, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪

admin admin

মধ্যপ্রাচ্যে হুমকিতে শ্রম বাজার” খালি হাতে ফেরত আসছে বৈধ বাংলাদেশীরা

প্রকাশ: ২০১৯-১০-২৭ ০৯:৩৭:০৭ || আপডেট: ২০১৯-১০-২৭ ০৯:৩৭:০৭

Spread the love

বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানির বাজারে যেন অন্ধকার নেমে আসছে। নতুন শ্রমবাজার খুলছে না। বরং পুরনো শ্রমবাজারই একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আরব আমিরাত, কুয়েত, ইরাক, লিবিয়া, মালয়েশিয়া, লেবাননসহ কয়েকটি দেশে জনশক্তির বাজার এখন প্রায় বন্ধ আছে। আর ওমান, কাতার, জর্দানের মতো শ্রমবাজারে কর্মী পাঠানোর হার এখন তলানিতে।

এ অবস্থায় কর্মী যাওয়ার পুরো চাপ সউদী আরব, ওমান ও কাতারে। কিন্তু এই তিনটি দেশ আগের মতো শ্রমিক নিতে পারছে না। লাখ লাখ টাকা খরচ করে সেখানে গিয়ে প্রতারণার শিকার হওয়াসহ নানা কারণে অনেকেই খালি হাতে দেশে ফিরছে। বিগত ৯ মাসে শুধু সউদী আরব থেকেই দেশে ফিরেছে প্রায় ১৬ হাজার প্রবাসী নারী গৃহকর্মী ও পুরুষ কর্মী।

গত শুক্রবার দিবাগত রাত সাড়ে ১১টায় সউদী আরব থেকে সাউদিয়া এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে (এসভি ৮০৪) প্রায় ২০০ প্রবাসী কর্মী খালি হাতে দেশে ফিরেছে। তবে হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে কল্যাণ ডেস্কের কর্মকর্তা তানভীর আহমদ ঐ ফ্লাইটটিতে ১৩৭ জন কর্মী ফেরার কথা স্বীকার করেছেন। এ ছাড়া চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে সউদী থেকে ১৩০ জন এবং মরিশাস থেকে ৮০ জন কর্মী খালি হাতে দেশে ফিরেছে।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক মন্দাসহ নানা কারণে প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভুগতে হচ্ছে। স¤প্রতি যেসব কর্মী মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে গেছে, তারা কাজ না থাকা, ফ্রি ভিসার নামে প্রতারণা, আকামা না দেওয়া, প্রতারণাসহ নানা সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে। সউদী আরব ও মালয়েশিয়াতেই পাঁচ লাখের বেশি শ্রমিক অবৈধ হয়ে অমানবিক জীবন যাপন করছে। ভুক্তভোগি প্রবাসীদের দেয়া তথ্য মতে, সর্ববৃহৎ শ্রমবাজার সউদী আরবে এখন চলছে ব্যাপক পুলিশী ধরপাকড়। সউদী পুলিশের হাতে ধরা পড়ে অনেককেই খালি হাতে দেশে ফিরতে হচ্ছে। বৈধ আকামাধারী প্রবাসী কর্মীদেরও দেশে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। পরিস্থিতি এমন দিকে গড়াচ্ছে যে এসব দেখার কেউ নেই। সউদীতে পুলিশী হয়রানি বন্ধ এবং বৈধ আকামাধারী কর্মীদের আইনী সহায়তা দিতে না পারলে জনশক্তি রফতানিতে ভয়াবহ বিপর্যয় দেখা দিতে পারে বলেও বায়রার সাবেক সভাপতি গোলাম মুস্তাফা অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

