, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪

admin admin

সাংবাদিকের ভাষা : আবদুর রহমান খান

প্রকাশ: ২০১৫-০৬-২৮ ১৪:০৫:৩৩ || আপডেট: ২০১৫-০৬-২৮ ১৪:১১:০৯

Spread the love

abdur Rahman khan

আরটিএমনিউজ২৪ডটকম, ঢাকা :    নিজের মনোভাব অন্যের নিকট প্রকাশ করার জন্য মানুষ ভাষার আবিষ্কার করেছে। আদিম মানুষ মুখ দিয়ে নানা  শব্দ করে, ইশারা-ইঙ্গিত বা  অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করেছে। ক্রমশঃ তারা সঙ্কেত চিহ্ন, ছবি,  হরফ বা লিপি  আবিষ্কার করে।

 

মানুষের ভাষা তাদের পোশাক-পরিচ্ছেদের মতই সময়, স্থান ও পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে বিবর্তিত হতে থাকে। আদিম মানুষ নিজেদের লজ্জা নিবারণ ও প্রতিকূল আবহাওয়া থেকে  রক্ষা পেতে পরিধেয় পোশাক তৈরি করে নিয়েছিল। সময়ের পরিক্রমায় পোশাক হয়ে ওঠে মানুষের সংস্কৃতি, সামাজিক ও ধর্মীয় পরিচিতির ঐতিহ্য।

 

তেমনি, ভাষাও হয়ে উঠেছে সমাজ-সভ্যতা বিকাশের বাহন। স্থান, কাল ও পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী ভাষার গতি-প্রকৃতি, বর্ণ, ব্যঞ্জনা বা দ্যোতনা পরবর্তিত হতে থাকে। এ কারণে বদলে যায় ভাষার প্রয়োগ, আঙ্গিক এমনকি অর্থ পর্যন্ত।

 

অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন মানুষের কাছে নতুন ধর্মজ্ঞান বা রাজনির্দেশ পৌঁছে দেবার জন্য প্রস্তর,  তামার পাত,  মাটির  ফলক বা গাছের পাতায় লিপি লেখার ইতিহাস রয়েছে। পরবর্তীতে মানুষ লেখার কাজে চামড়া এবং কাগজের ব্যবহার আয়ত্ব করে। ফার্সিতে চামড়াকে “পুস্ত” বলা হয়। সেখান থেকেই পুস্তক শব্দটি এসেছে।

 

এভাবে অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মানুষের জন্য নতুন তথ্য, জ্ঞান ও বিনোদন বিস্তৃতভাবে পৌঁছে দেবার জন্য লিখিত ভাষায় পুস্তক, সাহিত্য-সাময়িকী এবং দৈনিক পত্রিকার প্রচলন হয়।

 

পত্রিকাকে বলা হয় চটজলদি সাহিত্য। পত্রিকার পাতায় দ্রুত এবং  নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে খবর, নিবন্ধ বা প্রবন্ধ লিখতে হয়। তাই সেখানে নিখুঁত সুন্দর সাহিত্য রচনার সময় কোথায়?

 

পত্রিকা যেহেতু এখন অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে তাই সাংবাদিকের ভাষাও তার দিনলিপির ভাষায় পরিণত হয়েছে।

 

তবে সাংবাদিকতার সব ছাত্রই জানে যে, পত্রিকা বা গণমাধ্যমের ভাষা হতে হয় গণমানুষের ভাষা; সহজবোধ্য এবং সরল বাক্যে রচিত। আর সেটা অবশ্যই হতে হবে যথাযথ শব্দে ও শুদ্ধ বাক্যে লেখা।

 

২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পরদিন ঢাকার একটি বহুল প্রচারিত বাংলা দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায়  আটকলামব্যাপী প্রধান শিরোনাম ছাপা হয়–”নজিরবিহীন ‘অভিনব’ ভোট”। লাল হরফে খুবই নজরকাড়া ব্যানার হেডলাইন।

 

