, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪

jamil Ahamed jamil Ahamed

বরগুনার ঘটনা কি বাংলাদেশেরই প্রতিচ্ছবি নয়?

প্রকাশ: ২০১৯-০৬-৩০ ২০:২৯:৩৯ || আপডেট: ২০১৯-০৬-৩০ ২০:২৯:৩৯

Spread the love

মুক্তমত ডেস্কঃ ভিডিডিওটা কি দেখতে পেরেছেন পুরোটা? বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে নেয়াজ রিফাত শরীফ নামের এক যুবককে যেভাবে কুপিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটলো সেই ভিডিও কতজন দেখে শেষ করতে পেরেছেন জানি না। এমন ভয়ঙ্কর দৃশ্য সহ্য করা কঠিন। কিন্তু বরগুনার ঘটনা কি আসলেই বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নাকি বাংলাদেশের চলমান সমাজ ব্যবস্থার এক প্রতিচ্ছবি। ভাবুন তো একবার। একের পর এক ঘটনা যুক্ত করুন।

কলামিস্ট শরিফুল হাসানের গবষেণা মূলক লেখাটি দৈনিক স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে লেখক সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন ।

“দেখুন রাজনৈতিক আত্মীয় স্বজন প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে আছেন বলেই বরগুনায় একদল বখাটে ক্রমেই শক্তিশালী ও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। এলাকার লোকজন প্রতিবাদ করার সাহস হারিয়ে ফেলেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, আদালত কেউই তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে পারেননি। খুনের ভিডিওটা ভাইরাল হওয়ার পর সেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা, প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন, খুনিরা ধরা পড়া যাবে, বিরোধী দলের বক্তব্য, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মেয়েটাকে গালি দেওয়া সব ঘটনাগুলো মেলান।

আমি গত কয়েকদিনের সংবাদ ও ফেসবুক দেখে নয়টি বিষয় মেলাতে পেরেছি। মিলিয়ে নিতে পারেন আপনিও। দেখবেন বর্তমান বাংলাদেশের এক দারুণ প্রতিচ্ছবি উঠে আসবে।

রাজনৈতিক আশ্রয় প্রশ্রয়ে অপরাধীরা বেপরোয়া: এই দেশের বেশিরভাগ অপরাধীর পেছনে ক্ষমতাশালী কেউ না থাকে। বরগুনার ঘটনায় দেখুন। অভিযুক্ত আসামি সাব্বির আহমেদ নয়ন (নয়ন বন্ড), রিফাত ফরাজী, রিশান ফরাজী কিংবা চন্দনদের দিকে তাকান। রিফাত ও রিশান ক্ষমতাসীন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের ভায়রার ছেলে। কাজেই তারা অপ্র‌তি‌রোধ্য। তাদের সঙ্গে আছেন সা‌ব্বির। এলাকায় মাদক বিক্রি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডসহ নানা অপরাধের সঙ্গে যুক্ত। কতটা অপ্র‌তিরোধ্য তারা শুনবেন?

এক পু‌লিশ কর্মকর্তা বলছেন, তার বাসার সামনে এই বখাটেরা রোজ আড্ডা দিত। সেই পু‌লিশ কর্মকর্তার স্ত্রী প্র‌তিবাদ করায় চাপা‌তি নিয়ে তাদের ওপর হামলা চালায়। না, এরপরেও তাদের কিছু হয়নি। বরং পুলিশ কর্মকর্তাকে এলাকা ছাড়তে হয়েছে। আচ্ছা পুলিশ এতদিন কী করেছে? সাব্বিরের বিরুদ্ধে মাদক বিক্রি, সেবন, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে বরগুনা থানায় অন্তত ১০টি মামলা রয়েছে। বছর দুয়েক আগে এক তরুণকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করেন সা‌ব্বির ও রিফাত ফরাজী। না, এরপরেও তাদের কিছু হয়‌নি। বরং তাদের সঙ্গে থানা পুলিশের সখ্যতা ছিল এমন সংবাদই উঠে আসছে গণমাধ্যমে।

টেলিভিশনের এক সংবাদে দেখলাম, বরগুনার ঘটনায় আওয়ামী লীগের নেতারা পরস্পরকে দুষছেন। একদল বলছেন, অপরাধীদের দলের কোন কোন নেতা প্রশ্রয় দিয়েছেন। আরেক দল অস্বীকার করছেন।

