admin
প্রকাশ: ২০১৫-০৬-১৪ ০৮:৩২:৪৬ || আপডেট: ২০১৫-০৬-১৪ ০৮:৪৩:৪৪
চট্টগ্রাম: নগরীর বিভিন্ন পাহাড়ের পাদদেশে মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে বাস করছেন লক্ষাধিক মানুষ। পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের নিরাপদে সরে যাওয়ার জন্য প্রশাসন নির্দেশ দিলেও সরছে না তারা।
পাহাড়ে বসবাসকারীরা বলছেন, আমরা টাকা দিয়ে জমি কিনে এখানে ঘর তৈরি করেছি। এছাড়া কম টাকায় বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা পাওয়ায় অনেকে এসব স্থানে ভাড়া বাসায় থাকেন। এখান থেকে সরে আমরা কোথায় যাবো। সরকার যদি অন্য কোথাও পুনর্বাসন না করে তবে আমরা এখান থেকে সরব না।
প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, মৌসুমী বৃষ্টি শুরু হয়েছে। প্রবল বর্ষণের ফলে পাহাড় ধসে প্রাণহানি হতে পারে। তাই ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় মাইকিং করা হচ্ছে এবং নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার নোটিশ দেওয়া হয়েছে। রোববার (১৪ জুন) থেকে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি উচ্ছেদও করা হবে।
কিন্তু পুনর্বাসনের ব্যাপারে সরকারের কোন সিদ্ধান্ত নেই বলে জানান তারা।
এদিকে চট্টগ্রামের পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীরা বলছেন, শুধু বর্ষা এলে তড়িঘড়ি করে কিছু বসতি উচ্ছেদ করা হলেও সারা বছর প্রশাসনের কোন খবর থাকে না। এছাড়া উচ্ছেদকারীদের পুনর্বাসন না করা এবং যথাযথ তদারকির অভাবে পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস বন্ধ করা যাচ্ছে না।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, বর্তমানে নগরীর ১১টি পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে ৬৬৬টি পরিবার বসবাস করছে। এর মধ্যে নগরীর একে খান মালিকানাধীন পাহাড়ে ১৮৬ পরিবার, ইস্পাহানি পাহাড়ের দক্ষিণ পাশে হারুন খানের পাহাড় ও বায়তুল আমান সোসাইটির কাছে পাহাড়ে ৫টি, কৈবল্যধাম বিশ্ব কলোনি পাহাড়ে (পানির ট্যাংক) ২৭টি, লেকসিটি আবাসিক এলাকার পাহাড়ে ১২টি, আকবর শাহ আবাসিক এলাকা পাহাড়ে ২২টি, পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছে সিটি কর্পোরেশন পাহাড়ে ১১টি, ফয়েজ লেক আবাসিক এলাকার কাছে পাহাড়ে ৯টি, ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট অ্যাকাডেমির উত্তর পাশে মীর মোহাম্মদ হাসানের মালিকানাধীন পাহাড়ে ৩৮টি, নাসিরাবাদ শিল্প এলাকা সংলগ্ন পাহাড়ে ৩টি, জালালাবাদ হাউজিং সোসাইটি সংলগ্ন পাহাড়ে ৩৩টি, মতিঝর্ণা ও বাটালি হিল পাহাড়ে ৩২০টি পরিবার ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে। এ ১১টি পাহাড় ছাড়াও আরো ১৪টি পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি রয়েছে।
