, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

admin admin

করোনার পাশাপাশি মানুষের সঙ্গেও যুদ্ধ করেছি

প্রকাশ: ২০২০-০৫-৩০ ১৪:০৫:০০ || আপডেট: ২০২০-০৫-৩০ ১৪:০৫:০২

Spread the love

করোনা পরীক্ষার পর একটি শব্দ ‘পজিটিভ’ মুহূর্তেই বদলে দিতে পারে পরিস্থিতি। তখন সেই রোগী ক্ষেত্রে ভাইরাসটিই যে কেবল শত্রু হয়ে ওঠে তা নয়, অনেক জায়গায় চারপাশের মানুষও হয়ে ওঠে অমানবিক।

সেসব পরিস্থিতি কাটিয়ে কীভাবে করোনা যুদ্ধে জয়ী হলেন তার গল্প বলেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী হারুনুর রশিদ।

হারুনুর রশিদ বলেন, করোনাভাইরাস পজিটিভ নিয়ে গ্রামে অবস্থান করায় আমার অভিজ্ঞতাটি অন্যরকম। করোনার পাশাপাশি মানুষের সঙ্গেও যুদ্ধ করতে হয়েছে আমাকে। সবচেয়ে বেশি খারাপ লেগেছে সুস্থ থেকেও ঈদুল ফিতরের নামাজটি পড়তে যেতে পারিনি।

হারুনুর রশিদ বলেন, গত ১মে থেকে হালকা গলা ব্যাথা ও জ্বর। হাত-পায়ে চুলকাতে থাকে। চুলকানো স্থান লাল হয়ে ওঠে। প্রথম তিন দিন আমার এক চিকিৎসক বন্ধুর পরামর্শে ওষুধ খাচ্ছিলাম। কিন্তু চুলকানি আর জ্বর সেরে গেলেও গলাব্যথা যাচ্ছিল না। তাই ৪ মে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট ফেনী সদর হাসপাতালে চলে যাই এবং ফ্লু কর্নারে চিকিৎসকে দেখাই। চিকিৎসক আমাকে কিছু ওষুধ ও কভিড-১৯ টেস্ট করানোর পরামর্শ দেন। পরামর্শ মতো আমি ওইদিনই নমুনা দিয়ে আসি এবং বাড়িতে এসে ওষুধ খেতে থাকি আর নিজেকে কোয়ারান্টিনে রাখি। তিন-চার দিন ওষুধ খাওয়ার পর সুস্থতা অনুভব করি।

হারুনুর রশীদ আরো বলেন, আমাকে হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছিল যদি রিপোর্ট নেগেটিভ আসে তাহলে জানানো হবে না। তাই ৭-৮ দিন যাওয়ার পর আমি ধরেই নিয়েছিলাম আমার রিপোর্ট নেগেটিভ আসবে। কিন্তু না আমার ধারণা মিথ্যা হলো ১৩ মে সকালে। প্রতিদিনের মতো ঘুমাচ্ছিলাম হঠাৎ মোবাইলের শব্দে ঘুম ভাঙে। ওপাশ থেকে ফেনী সদর হাসপাতালের আরএমও জানালেন, আমার কভিড-১৯ পজিটিভ। মুহূর্তের মধ্যে পরিস্থিতি বদলে গেল। জানালা দিয়ে লক্ষ্য করলাম আমার বাড়ির সামনে লোকজন জড়ো হচ্ছে। আমাকে নিয়ে কথাবার্তা বলছে। পরে জানতে পারি ফেনীর কয়েকটা সংবাদমাধ্যমে আমার ইউনিয়নের নাম দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী করোনা আক্রান্ত লিখে নিউজ করেছে। তাতেই সবাই ধরে নিয়েছে এটা আমি। এরপর একে একে থানা, ক্যান্টেনমেন্ট, ইউএনও অফিস সহ বিভিন্ন যায়গা থেকে কল আসতে থাকে। মজার ব্যপার হলো অনেকে ফোন করে আমার কাছে জানতে চাচ্ছে আক্রান্ত ব্যক্তিকে আমি চিনি কি-না।

এদিকে, আমাকে নিয়ে এলাকায় শুরু হয় নানা গুজব। আমি ঢাকা থেকে ১৯ মার্চ বাড়িতে আসা সত্ত্বেও কেউ বলছেন আমি ঢাকা থেকে ৪-৫ দিন আগে এসেছি, কেউ বলছেন আমি ঢাকা থেকে এলাকায় করোনা নিয়ে এসেছি। ১৩ মে দুপুরে চিকিৎসক এসে আমার আম্মুও ও আমার করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা নিয়ে যান। আমাকে হোম আইসোলেশনে থাকার পরামর্শ দিয়ে যান। চিকিৎসককে দেখার জন্য আমার বাড়ির সামনে ভিড় জমে যা আমাকে রীতিমতো অবাক করেছে। এবারো গুজব চলে, কেউ বলছে পুলিশ আমাকে ঢাকা নিয়ে গেছে আবার কেউ বলে থানায় নিয়ে গেছে ইত্যাদি।

