, মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

admin admin

অনিকের আঘাতে বমি ও প্রস্রাব করে আবরার

প্রকাশ: ২০১৯-১১-১৬ ২২:১৫:০৯ || আপডেট: ২০১৯-১১-১৬ ২২:১৫:০৯

Spread the love

(ছবি,ঘাতক অনিক)
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যার বিষয়ে পূর্ব থেকেই সিদ্ধান্ত নেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। গেস্টরুমে নেয়া ওই সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই আবহারকে পিটিয়ে হত্যা করে তারা।

অনিক সরকারের আঘাতে সবচেয়ে ভয়ংকর কষ্ট পেয়েছে আবরার, অনিকের মারে বমি ও প্রস্রাব করে নিহত মেধাবী আবরার, এমন তথ্য উঠে এসেছে পুলিশের দেওয়া চার্জশিটে।

গত ৫ অক্টোবর শেরে বাংলা হলের গেস্টরুমে (অতিথিকক্ষে) অভিযুক্ত আসামিদের কয়েকজন সভা করেন। সেই সভায় তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করার। পরদিন দিবাগত রাতে আবরারকে হত্যা করা হয়। আবরার হত্যা মামলায় পুলিশের অভিযোগপত্রে এসব কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

আবরার ফাহাদ হত্যার ‘মূল হোতা’ হিসেবে শেরে বাংলা হলে তার রুমমেট মিজানুর রহমানকে চিহ্নিত করেছে পুলিশ। মিজানুর রহমানই বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান ওরফে রবিনকে বলেছিলেন, ‘আবরার ফাহাদকে তাঁর শিবির বলে সন্দেহ হয়।’ মিজানের দেওয়া শিবির করার ‘তথ্যের’ ভিত্তিতে তাঁকে নিষ্ঠুরভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগপত্রে উঠে এসেছে।

পুলিশের এই অভিযোগপত্রে উঠে এসেছে, কতটা পৈশাচিক নির্যাতন করে আবরারকে হত্যা করা হয়। এমনকি কে কখন কীভাবে আবরারকে নির্যাতন করেছে, কার কী ভূমিকা ছিল, তার বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া আছে। অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, ক্রিকেট স্টাম্প এবং মোটা দড়ি দিয়ে নির্যাতন করার একপর্যায়ে আবরার ফাহাদ বমি ও প্রস্রাব করে ফেলেন। এরপর তাঁকে হলের বাথরুমে নিয়ে যাওয়া হয়। বদলানো হয় তাঁর জামা-কাপড়।

পুলিশের অভিযোগপত্রে যা আছে
বুয়েটের শেরেবাংলা হলের নিচতলার ১০১১ নম্বর কক্ষে থাকতেন আবরার ফাহাদ। একই কক্ষে থাকতেন ১৬ তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মিজানুর রহমান। মিজানুর রহমানের নাম প্রথমে মামলার এজাহারে ছিল না। তদন্তে জানা যায়, আবরার হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা ও সূচনাকারী হিসেবে চিহ্নিত মিজানুর রহমান। গত ৪ অক্টোবরের আগে যে কোনো সময় মিজানুর বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান ওরফে রবিনকে বলেন, ‘আবরারকে তাঁর শিবির বলে সন্দেহ হয়।’

মিজানুরের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মেহেদি হাসান রবিন এই বিষয়টি শেরেবাংলা হল ছাত্রলীগের নিজস্ব ফেসবুক মেসেঞ্জারে জানান। ৪ অক্টোবর শেরেবাংলা হলের ক্যানটিনে মেহেদি হাসান রবিন এবং ইশতিয়াক আহমেদ মুন্নার নেতৃত্বে অমিত সাহা, ইফতি মোশাররফ সকাল, আকাশ হোসেন, খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম, মনিরুজ্জামান মনির, মিফতাহুল ইসলাম জীয়নসহ অন্য আসামিরা মিটিং করেন। এ সময় আবরার তাঁর কক্ষে আছেন কিনা তা জানতে একাধিক সহযোগীকে পাঠিয়ে খোঁজ নেন। কিন্তু আবরার সেদিন তার কক্ষে ছিলেন না। কুষ্টিয়ায় নিজ বাড়িতে ছিলেন। পরদিন ৫ অক্টোবর মনিরের নেতৃত্বে আসামি হোসেন মোহাম্মাদ তোহা, আকাশ হোসেন, মাজেদুর রহমান মাজেদ, মোয়াজ আবু হুরায়রা সহ সকলেই গেস্টরুমে একত্রিত হয়ে মিটিং করেন। সেই মিটিংয়ে আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করার সিদ্ধান্ত হয়।

আবরারের ব্যাপারে উপস্থিত অন্যদের কাছ থেকে তিনি জানতে চান। তখন অনিক সরকার, ইফতি মোশাররফ ও মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, আবরার কোনো তথ্য দিচ্ছে না। তখন সেতু অন্যদের বলেন, ‘মারতে থাক।’

