admin
প্রকাশ: ২০২০-১০-০৩ ১২:৪৯:১৭ || আপডেট: ২০২০-১০-০৩ ১২:৪৯:১৮
আমরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪শ ব্যাচের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। ১৯৭৮ সালে মাঝামাঝি সম্ভবত আমাদের ক্লাস শুরু হয়। অল্প কদিনের মধ্যেই সবার পরিচিত ও মধ্যমণি হয়ে উঠেন হাসান মাহমুদ চৌধুরি।হাসান ভাই ছিলেন শাহজালাল হলের আবাসিক ছাত্র। একই হলের ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক। নিয়মিত সংসদ নির্বাচন হলে তিনি হতে পারতেন চাকসুর জিএস অথবা ভিপি। হাসান ভাই এমন একজন ছিলেন যাকে সবাই মনে করতেন আমি মনে হয় উনার সবচেয়ে আপন জন। এই মনে করাটা ছিল উনার আন্তরিক ব্যবহার ও সহৃদয়তার জন্য।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালযে যারা শহর থেকে যাওয়া আসা করতেন তাদের চেয়ে হলের অবাসিক ছাত্রদের পরিচিতি খানিকটা বেশি ছিল।হাসান ভাই শুরু থেকেই হলে থাকতেন। ফেনি শহরের একজন বিখ্যাত চিকিৎসক ডা. কাশেম সাহেব ছিলেন উনার বাবা। গ্রামের বাড়ি রাউজানে। বড় ভাই ডাকসুর জিএস ও পরবর্তীতে মন্ত্রী- জিয়া উদ্দিন বাবলু। এতসব পরিচয় ছাড়িয়ে তিনি ছিলেন বন্ধু বৎসল সবার আপন জন। ছাত্র রাজনীতির সাথে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুতেই তিনি যুক্ত ছিলেন। কিন্তু তার এই সম্পৃক্ততা ছিল সবাইকে কল্যাণের পথে ডাকার। ফলে রাজনীতি তাকে কারো শত্রু করতে পারেনি।তিনি ছিলেন আমাদের মধ্যে এক অজাতশত্রু।
হাসান ভাই ছিলেন গণমুখি চরিত্রের, সারল্যভরা ছিল তার চেহারা। শাহজালাল হলে অথবা রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগে তিনি ছিলেন প্রায় সবার প্রিয়মুখ।বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম কয়েক বছর শহরে থাকার পর আমি আবাসিক ছাত্র হিসাবে আলাওল হলে উঠি। এর পর হাসান ভাইয়ের সাথে দেখা গল্প গুজব আড্ডার সুযোগ আরো বেড়ে যায়। এভাবে ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত সময়ে আমাদের মধ্যে ছিল নানা ধরনের স্মৃতি। এসময় বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন মাঝে মধ্যে রাজনীতি, নির্বাচন, হল দখলসহ নানা কারণে উত্তপ্ত হয়ে উঠতো। সব ধরনের উত্থাপ- উত্তেজনার মধ্যেও হাসান ভাইকে দেখতাম শান্ত।
ছাত্র জীবন পেরিয়ে যাবার পর হাসান ভাই চট্টগ্রামেই ব্যবসা শুরু করেন। আমি চলে আসি ঢাকায়। এক সময় হাসান ভাইয়ের পুরো পরিবারই ফেনি থেকে চট্টগ্রামে চলে যায়। চট্টগ্রাম গেলে সময় পেলেই পুরনো বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করি। দুয়েক বার হাসান ভাইয়ের আগ্রাবাদ অফিসে দেখা করি। ব্যবসার নানা ব্যস্ততার মধ্যেও আমরা গেলে হাসান ভাই সময় দিতেন।
মাঝখানে হাসান ভাইয়ের ব্যবসার পরিধি বেশ বেড়ে যায়। ব্যবসার জন্য প্রায়ই বিদেশে যেতে হয়, থাকতে হয় লম্বা সময়। ফলে আগের যোগাযোগটা কিছুটা ক্ষীণ হয়ে যায়। এর মধ্যে উনি মাস্টার স্টিভিডোর্স অ্যাসোশিয়েশিনের সভাপতি এবং এফবিসিআইতে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। হাসান ভাই যখন যেখানে থাকেন অল্প সময়েই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে অসেন।গুছিয়ে রম্যরশ মেশানো সুন্দরভাবে কথা বলা ছিল হাসান ভাইয়ের বৈশিষ্ট্য।ছাত্র জীবনে রাজনীতির সাথে যেটুকু সম্পৃক্ততা তার বাইরে কর্মজীবনে সেভাবে রাজনীতিতে সক্রিয় হাসান ভাইকে দেখিনি। যদিও উনার পরিবার বিশেষত বড় ভাই জিয়া উদ্দিন বাবলু একটি দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা। কিন্তু মানুষের কল্যাণমুখি চেতনা বা আদর্শের যে বিশ্বাস তিনি লালন করতেন সেখান থেকে কখনও বিচ্যুত হননি।
