানের ভিন্ন স্বাদের মিষ্টির খ্যাতি সারা পটিয়া জুড়ে লোকের মুখে মুখে ফেরে। সবাই দলবদ্ধভাবে মিষ্টি অনেক মজা করে খেতাম। এরপর সারাদিন নানান জায়গায় ঘুরেফিরে অবশেষে সন্ধায় ক্লান্ত শরীরে নিড়ে ফেরা সবই আজ স্বৃতি।
এখন আর ওভাবে ঈদকে উৎযাপন করা হয়না। সৃষ্টিকর্তার ডাকে না ফেরার দেশে চলে গেছেন প্রিয় মানুষগুলোও, তবুও তাদের সাথে কাটানো প্রিয় মুহূর্তগুলো কখনও হৃদয় থেকে মুছে যাওয়ার নয়। স্বপ্নে ভাসে আজো।
মহান আল্লাহ তাদের জান্নাতবাসী করুন ।।

লেখক : সাফাত বিন ছানাউল্লাহ
কবি, ছড়াকার ও প্রাবন্ধিক
সদস্য : চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্র (সিএইচআরসি)

Logo-orginal