তবে সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, সরকারি পরিসংখ্যানের তুলনায় পরিবারের সংখ্যা অনেক বেশি। পাহাড়গুলোর পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে কমপক্ষে লক্ষাধিক মানুষ। মতিঝর্ণা, বাটালি হিল, খুলশী, লালখান বাজার, পাহাড়তলী, টাইগার পাস, আমবাগান, বাটালি হিল রেলওয়ে কলোনি, পাহাড়তলী রেল কলোনি, বায়েজিদ বোস্তামি, হাটহাজারী উপজেলার ১ নম্বর দক্ষিণ পাহাড়তলী সিটি কর্পোরেশন ওয়ার্ডের শাহ আমানত কলোনি, জঙ্গল পাহাড়তলী, কাছিয়াঘোনা, লেবু বাগান, ভাটিয়ারীসহ সীতাকুণ্ডের সলিমপুর, লতিফপুর ও রাঙ্গুনিয়ার বিভিন্ন এলাকায় এসব মানুষের বসবাস।
মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে গত বৃহস্পতিবার (১১ জুন) থেকে চট্টগ্রামে এক দফা প্রবল বৃষ্টিপাত হয়েছে। বর্ষণ শুরু হওয়ায় তোড়জোড় বেড়েছে জেলা প্রশাসনের। তারা বৃহস্পতিবার থেকে বিভিন্ন পাহাড়ের পাদদেশ থেকে সরে যাওয়ার জন্য মাইকিং করছে। এছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ বসতি উচ্ছেদে নোটিশও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু একটি পরিবারও সেখান থেকে সরে যায়নি। শুক্রবার (১২ জুন) সকালে সরেজমিন পরিদর্শনে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারীদের সঙ্গে কথা হয় বাংলানিউজ প্রতিবেদকের।
পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীরা অধিকাংশই দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা গার্মেন্টস শ্রমিক, রিকশাওয়ালা কিংবা গরীব দিনমজুর ও খেটে খাওয়া অসহায় নিঃস্ব মানুষ। অল্প টাকায় ঘর ভাড়া নিয়ে তারা বসবাস করছে পাহাড়ের পাদদেশে। তারা বলছেন, এখান থেকে সরে তারা কোথায় যাবে?
বিউটি আকতার। বাড়ি কুমিল্লার লাকসাম এলাকায়। স্বামী বেলাল হোসেন নির্মাণ শ্রমিক। মতিঝর্ণায় বাস করছেন প্রায় ২০ বছর ধরে।
বিউটি বলেন, আমার শ্বশুর অনেক বছর আগে এখানে এসে জায়গা কিনে বসতি তৈরি করেছে। সরকার শুধু বর্ষাকাল এলে মাইকিং করে এখান থেকে সরে যেতে বলে। কিন্তু আমরা যাবো কোথায়? প্রশাসন শুধু আমাদেরকে সরে যেতে বলে। পাহাড় ধসরোধে কিছু করে না। আমরা সরে গেলে ঠিক অন্য কেউ এসে জায়গাগুলো দখল করে ঘর তৈরি করবে।
নগরীর মতিঝর্ণা পাহাড়ে বসবাসরত বাসিন্দা খালেদ জানান, নোয়াখালী থেকে তার পূর্বপুরুষরা প্রায় ৪০ বছর আগে এখানে এসে বসতি স্থাপন করে। গরীব বলে বেশি টাকা দিয়ে ভাড়া বাসায় থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই কম টাকায় এখানে ভাড়া বাসায় থাকেন।
‘সরকার যদি আমাদেরকে অন্য কোথাও পুনর্বাসন না করে তবে আমরা সরব না। ’ বলেন খালেদ।
বাটালি হিল এলাকার বাসিন্দা কামাল হোসেন পেশায় সিএনজি অটোরিকশা চালক। রংপুর থেকে প্রায় ২০ বছর আগে এখানে এসে বসতি স্থাপন করেন।
তিনি বলেন, কি জন্য আমরা এখান থেকে সরে যাবো। সরে গিয়ে যাবো কই? ছেলে মেয়েকে নিয়ে থাকব কোথায়?