২০১৭ সালের কথা। আমি তখন এক বছরের এক চুক্তিতে সাউথ এশিয়ান মনিটরে কাজ করি এবং থাকি কুয়ালালামপুরে। তখন সাবেক ব্যাংকার ও ইসলামী ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা আমাদের পরিবারের মুরব্বি নুরুল ইসলাম সাহেব চিকিৎসার জন্য মালয়েশিয়ায়। এর আগে তিনি থাইল্যান্ডের ব্যাংকক হাশপাতালে প্রায় মাস দুয়েক চিকিৎসাধীন ছিলেন। হাসান ভাইয়ের মেঝভাই ইফতেখার ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ উনি। একসাথে ইসকাটন গার্ডেন রোড মসজিদের নামাজ পড়তেন, কোরআন ক্লাস করতেন। হাসান ভাইও বিশেষভাবে সম্মান করতেন এই মুরুব্বিকে। কিন্তু হাসান ভাইয়ের আন্তরিকতার বিষয়টি এমন ছিল তিনি ব্যাংকক এবং কুয়ালামপুরে একাধিকবার পরিবারসহ দেখতে গেছেন। প্রতিবারই দেখতাম প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহায়তার হাত বাড়াতেন। অনেক দিন পর হাসান ভাইয়ের সাথে কুয়ালামপুরে দেখা।তখনও মনে হয়েছে তিনি আগের মতই আছেন।
তার মানুষের প্রতি মমত্ব ও সহয়োগিতার মনটা আল্লাহ যেনো আরো বড় করে দিয়েছেন।
হাসান ভাই চান্দগাঁও আবাসিক এলাকা কল্যাণ সমিতির সভাপতি ছিলেন। এই সমিতিকে এক ব্যতিক্রমধর্মি এসোসিয়েশন মনে করা হতো। এখানকার মসজিদ কবরস্থান সবকিছু তিনি বিশেষভাবে গড়ে তুলেছেন। রমজানের সময় সব মুসল্লির জন্য ইফতারের আয়োজন করতেন। হজ্জ্বের সময় একটি বড় দল নিয়ে আল্লাহ ঘরে যেতেন। মসজিদ মাদ্রাসা স্কুল কলেজ এতিমখানা অথবা অসহায়দের দাফন কাফন মেয়ে বিয়ে দেয়া থেকে শুরু করে সব ধরনের কল্যাণের কাজে অগ্রসর থাকতেন।আল্লাহ তাকে সামর্থ যা দিয়েছেন মনটা যেন করে দিয়েছেন তার চেয়েও বড়।
হাসান ভাইয়ের সাথে সবশেষ দেখা হয় উনার বাংলা মটরের ব্যবসায়ী অফিসে। আগে থেকেই যোগাযোগ করেছিলাম যাবো। উনার দেয়া সময় মতো আমি আর ওবায়েদ ভাই হাজির হয় অফিসে। আগেই থেকেই জানতাম হাসান ভাই খুব ব্যস্ত মানুষ। উনার অফিসে উপর তলায় একটি বিশেষ চেম্বার রয়েছে, যেখানে সাধারণত বিদেশিদের সাথে উনি মিটিং করতেন। আমাদের সেখানে নিয়ে গেলেন। পুরণো দিনের গল্প নানা অভিজ্ঞতার কথা বলতে বলতে ঘন্টা দুয়েক পার হয়ে যায়। আমরা আমাদের এক ডাক্তার অধ্যাপক বন্ধুর চিকিৎসায় সহায়তার জন্য হাসান ভাইয়ের সাথে কথা বলি। মেডিক্যাল কলেজের সেই লেখক অধ্যাপক বন্ধুকে হাসান ভাইও চিনতেন। উনি সাথে সাথেই পরিবারের খরচের জন্যে তাৎক্ষনিকভাবে এক লাখ টাকার একটি চেক দেন। বলেন, উনাকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেয়ার সময় আরো ৫ লাখ টাকা দেবেন। এমনও বললেন পরেও যদি কোন সমস্যা হয় তাহলে দেখবেন।
চিকিৎসার অর্থ যোগাড় করতে কিছুটা সময় লেগে যায়। এর পরেই চলে আসে করোনা। সবাই হয়ে যান ঘরবন্দী। ফলে সেই ডাক্তার বন্ধুকে আর বাইরে নেয়া হয়ে উঠেনি। হাসান ভাইয়ের সাথে পরের সাক্ষাৎও হয়ে উঠেনি। এর মধ্যে ফেসবুকে দেখি হাসান ভাই অসুস্থ । হাশপাতালে ভর্তি হয়েছেন। মাঝখানে জানতে পারি উনার অবস্থা একটু ভালো হয়েছে। কেবিনে নিয়ে আসা হয়েছে। পরে রোববার রাতে জানতে পারি উনার অবস্থার আবার অবনতি ঘটেছে এবং আইসিইউতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
অবশেষে খবর আসে হাসান ভাই আর নেই। তিনি সেই প্রভুর কাছে চলে গেছেন আমাদের সবাইকে যার কাছে যেতে হবে। সর্বশক্তিমান কাকে জান্নাতের মেহমান বানাবেন আমরা জানি না। হাসান ভাইয়ের জীবন ও কর্ম দেখে আমরা সাক্ষ্য দিতে পারি তিনি যে ভালো কাজ পরোপকার ও পরকালের প্রস্তুতির কাজে তিনি বড় সময় ব্যয় করেছেন। মহান আল্লাহ প্রিয় বান্দা হিসাবেই বেছে নেবেন তাকে সেই অনুনয় প্রার্থনা আমাদের। লেখক ও সাংবাদিক মাসুম খলিলির ওয়াল থেকে।