গ্রেফতাকৃত প্রবাসী কর্মীর কারো কারো বৈধ আকামা থাকার পড়েও সউদী পুলিশ তাদের ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছে। এসব অসহায় প্রবাসীদের আইনী সহায়তা দিতে চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছে রিয়াদস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস। আকামাধারী প্রবাসী কর্মীদের আউট পাস ইস্যু করে দেশে পাঠানোর প্রক্রিয়ায় সহায়তা করছে দূতাবাস। দেশটিতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা এবং ন্যায্য অধিকার আদায়ে রিয়াদস্থ দূতাবাস কূটনৈতিক তৎপরাত চালাতে সক্ষম হচ্ছে না। জেদ্দাস্থ সেইফ হোমে ১৪ জন মহিলা গৃহকর্মী নিয়োগকর্তাদের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়ে চরম হতাশায় দিন কাটাচ্ছে। মদিনা সেইফ হোম ও রিয়াদ সেইফ হোমেও শতাধিক মহিলা গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফেরার জন্য প্রহর গুনছে। এসব মহিলা গৃহকর্মীর অনেকেই নিয়োগকর্তাদের কাছে বকেয়া বেতন ভাতা চেয়েও পায়নি। ল²ীপুর জেলার চর জালিয়া গ্রামের ফজল হক গাজীর বিধব মেয়ে পারভীন আক্তার সউদীর তাবুকে এক সউদী নিয়োগকর্তার বাড়ীতে দুই মাস আগে আত্মহত্যা করে মারা গেছে বলে জানা গেছে। মৃত পারভীনের বৃদ্ধ মা ছবিরন নেছা মেয়ের লাশ এক নজর দেখার জন্য রাত দিন কান্না কাটি করে দিন কাটাচ্ছেন। জেদ্দাস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেটের অনুবাদক কাম আইন সহকারী আজিজ ফোরকান গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, পারভীন আক্তার আত্মহত্যা করেছে । এ মৃত্যর কারণ কতটুকু সত্য তা তিনি নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেন না। এছাড়া মানিকগঞ্জের ফতেহপুর গ্রামের রুবেল হোসেনের স্ত্রী রোজিনা সউদীর তাবুকে কয়েক মাস আগে মারা গেছে। তার লাশ দেশে পাঠাতেও জেদ্দাস্থ কনস্যুলেট থেকে কোনো সহায়তা পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।

দীর্ঘ সাত বছর যাবত সংযুক্ত আরব আমিরাতে জনশক্তি রফতানি বন্ধ রয়েছে। দেশটিতে হাতে গোনা কিছু মহিলা গৃহকর্মী যাচ্ছে। অতিসম্প্রতি প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমদ সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর কালে দেশটির উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলাপকালে বাংলাদেশ থেকে বেশি বেশি কর্মী নেয়ার অনুরোধ জানান। কুয়েতেও জনশক্তি রফতানি হ্রাস পাচ্ছে। ২০১৭ সন থেকে মধ্যপ্রাচ্যের বাহরাইনে কর্মী নিয়োগ বন্ধ রয়েছে। ২০১৮ সনের সেপ্টেম্বর থেকে দশ সিন্ডিকেটের অনৈতিক কর্মকান্ডের দরুণ মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ রয়েছে। কাতারেও কর্মী নিয়োগের সংখ্যা কমছে।

রাজকীয় সউদী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ঘোষিত ভিশন ২০৩০ কর্মসূচির অধীনে শ্রমবাজারে শতভাগ স্থানীয়দের কর্মসংস্থানের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সউদী অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি জ্বালানি খাতের ওপর অর্থনীতির নির্ভরশীলতা কমানোরও উদ্যোগ নিয়েছে দেশটি। সউদী অর্থনীতির এ পালাবদলের চোরাবালিতে আটকা পড়ছে প্রবাসী বাংলাদেশিরা। প্রতিদিনই কাজ হারাচ্ছেন শতশত প্রবাসী কর্মীরা। নিয়োগকর্তার দেয়া অনুমতিপত্র বা আকামা হারিয়ে অনেকেই অবৈধ হচ্ছে দেশটিতে। এরপর আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়ে অনেকে খালি হাতে দেশে ফিরছে।

জ্বালানি খাতকেন্দ্রিক ও অভিবাসী শ্রমনির্ভও অর্থনীতির চাকা হঠাৎ ঘুরাতে গিয়ে স্থবির হয়ে পড়েছে সউদী আরবের বাণিজ্য ও কর্মসংস্থান খাত। বিশেষত নির্মাণ খাতের সউদী কোম্পানিগুলো পড়েছে আর্থিক বিপর্যয়ে। সউদী বিন লাদেন গ্রুপ, সউদী ওগেরসহ অনেক বড় নির্মাণ প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটাই করছে।

নির্মাণ ও সরবরাহ খাতের ছোটখাটো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোও একই কৌশল নিয়েছে। এতে বিপাকে পড়েছে বিপুল সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশি। বৈধভাবে দেশটিতে গেলেও নিয়োগকর্তা আকামা নবায়ন না করায় তারা অবৈধ হয়ে পড়ছেন। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক এড়াতে অনেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আকামা সমস্যা সমাধানে প্রতিদিনই সউদীর বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রবাসী কর্মীরা অভিযোগ করছে। দূতাবাস থেকে এ বিষয়ে ঢাকায় লিখিত প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। এসব সমস্যা দূতাবাসের পক্ষে একা সমাধান করা সম্ভব নয়। এজন্য সউদী সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। বাংলাদেশি শ্রমিকদের মধ্যে যারা আকামা জটিলতায় পড়েছে, কোম্পানি থেকে তাদের আকামা করে দেয়ার নিয়ম থাকলেও অধিকাংশ কোম্পানি সেটি করছে না। তবে বিষয়টি সমাধানে দূতাবাস কাজ করছে বলে দূতাবাসের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিয়েছে ৪ লাখ ৭০ হাজার ২৬৫ জন কর্মী। এর মধ্যে শুধু সউদী আরবেই গেছে ৪৭ হাজার ২৮৩ জন মহিলা গৃহকর্মীসহ মোট ২ লাখ ৬৮ হাজার ১১২ জন। সংযুক্ত আরব আমিরাতে গেছে মাত্র ২ হাজার ৪০৩ জন। কুয়েতে গেছে ৮ হাজার ৬০৩ জন। ওমানে গেছে ৫৩ হাজার ৯৮১জন। কাতারে গেছে ৪৪ হাজার ৬৮৪ জন। মরিশাসে গেছে ৫ হাজার ৬১০ জন।