ঘটনাগুলো মেলান। শুধু কি বরগুনা? নাকি বাংলাদেশের প্র‌তি‌টি শহর, থানা, পাড়া এভা‌বেই চল‌ছে। দেখুন আপনার এলাকায় রাজ‌নৈ‌তিক প‌রিচয় বা রাজনৈতিক পৃষ্ঠ‌পোষকতায় কারা সাধারণ জনগণকে জিম্মি করে রেখেছে। উত্তর পেয়ে যাবেন।

প্রতিবাদহীন জনতা: প্রকাশ্য সড়‌কে সবার সামনে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। পুলিশের সিসি ক্যামেরাও আছে সেখানে। আচ্ছা সিসি ক্যমেরায় যখন খুন চলছিল পুলিশ কী করছিল? আশেপাশে এত মানুষ ছিল? তারাই বা কী করছিল? না জনগণ প্র‌তিবাদ করতে যায়নি। সবার সামনে হামলা করে চলে গেছে ওরা। শুধু কি এই ঘটনা? দিনের পর দিন রাজনৈতিক দাপটে নয়ন বা তার বন্ড গ্রুপের বখাটেরা যা ইচ্ছে তাই করেছেন। কেউ তাদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে টু শব্দটিও না করেই সব সহ্য করে গেছেন।

অপরাধী সাব্বিররের তিকে তাকান। তার একমাত্র বড় ভাই সিঙ্গাপুরপ্রবাসী। তিনি বিদেশ থেকে টাকা পাঠান। তার আয়েই চলে সংসার। আর সেই টাকায় সাব্বিররা মাস্তানি করে। শুধু বরগুনায় নয়, সারা বাংলাদেশে একই ঘটনা। আমাদের কোটি প্রবাসী বিদেশ থেকে কি কষ্ট করেই না টাকা পাঠাচ্ছেন। আর সেই টাকায় অনেকেই দেশে মাস্তানি করে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু কেউ প্রতিবাদ করছি না। অন্যায় দেখেও চুপ থা‌কি আমরা।

আচ্ছা বলুন তো একটা সমাজ বা দেশ গু‌টিকয়েক খারাপ মানুষের কারণে ধ্বংস হয় নাকি অন্যায় দেখেও চুপ থাকায় ধ্বংস হয়। কেন আমরা নীরব? কেন আমরা পারছি না সামাজিকভাবে অন্যায়গুলো প্রতিরোধ করতে?

সব দোষ মেয়েদের: যেকোনো ঘটনা ঘটলেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্য‌মে আমরা ঝড় তুল‌তে পা‌রি। গীবত আর পরশ্রীকাতর জাতির সেই ঝড় সবসময়ই খুঁজবে নারীর দোষ। উঠবে তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন। বোরকা পরলে এই ধরনের ঘটনা ঘটত না এমন কথাও আসবে। মিলিয়ে দেখুন। এবারও তাই হ‌য়ে‌ছে। নিহত লোক‌টির স্ত্রীকে দুশ্চরিত্রা বানাতে মরিয়া জা‌তি। তার কয়টা প্রেম ছিল এমন কথাও উঠছে। আচ্ছা বলুন তো কারও যদি একাধিক প্রেম থাকে, আগে বিয়েও হয়ে থাকে, এভাবে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা যায়? তাহলে কেন সেটা করছি আমরা?

বিরোধী দলের মুখস্থ ভাষ্য: এই দেশের প্রতিটা ঘটনায় বিরোধী দলের ঘুরেফিরে এক কথা। বরগুনার ঘটনার পর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বলেছেন, আজকে গুম-খুন-হত্যা সমস্ত কিছু বাংলাদেশকে গ্রাস করে ফেলেছে। ওদিকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, এই ঘটনা প্রমাণ করে সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। সবক্ষেত্রে দলীয়করণ করার কারণে তা হচ্ছে। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দলীয়করণ করার কারণে। তা বিরোধী দলের নেতারা বলেন তো, দেশে কবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দলীয়করণ হয়নি? আর এসব ঘটনায় বিরোধী দলের ভূমিকা কী?

প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন! কোন ঘটনা ঘটার পরপরই শুনবেন প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন। বরগুনার ঘটার পরপরই আওয়ামী লী‌গের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জাতিকে নি‌শ্চিত করেছেন, হত্যাকারীদের যেকোনো মূল্যে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ না দিলে কি গ্রেপ্তার হবে না? আর একজন খুনিকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ কেন প্রধানমন্ত্রীকে দিতে হবে? প্রধানমন্ত্রী না বললে তাহলে কি দেশে কোনো কাজ হবে না?