রশীদ বলেন, শারীরিকভাবে কিছুটা সুস্থ থাকলেও চারদিক থেকে কল আর মেসেজের উত্তর দিতে দিতে নিজেকে অসুস্থ মনে হচ্ছিল। তবু সবাইকে যথাসম্ভব বিষয়টি স্পষ্ট করার চেষ্টা করেছি আমি। যাই হোক, ওইদিন রাতেই স্থানীয় প্রশাসন আমাদের বাড়ির সামনে দুটি লাল পতাকা ঝুলিয়ে বাড়ি লকডাউন করে। ১৩ মে দিনটি আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। নিজেকে মানসিকভাবে অসহায় মনে হচ্ছিল সেদিন সুস্থ থাকার পরও নিজেকে অসুস্থ মনে হচ্ছিল।

করোনা আমাকে মানুষ চিনতে সহায়তা করেছে। আমার বন্ধু যারা আমার সাথে মিশেছে তাদেরও নানাভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়েছে। যদিও পরে আমার আম্মু এবং বন্ধু সবারই করোনা নেগেটিভ আসে।

আমার হোম আইসোলেশনের দ্বিতীয় দিন এক মজার ঘটনা ঘটে, আমার আম্মু পান আনার জন্য এক ছোট ভাইকে দূর থেকে টাকা ছুঁড়ে দেয়। দোকান থেকে পান আনা হয়। পরে জানতে পারি দোকানদার আমার আম্মুর হাতের ছোঁয়া টাকাটা সাবান দিয়ে ধুঁয়ে ফেলে। তবে আমার এই পরিস্থিতিতে চিকিৎসক, আমার শিক্ষক, পুলিশ, আমার সাংবাদিক সহকর্মী, বন্ধু এবং স্থানীয় নেতাদের থেকে যথেষ্ট সহায়তা পেয়েছি। আমি তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ।

রশীদ আরো বলেন, ১৩ মে’র নেওয়া নমুনায় ১৫ মে আমার করোনা নেগেটিভ আসে। অর্থাৎ করোনা পজিটিভ আসার আগেই আমি সুস্থ হয়ে গেছি। আর সুস্থ অবস্থায় লকডাউনসহ মানুষের নানা রূপ দেখেছি আমি। পরে দ্বিতীয় টেস্টের নমুনার ফল নেগেটিভ আসার একদিনের মধ্যে তৃতীয় টেস্ট নেওয়া গেলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ট্রান্সপোর্ট সমস্যার কথা দেখিয়ে আমার তৃতীয় নমুনা নেওয়া হয় ২০ মে।

কিন্তু এখানে বাঁধে আরেক ঝামেলা ২০ মে নেওয়া নমুনার ফল আসেনি। ২৫ মে সদর হাসপাতাল থেকে আমাকে বলা হয় আমার নমুনা সঠিকভাবে নেওয়া হয়নি তাই ফল আসবে না। আমাকে আবার নমুনা দিতে হবে। আমাকে নমুনা দেওয়ার জন্য হাসপাতালে যেতে বলা হয়। এদিকে আমার বাড়ি লকডাউন তাই আমি তাঁদেরকে চেয়ারম্যানের অনুমতি নিয়ে দিতে বলি।

অবশেষে চেয়ারম্যানের অনুমতি পেয়ে আমি ২৭ মে আবার নমুনা দিয়ে আসি এবং ২৯ মে আমার করোনা নেগেটিভ আসে এবং আমাকে সম্পূর্ণ সুস্থ ঘোষণা করা হয়। আমি মনে করি এভাবে অধিক সময় পরীক্ষার জন্য ব্যয় হলে একজন সুস্থ মানুষও মানসিকভাবে ভেঙে পড়বে। আমি সুস্থ থাকার পরও ১৭ দিন ঘরবন্দি থাকতে হলো। ঈদের নামাজ পড়তে পারলাম না। আর যেনো কারো সঙ্গে এমন না হয়- এই প্রত্যাশা থাকবে।

করোনা বিষয়ে করণীয় সম্পর্কে হারুনুর রশিদ বলেন, করোনা প্রতিরোধে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকা জরুরি। তাই বেশি করে প্রোটিন জাতীয় খাবার খেয়েছি। সেইসঙ্গে লবণ মেশানো গরম পানি দিয়ে দিনে ৫-৬ বার গার্গল করেছি। এছাড়া খাওয়াসহ সকল কাজে গরম পানি ব্যবহার করছি। কিছুক্ষণ পর পর লেবু ও আদা চা খেয়েছি। নিয়মিত দুধ, ডিম, ভিটামিন সি জাতীয় খাবার ও ফলমূল খেয়েছি। বাসায় শারীরিক ফিটনেসের জন্য কিছু ব্যায়াম করা যেতে পারে। সর্বশেষ চিকিৎসকের পরামর্শ মতো চলেছি।

হারুনুর রশিদ আরো বলেন, করোনার সবচেয়ে বড় চিকিৎসা হলো মনোবল ঠিক রাখা। আশপাশের মানুষের কথায় কান না দিয়ে চিকিৎসকের নির্দেশনা মতো চলতে হবে। চিন্তিত না হয়ে মনোবল ঠিক রাখলে করোনা থেকে সহজেই মুক্তি পাওয়া যায়।
উৎসঃ দৈনিক কালের কন্ঠ ।

Logo-orginal