পোড়াকলোনি এলাকার বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বিকল্প কোন উপায় না থাকায় মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে হলেও বাস করতে হবে।’
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ও পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব মোহাম্মদ ইলিয়াছ হোসেন বলেন, ‘পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি উচ্ছেদ অভিযানের জন্য তিনজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। রোববার থেকে উচ্ছেদ অভিযান শুরু হবে। প্রথম অবস্থায় মতিঝর্ণা পাহাড়ে অবৈধ বসবাসরতদের উচ্ছেদ অভিযান দিয়ে কার্যক্রম শুরু হবে। ’
তিনি বলেন, ‘বৃহস্পতিবার ঝুঁকিপূর্ণদের সরিয়ে যেতে মাইকিং করা হয়েছে। এর আগে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি সরিয়ে নিতে নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। তারা নিজ থেকে সরে না যাওয়ায় উচ্ছেদ করা হবে। বসবাসরত পরিবারে অবৈধ পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের চিঠি দেওয়া হয়েছে। ’
পুনর্বাসনের ব্যাপারে মোহাম্মদ ইলিয়াছ হোসেন বলেন, ‘এ বিষয়ে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে কোন সিদ্ধান্ত আসেনি। তাই বর্ষা মৌসুমে প্রাণহাণি বন্ধ করতে ঝুঁকিপূর্ণ বসতিগুলো উচ্ছেদ করা হবে। ’
পাহাড় ধস রোধে সরকার, রাজনৈতিক দলের নেতা, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও প্রশাসনের সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের ওপর জোর দেন তিনি।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, বর্ষা মৌসুমে পাহাড় ও দেওয়াল ধসে গত ৮ বছরে প্রায় ২০০ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। এর মধ্যে ২০০৭ সালের ১১ জুন স্মরণকালের ভয়াবহ পাহাড় ধসে চট্টগ্রামে ১২৭ জনের প্রাণহানি ঘটে। ২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট লালখানবাজারের মতিঝর্ণা এলাকায় পাহাড় ধসে মারা যান ১১ জন, ২০০৯ ও ২০১০ সালে নগরীর পাহাড়তলী, সিআরবি, ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে মারা যান আরও ১৫ জন।
২০১১ সালের ১ জুলাই পাহাড় ধসে একই পরিবারের ৮ জনসহ বাটালি পাহাড়ের রিটেইনিং দেয়াল ধসে ১৭ জন মারা যান। ২০১২ সালে ১৭ জুন নগরীর ফিরোজ শাহ কলোনিসহ বিভিন্ন এলাকায় ২৩ জন মারা গেছেন। ২০১৩ সালে পাহাড় ও দেয়াল ধসে মৃত্যু হয়েছে কমপক্ষে ৫ জনের।
টানা বৃষ্টিপাত হলে এবারও ব্যাপক প্রাণহানির আশংকা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
২০০৭ সালে পাহাড় ধসের ঘটনার পর চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে একটি কমিটি ২৮টি কারণ নির্ধারণ করে ৩৬টি সুপারিশ প্রণয়ন করে। তবে সুপারিশগুলো আজও বাস্তবায়ন হয়নি।
পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সিদ্ধান্তের মধ্যে ছিল- পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসরতদের উচ্ছেদ অভিযান অব্যাহত রাখা, পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা, অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ করতে পাহাড়ে পুলিশ ও আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়োজিত থাকা, পাহাড়ে কাঁটাতারের ঘের দেয়া এবং সামাজিক বনায়নের আওতায় আনা, উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের জন্য আধুনিক ও উন্নতমানের সরঞ্জামাদি ক্রয় করা ইত্যাদি।
গত ৮ বছরে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির ১৪টি সভা হয়েছে। শুধু সভা-আলোচনা ও বর্ষা মৌসুমে কয়েকদিন উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে কমিটির কার্যক্রম।
অভিযোগ রয়েছে, পাহাড় ধসে প্রাণহানি এড়াতে স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের নানা চাপের কাছে বারবার পরাভূত হচ্ছে প্রশাসন। পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের পুনর্বাসন ও অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে প্রশাসনের আন্তরিকতা থাকলেও সরকার ও বিরোধী দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা বাধা হয়ে দাঁড়ান।
পরিবেশ আন্দোলন কর্মী শরীফ চৌহান বলেন, বিভিন্ন সময় পাহাড় ধসের ঘটনার পর তদন্ত কমিটি হয়। তারা বিভিন্ন সুপারিশও করেন। পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের সরিয়ে নিতে নানা তোড়জোড় শুরু হয়। কিন্তু বর্ষা মৌসুম শেষ হলেই সংশ্লিষ্টদের আর কোনো খবর থাকে না।’
তিনি বলেন, ‘শুধু বসতি উচ্ছেদ করলে হবে না, পাহাড় কাটা ও পাহাড়ের অবৈধ দখলও বন্ধ করতে হবে। নির্বিচারে পাহাড় কাটায় চট্টগ্রামের ভূ-প্রাকৃতিক কাঠামো পাল্টে যাচ্ছে। এখনই পাহাড় রক্ষা না হলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটতে পারে।’