কাউকে ছাড় দেবেন না স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী! এই দেশে যখনি কোনো ঘটনা ঘটে আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা বলবেন, বি‌চ্ছিন্ন ঘটনা। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক আছে। বরগুনার ঘটনার পর ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিত আমাদের বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, কেউ ছাড় পাবে না। পু‌লিশ বসে নেই। কিন্তু মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন তো, এত দিন কি পুলিশ বসে ছিল? কেন এই অপরাধীদের বিরুদ্ধে এত দিন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এমনকি পুলিশের বাসায় চাপাতি নিয়ে হামলার পরও!

বিচার ব্যবস্থার কী খবর? বরগুনার ঘটনার পরম্পরা দেখুন। দেখুন আগের ঘটনাগুলো। আসামিদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা তবুও কিছুই হয়নি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযোগ, তারা গ্রেপ্তার করে, অপরাধীরা আদালত থেকে জামিন পেয়ে যায়। আর আদালত বলে, অপরাধীদের বিরু‌দ্ধে চার্জশিট ঠিকমতো হয় না। দেশের প্রতিটা ঘটনায় এখন আদালতের মন্তব্য আসে। বরগুনার ঘটনায় উচ্চ আদালত বলেছে, অপরাধীরা যেন পালাতে না পারে। কিন্তু বারবার কেন অপরাধীরা জামিন পাচ্ছে, কেন তাদের বিচারে দীর্ঘসূত্রতা? কেন এই দেশের বিচার ব্যবস্থায় ক্ষমতাশালীরা পার পেয়ে যায় সেই বিষয়ে কী বলবে আদালত?

ক্রসফায়ারের দাবি: যেকোনো একটা ঘটনা ঘটলেই একদল লোক ক্রসফায়ার দাবি করে বসবে। যেন ক্রসফায়ারে সব সমাধান। রিফাত হত্যাকাণ্ডের পর ফেসবুকে বহুজন লিখেছেন, রিফাতের খুনিদের ক্রসফায়ার দেন। একবার হিসেবে করেছেন, এই দেশে কত হাজার ক্রসফায়ার হয়েছে। সমস্যার সমাধান কী হয়েছে? ক্রসফায়ারের চেয়েও আইনের শাসন, সুশাসন যে জরুরি সেটা আমরা ভুলে যাই।

অপেক্ষা পরের ঘটনার জন্য: পুলিশ বলছে, তারা সর্বশক্তি দিয়েই বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যা মামলার আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে হত্যাকাণ্ডের চারদিনেও মূল তিন আসামি সাব্বির, রিফাত বা রিশান গ্রেপ্তার হননি। লোকজন বলছেন, পেছনে শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রশ্রয় থাকায় এই তিনজন নানা অপকর্ম করে বারবার পার পেয়ে যাচ্ছেন।

আমি জানি আরও কয়েকদিন যাবে। এরপর আসামিরা গ্রেপ্তার হবে। সেই সাফল্য নিয়ে বেশ কথা হবে। এরপর? এরপর অপেক্ষা পরের ঘটনার জন্য।

মিলিয়ে দেখুন। এই দেশে যখন যে ঘটনা ঘটবে, যখনে যেটা ভাইরাল হবে সেটা নিয়ে মেতে থাকবে জাতি। গণমাধ্যমে ধারাবা‌হিক প্রতিবেদন হবে, জমে উঠবে টকশো। পণ্ডিতরা তাতে মত দেবেন। এরপর অপেক্ষা করতে হবে শুধু পরের ঘটনার জন্য। এরপরই আমরা আগের ঘটনা ভুলে যাব।

শেষ কথা: নানা কিছুর পরেও বাংলাদেশ এগোচ্ছে সেটা তো সত্য। কিন্তু উন্নয়নের বিপরীতে মানুষগুলো কেমন আছে? আমরা কি শান্তিতে বা স্বস্তিতে আছি? নিরাপদে আছি? মানুষগুলো চোখের সামনে অন্যায় দেখলে পালিয়ে যায় কেন? কবে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ছাড়াই কাজ হবে? কবে সর্বত্র সুশাসন আসবে বাংলাদেশে? জানি না কার কাছে আছে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর। জানি না কে দেবে উত্তর?

শরিফুল হাসান: কলামিস্ট

Logo-orginal