এ নির্দেশনার পর আবরারকে আবার ক্রিকেট স্ট্যাম্প, স্কিপিং রোপ দিয়ে মারা হয়। ইফতি মোশাররফ ও অনিক সরকার আববারকে ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে পেটাতে থাকেন। হাতের কনুই দিয়ে আবরারের পিঠে প্রচণ্ড আঘাত করেন। তখন সবাই মিলে প্রচণ্ড শক্তিতে আবরারকে এলোপাতাড়ি কিল-ঘুষি চড়-থাপ্পড় লাথি মারতে থাকেন। এরপর ওই কক্ষ থেকে বের হওয়ার আগে অনিক সরকার ও মেহেদী হাসান রবিন অন্যদের বলেন, ‘তোরা আবরারের কাছ থেকে তথ্য বের কর।’ তখন মনিরুজ্জামান মনির বলেন, তিনি আবরারের মোবাইল চেক করে শিবিরের তথ্য পেয়েছেন। এরপর মনিরুজ্জামান ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে আবরারকে পেটাতে থাকেন। তাবাখখারুল, নাজমুস সাদাত, এহতেশামুল তানিম, কাশীরাম জেমি আবরারকে চড়-থাপ্পড় মারেন। বাইরে থেকে আবার ওই কক্ষে ঢোকেন অনিক সরকার। হাতে তুলে নেন ক্রিকেট স্টাম্প। তখন অনিক সরকার আবার আবরার ফাহাদকে প্রচণ্ড জোরে আরও ৪০ থেকে ৫০টি আঘাত করেন। তখন আবরার বমি ও প্রস্রাব করে ফেলেন। বাঁচার জন্য ইশারা-ইঙ্গিতে আকুতি-মিনতি করেন। এমন অবস্থায় আবরারকে হলের বাথরুমে নিয়ে যাওয়া হয়। ধুয়ে মুছে আবরার ফাহাদের জামা কাপড় বদলানো হয়।

এরপর ইফতি মোশাররফ ও মেহেদী হাসানের নির্দেশে নাজমুস সাদাত, শামীম বিল্লাহ, শামসুল আরেফিন, আকাশ, মোয়াজ আবু হোরায়রা, মুনতাসির আল জেমি ও এহতেশামুল রাব্বি আবরারকে ধরাধরি করে ২০০৫ নম্বর কক্ষে নিয়ে যান। ইফতি মোশাররফ হলের মেসবয় জাহিদ হাসানকে আনেন। তাকে দিয়ে ২০১১ নম্বর কক্ষটি পরিষ্কার করানো হয়।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির পরিদর্শক ওয়াহিদুজ্জামান অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেন, আবরারকে ২০০৫ নম্বর কক্ষে নেয়ার পর ইফতি মোশাররফ অন্যদের বলেন, ‘তোরা এবার ওর কাছ থেকে বের কর বুয়েটে কে-কে শিবির করে।’ তখন মোয়াজ আবু হোরায়রা ও অমর্ত্য ইসলাম আবরারের মুমূর্ষু অবস্থা দেখে মেহেদি হাসান ওরফে রবিনকে জানান, ‘আবরারকে হাসপাতালে নিতে হবে।’ এই কথা শোনার পর মেহেদি হাসান রবিন বলেন, ‘ও নাটক করছে। শিবির চেনস না। শিবির চেনা কষ্ট।’ রাত আড়াইটার সময় ইফতি মোশাররফ, মুজাহিদ, তাবাখখারুল ও তোহা মিলে আবরারকে তোশকে করে হলের দোতালার সিঁড়িতে রাখেন।

চূড়ান্ত মারধরের পরে আসামিরা বুয়েটের চিকিৎসক ও অ্যাম্বুলেন্স ডেকে আনলে তিনি আবরারের দেহ পরীক্ষা করে মারা যাওয়ার ঘোষণা দেন।

আবরারকে হত্যার পর ক্রিকেট স্টাম্প, তোষক, বালিশ, আবরারের ল্যাপটপ, চাপাতি হলের ২০১১ নম্বর কক্ষ থেকে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মুহতাসিম ফুয়াদ এর কক্ষে নিয়ে রেখে দেওয়া হয়। বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মেহেদী হাসান রাসেল ও সহ-সভাপতি মুহতাসিম ফুয়াদ ওই হত্যাকাণ্ডের বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিয়ে অপরাধ ঘটাতে সার্বিক সহায়তা করেন। আবরারের মৃতদেহ হলের নিচে নামানোর পর তড়িঘড়ি করে সেখান থেকে সরিয়ে ফেলার জন্য মেহেদী হাসান রাসেল বুয়েটের চিকিৎসকের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। অভিযোগপত্রে আরও উল্লেখ রয়েছে, পরস্পর যোগসাজশে ও সহায়তায় শিবির সন্দেহে আবরারের বিরুদ্ধে মিথ্যা, বানোয়াট এবং ভিত্তিহীন অভিযোগ এনে নির্মমভাবে পিটিয়ে তাঁকে হত্যা করে।

Logo-orginal