সংসারে স্বচ্ছলতা আনতে মাত্র পাঁচ মাসে আগে বহু স্বপ্ন নিয়ে সউদী আরব গিয়েছিলেন কুড়িগ্রামের আকমত আলী। কিন্তু তার সে স্বপ্ন এখন দুঃস্বপ্ন। ঢাকায় ফিরে আকমত আলী কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, আকামার মেয়াদ (বৈধ অনুমোদন) আরও ১০ মাস থাকলেও তাকে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।

আকমত আলীসহ ১৩৭ জন বাংলাদেশিকে গতকাল শুক্রবার রাত সাড়ে ১১টায় সউদী আরব থেকে দেশে ফিরতে হয়েছে। চট্টগ্রাম জেলার আব্দুল্লাহ বলেন, আকামা তৈরির জন্য আট হাজার রিয়াল জমা দিয়েছেন সউদী কফিলকে। কিন্তু পুলিশ গ্রেফতারের পর কফিল কোনো দায়িত্ব নেয়নি।

ফেরত আসা স¤্রাট শেখ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আট মাসের আকামা ছিল তার। নামাজ পড়ে বের হলে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। কোনো কিছুই না দেখে দেশে পাঠিয়ে দেয়। নারায়ণগঞ্জের সাইফুল ইসলাম বলেন, আকামার মেয়াদ ছয় মাস থাকার পরেও তাকে দেশে পাঠানো হয়েছে।

এদিকে, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার চালুর বিষয়ে আগামী ৬ নভেম্বর মালয়েশিয়ার পুত্রাযায়ায় দু’দেশের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবার কথা। দেশটির মানবসম্পদমন্ত্রী এম কুলাসেগারান ও বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমদের সঙ্গে বৈঠক হবে বলে জানা গেছে।

এ ছাড়াও বৈঠকে বাংলাদেশ থেকে প্রবাসী সচিব মো. সেলিম রেজাসহ আরও চারজন অংশ নেয়ার কথা রয়েছে। শ্রমবাজার চালুর বিষয়ে মালয়েশিয়ার ইচ্ছাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হবে বলে আগেই জানিয়েছেন প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী। কর্মী নিয়োগে এবার মালয়েশিয়া সরকারের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকটি বিষয় সামনে আসতে পারে। এর মধ্যে কর্মীদের কম অভিবাসন ব্যয়ে পাঠানো, কোম্পানি পরিবর্তন না করা, মেয়াদ শেষে দেশে ফিরে আসা, যোগ্য সকল রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে কর্মী পাঠানো ও মেডিকেলসহ অন্য বিষয়গুলো মালয়েশিয়ার পদ্ধতিতে পরিচালনা করা।

জনশক্তি রফতানিতে ভাটার টানের কথা উল্লেখ করে বায়রার সাবেক সভাপতি গোলাম মুস্তাফা বলেন, সউদী পুলিশ অবৈধ কর্মীদের আটক করে দেশে পাঠাতে পারেন। কিন্ত বৈধ আকামাধারী বাংলাদেশি কর্মীদের ফেরত পাঠানোর বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। তিনি বলেন, সউদী দূতাবাসে ওয়েজ আর্নার্স তহবিলের প্রচুর অর্থ জমা রয়েছে। সে থেকে গ্রেফতারকৃত আকামাধারী কর্মীদের আইনী সহায়তা দানে দূতাবাসকে আন্তরিকতার সাথে দায়িত্ব পালন করতে হবে। তিনি সউদীর শ্রমবাজার ধরে রাখতে ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানোর ওপরগুরুত্বারোপ করেন। বায়রার সাবেক সভাপতি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার নিয়ে দুর্দিন যাচ্ছে। সে বিষয়টি মাথায় রেখেই জনশক্তি রফতানির খাতকে সমৃদ্ধ করতে ব্যাপক কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে।

উৎসঃ ইনকিলাব ।

Logo-orginal