admin
প্রকাশ: ২০১৯-০৫-১৩ ১৭:০৯:০৮ || আপডেট: ২০১৯-০৫-১৩ ১৭:০৯:০৮
রাজধানীর দক্ষিণখানে একই পরিবারের তিন লাশ উদ্ধারের ঘটনায় পরিবার আত্মহত্যার কথা বললেও তাদের তিনজনকেই হত্যা করা হয়েছে বলে ময়না তদন্তের রিপোর্টে জানা গেছে।
সোমবার বিকেলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা: সোহেল মাহমুদ ময়না তদন্ত শেষে এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, জাহানারা বেগম মুক্তা ও মেয়ে আফিয়া সুলতানা মিমকে গলাটিপে হত্যার আলামত পাওয়া গেছে। এছাড়া মুক্তার গায়ে একটি ধারানো আঘাত রয়েছে। বড় ছেলে মুহিব হাসান রশ্মির গলায় ধারালো অস্ত্রের আঘাত রয়েছে। তাতে ধারণা করা হচ্ছে তাকে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে।
আত্মহত্যার কোনো চিহ্ন বা আলামত ময়না তদন্তে তারা পাননি বলেও জানিয়েছেন ডা: সোহেল মাহমুদ। এছাড়া আরো উচ্চ তদন্তের জন্য ভিসেরা নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। যা পরবর্তীতে আরো অধিকতর তদন্তের জন্য প্রয়োজন হতে পারে। তিনি জানান, ঘটনার বিষয়ে আরো বিস্তারিত জানতে ঘটনাস্থলে কয়েকটি টিম কাজ করছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
এর আগে দুপুরে জানতে চাইলে জাহানারা চাচা জানান, জাহানারার মেয়ে আফিয়া সুলতানা প্রতিবন্ধী ছিল। তাতে আফরোজা সব সময় মানসিক চাপে থাকতেন। তাদের এক ভাই আমেরিকা প্রবাসী। আফিয়ার চিকিৎসা অন্যন্যা কাজে তারা সার্বিক সহযোগিতা করতেন। টাকা পয়সার কোন অভাব ছিল না। হয়তো মেয়েটির কারণে সে আত্মহত্যা করে থাকতে পারে। তবে ছেলে মুহিব হাসান হত্যার বিষয়ে তিনি কিছুই বলতে পারেননি।
ময়না তদন্তের পর হত্যার বিষয়ে কারা জড়িত থাকতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, প্রশাসন জানতে পারবে। এ বিষয়ে আমার জানা নেই। জমিজমা ও পারিবারিক কোনো বিরোধ আছে কিনা জানতে চাইলে ‘নেই’ বলে জানান তিনি।
মুক্তার ভাই মনিরুল হকের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, আমাদের টাকা-পয়সার কোনো অভাব ছিল না। তার স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে আমরা ভরণ-পোষণ দিয়ে আসছি। ছোট ভাই আমেরিকা থাকে। সেও মুক্তার পরিবারের সার্বিক দেখাশুনা করতেন। তবে কি কারণে এমন হলো বলতে পারছি না।
প্রতিবেশি তফাজ্জল হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সে আসছে বেশিদিন হয়নি। তাদের পরিবারের জায়গা জমি নিয়ে কোনো বিরোধ আছে কিনা আমার জানা নেই।
জানা যায়, মুক্তার স্বামীর মৃত্যুর পর পৈতৃক জমিতে একটি বাড়ি করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল ভাইদের। দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলে বাড়ি করে না দেয়ায় ভাইদের বার বার বলতেন। কিন্তু পরিবারের একটি পক্ষ চাচ্ছিলেন না মুক্তা পৈতৃক ভিটায় স্থায়ী হোক। এছাড়া একমাত্র মেয়ে আফিয়া মানসিক প্রতিবন্ধী হওয়াতে মুক্তাও সব সময় মানসিক চাপে থাকতেন।
