, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

Avatar n_carcellar1957

শরণার্থী নৌকা নাকি ভাসমান কবর

প্রকাশ: ২০১৫-০৫-২৯ ২০:১৭:৪৪ || আপডেট: ২০১৫-০৫-২৯ ২০:১৭:৪৪

Spread the love

BOAT1নাম প্রকাশ করা যাচ্ছে না এমন এক রোহিঙ্গা। আজ থেকে প্রায় তিন মাস আগে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ভাসান দেয় এই মানুষটি। দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের নির্যাতন ও অর্থনৈতিক বৈষম্য সহ্য করতে না পেরে খোলা সাগরের মতো বিপদসঙ্কুল পথে বিদেশে যাওয়ার জন্য রওনা দিয়েছিলেন তিনি। কারণ তার কাছে দেশে থেকে ধুকে ধুকে মৃত্যুর চেয়ে সাগর পাড়ি দিয়ে আনিশ্চিত জীবনের দিকে যাওয়া সহজ। শুধু তিনিই নন, তার মতো আরও অনেক রোহিঙ্গা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্ন সময় দেশত্যাগ করেছেন। তাদের অনেকেরই আর কোনোদিন খোঁজ পাওয়া যায়নি। আমাদের আলোচনার রোহিঙ্গা মানুষটি রাখাইন রাজ্য ছাড়ার পর টানা ৬২দিন ছিলেন খোলা সাগরের বুকে একটি নৌকায়। সঙ্গী অপর চারশ অভিবাসীর মধ্যে অনেকেই এক টুকরো রুটির জন্য মারামারি করে নিহত হয়েছেন কিংবা একে অপরকে সাগরে ফেলে দিয়েছে। কিন্তু শত প্রতিবন্ধকতার মাঝেও বেঁচে যান তিনি এবং মালয়েশিয়ার উদ্ধারকারী জাহাজ একদিন তাদের উদ্ধার করে শরণার্থী শিবিরে নিয়ে যায়।

সাগরে ভাসমান অবস্থায় তাদের যে মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়েছে তা হয়তো অনেকেই অনুধাবণ করতে পারবেন না। কিন্তু যদি চিত্রটা এমন হয় যে, গোটা দিন উত্তাল সাগরের বুকে থাকার পর সন্ধ্যের সময় মাত্র ছোটো একবাটি ভাতের স্যুপ দেয়া হয়েছে, তাহলে বোধকরি বাদবাকী দৃশ্য না কল্পনা করলেও চলবে। অসহ্য হয়ে যদি কোনো অভিবাসী একটি অতিরিক্ত গলা ভাতের স্যুপ চাইতো তখন তার উপর নেমে আসতো লোহার রডের অত্যাচার। শরীরের বিভিন্ন অংশে রড দিয়ে নির্মমভাবে আঘাত করতো মানবপাচারকারীরা। এরকম একদিন রডের আঘাতে দুজন মানুষ মারাও গিয়েছিল এবং তাদের ভাগ্য হয়েছিল উন্মুক্ত সাগরের বুক। নিজ দেশে মারা গেলে হয়তো মৃতদেহের জন্য একটু মাটি হলেও জুটতো কিন্তু আজ সৌভাগ্য প্রত্যাসী মানুষগুলোর কবর হয়েছে খোলা সাগরের বুকে।

অভিবাসী শ্রমিকদের জীবনযাত্রার এরকম ঘটনা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কল্যাণে আমরা অনেক জেনেছি। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা গত বছর প্রায় পাঁচ শতাধিক অভিবাসীদের পৃথক পৃথক সাক্ষাতকার নিয়েছিল, যারা মিয়ানমার এবং বাংলাদেশ থেকে অবৈধ উপায়ে দেশত্যাগ করেছিলেন। বস্তুত পৃথিবীর সকল প্রান্তের অভিবাসন প্রত্যাশী অভিবাসীদের গল্প প্রায় একই রকম। কিন্তু তার মাঝেও কিছু ঘটনা কিংবা কিছু অমানবিক ঘটনা আমাদের উপলব্ধিকেও নাড়িয়ে দেয়। এমনও হয়েছে যে, বাংলাদেশ থেকে অবৈধ পথে বিদেশে পাড়ি দিতে চাওয়া অভিবাসীকে থাইল্যান্ডের গহীন জঙ্গলে আটকে রেখে তার আত্মীয় স্বজনের কাছে মুক্তিপন দাবি করা হয়েছে। দুই হাজার ডলার সমপরিমান অর্থ পরিশোধ করলেই কেবল তাকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। কিন্তু মুক্তি দেয়ার ঘটনা খুবই কম, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মুক্তিপন দেয়ার পর ওই অভিবাসীদের হত্যা করে মানবপাচারকারীরা।

চলতি মাসের শুরুর দিকে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে অভিবাসী শ্রমিকদের অনেক লাশ মাটিচাপা অবস্থায় পাওয়া গেলে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি হয়। বঙ্গোপসাগর এবং আন্দামান সাগর হয়ে দীর্ঘবছর ধরেই থাইল্যান্ডভিত্তিক বেশ কয়েকটি মানবপাচারকারী দল এই পাচারের কাজ করে আসছে। জাতিসংঘের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মানবপাচারের কারণে থাইল্যান্ড সরকারের অপরিদর্শিত বাৎসরিক আয় হয় প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার। যা পুরোটাই মানবপাচারকারীদের হাত ধরে স্থানীয় বাজারে প্রবেশ করে। সাম্প্রতিক সময়ে থাইল্যান্ডের ঘটনায় এমন সব চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসছে তা সবাইকে শিউরে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। এই মানবপাচারকারীরা অনেকসময় কোস্টগার্ডের হাত থেকে বাঁচার জন্য অভিবাসী ভর্তি নৌকা সমেত ডুবিয়ে দিতো।

অনতিবিলম্বে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া সরকারের উচিত সমুদ্রে ভাসমান হাজার হাজার অভিবাসীদের আশ্রয় দেয় এবং মানবপাচারের কারণগুলো খুঁজে বের করে পদক্ষেপ নেয়া। চলতি মাসের শেষের দিকে অবশ্য মিয়ানমারে এক জরুরী বৈঠকে মিলিত হচ্ছে আসিয়ানভূক্ত দেশগুলোসহ মোট ১৭টি দেশ। এই বৈঠক পরবর্তীতে কি সিদ্ধান্ত আসবে তা এখনই বলা না গেলেও, জাতিসংঘের পক্ষ থেকে মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের এখনই নাগরিকত্ব ও অন্যান্য নাগরিক সুবিধা দেয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করছে। যদিও মিয়ানমারের পক্ষ থেকে এই চাপকে পুরোপুরি উড়িয়ে দেয়া হচ্ছে এবং রোহিঙ্গা প্রশ্নে অনঢ় ভূমিকা পালন করতে তারা। কারণ মূল সমস্যাটি মিয়ানমারের।

Logo-orginal