এর আগে রাজধানীর উত্তরখান এলাকার একটি বাসা থেকে রোববার রাতে জাহানারা বেগম মুক্তা (৪৮), ছেলে কাজী মুহিব হাসান রশ্মি (২৮) ও মেয়ে আফিয়া সুলতানা মিমের (২০) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। একই সময় পুলিশ বাসার টেবিল থেকে একটি চিরকুটও উদ্ধার করে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের দক্ষিণখান জোনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার হাফিজুর রহমান রিয়েল জানান, স্থানীয় লোকজনের মাধ্যমে খবর পেয়ে দরজা ভেঙে বাসার ভেতরের একটি কক্ষে মা ও দুই সন্তানের লাশ পাওয়া যায়। লাশ দেখে মনে হয়েছে দুই-তিন দিন আগে তাদের মৃত্যু হয়েছে। এ বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ।
পুলিশ সূত্র জানায়, উত্তরখান এলাকার ময়নারটেক মহল্লার চাপানেরটেক এলাকার একতলা একটি বাড়িতে চলতি মাসের প্রথম দিকে (রোজার দ্বিতীয় দিন) ভাড়ায় ওঠেন জাহানারা বেগম। রোববার ইফতারের পর স্থানীয় লোকজন ওই বাসা থেকে দুর্গন্ধ পেয়ে পুলিশে খবর দেয়।
উত্তরখান থানার পুলিশ গিয়ে বাসার দরজা ভেতর থেকে বন্ধ পায়। পরে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে শয়নকক্ষের মেঝেতে ছেলে মহিব হাসান রশ্মির লাশ এবং বিছানায় মা জাহানারা বেগম ও মেয়ে আফিয়া সুলতানা মিমের লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। তিন কক্ষের ওই বাসার দরজা-জানালা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল।
একইসাথে তিনটি লাশ উদ্ধারের খবর পেয়ে পুলিশেরে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও ঘটনাস্থলে ছুটে যান। আলামত সংগ্রহের জন্য খবর দেয়া হয় সিআইডির ক্রাইম সিন বিভাগের সদস্যদের। র্যাব, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন—পিআইবি, মহানগর গোয়েন্দা পুলিশসহ পুলিশের অন্যান্য ইউনিটের সদস্যরা ঘটনাস্থলেও ছুটে যান।
লাশ উদ্ধার প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ঘরের মেঝেতে শুকিয়ে যাওয়া রক্ত ছড়িয়ে আছে। ছেলেটির লাশ মেঝেতে ওপর পড়ে ছিল। আর বিছানাতে পাশাপাশি মা-মেয়ের লাশ ছিল। তাদের শরীরের কোথায় ক্ষত চিহ্ন রয়েছে, প্রাথমিকভাবে তা বোঝা যায়নি। তিন-চার দিন আগেই মৃত্যু হওয়ার কারণে লাশগুলোতে পচন ধরে গেছে। লাশের শরীরে মাছি ভনভন করছিল।
পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, ওই বাসার যে কক্ষ থেকে লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, সেই কক্ষের টেবিলে মোবাইল দিয়ে চাপা দিয়ে রাখা একটি চিরকুট উদ্ধার করা হয়েছে। সেই চিরকুটে লেখা ছিল— ‘আমাদের মৃত্যুর জন্য আমাদের ভাগ্য এবং আমাদের আত্মীয়-স্বজনের অবহেলা দায়ী। আমাদের মৃত্যুর পর আমাদের সম্পত্তি গরিব মানুষকে দান করা হোক। ইতি— জাহানারা বেগম মুক্তা’।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এই চিরকুটের লেখা নিহত ব্যক্তিরাই লিখেছেন নাকি অন্য কেউ তাদের হত্যার পর মোটিভ অন্যদিকে নেয়ার জন্য লিখেছে তা তদন্তের বিষয়। নিহতদের আত্মীয়-স্বজনদের খবর দিয়ে পুরো ঘটনা জানার চেষ্টা চলছে। খুব শিগগিরই এই মৃত্যুর রহস্য উদঘাটন করা হবে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, নিহত মা জাহানারা বেগমের স্বামীর নাম মৃত ইকবাল। তার বাবার নাম জহিরউদ্দিন আহমেদ। তাদের গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব থানাধীন জগন্নাথপুরে। জাহানারা বেগমের ছেলে মহিব সম্প্রতি শেষ হওয়া ৪০তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন। মেয়েটি কোথায় পড়াশোনা করতেন, তা জানা যায়নি। সূত্রঃ নয়া দিগন্ত ।