বাংলা ভাষায় সাধারণ জ্ঞান আছে এমন পাঠক এরকম একটা হেডলাইন দেখে অবাক না হয়ে পারেনি। যার নজির নেই বা পূর্বে কখনও ঘটেনি এমন কিছুকে নজিরবিহীন বলা হয়। তাহলে সিঙ্গেল কমার ভেতরে ‘অভিনব’ লিখে কি বুঝানো হলো? অভিনব শব্দের অর্থ তো যা আগে কখনো দেখা যায়নি, অপূর্ব,  নতুন একটা পন্থা। তাহলে দেখা যাচ্ছে দুটো শব্দের অর্থ একই। এরকম ভাষা প্রয়োগের মধ্যে  অভিনবত্ব থাকলেও অজ্ঞতাই প্রকাশ পায়।

 

সেই একই পত্রিকার সেই একই দিনের প্রথম পৃষ্ঠার একটি  সংবাদের  শিরোনাম ছাপা হয় “টার্গেট ছিল গণমাধ্যম কর্মীরা”।

সংবাদটির প্রথম বাক্যটি ছিল- “আসন্ন তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ভোট ডাকাতদের টার্গেট ছিল গণমাধ্যম কর্মীরা।”

 

যে নির্বাচনটি আগের দিন অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে তাকে আসন্ন বলা কী ভুল? নাকি মুর্খতা? নাকি অজ্ঞতা?

 

কুতর্কের খাতিরে ধরা যাক,  রিপোর্টার অসাবধানতাবশতঃ নির্বাচনের আগে বারবার ব্যবহৃত ‘আসন্ন’ শব্দটি দিয়ে বাক্য শুরু করেছেন। তাহলে ওই পত্রিকায় রিপোর্ট সম্পদনা করার মত কি কেউ নেই?

 

বাংলা ভাষা নিজের মাতৃভাষা বলেই যেমন খুশি শব্দ বা বাক্য লেখা যায়না।  ব্যাকরণের মৌলিক নিয়ম, বিশেষ করে বাক্য গঠন এবং  ক্রিয়া পদের ব্যবহার সঠিক না হলে অন্ততঃ শিক্ষিত পাঠক কষ্ট পায়। তাছাড়া,  নতুন শিক্ষার্থীরা ভুলটা শেখার আশঙ্কা থেকে যায়।

 

আর একটি বিষয় বুঝতে হবে যে, বাংলাদেশে বাংলা সাংবাদিকতা করতে হলেও ইংরেজী ভাষায় প্রয়োজনীয় দখল থাকা দরকার। তা না হলে পুকুরে মন্ত্রীর  ‘fish fry’ ছাড়াকে ‘মাছভাজা’ লেখা হতে পারে। অথবা পুলিশের  রাস্তায় ‘patrolling’  বদলে পেট্রোল ছিটান লেখা হতে পারে।

 

বাংলা বাক্যে বই পড়া, নামাজ পড়া, বৃষ্টি পড়া, গাছ থেকে ফল পড়া, পাড়ায় ডাকাত পড়া –  এসব  কথার মধ্যে ‘পড়া’  ক্রিয়ার রূপ ইংরেজীতে ভিন্ন ভিন্ন  হয়ে থাকে।  এটা  না জানলে সাংবাদিকতা করা যাবে না।

 

জতীয় বার্তা সংস্থায় একজন জেলা সাংবাদিক উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতকে ইংরেজিতে ‘upper body song’ লিখে কৌতুকের সৃষ্টি করেছেন  বলে সাংবাদিকদের অনেকেই জানেন।

 

কয়েক সপ্তাহ পূর্বে  ঢাকার একটি ডাকসাইটে ওয়েব নিউজ পোর্টালে ইংরেজী ভারসনে লেখা হয়েছে ‘for the sack of democracy’ . সাংবাদিক  হয়ত  বুঝাতে চেয়েছেন  ‘গণতন্ত্রের স্বার্থে’। কিন্তু  sack শব্দের অর্থ কি তাই বোঝায়?

 

খবের কাগজে কম্পিউটারের প্রবর্তন হবার ফলে সাংবাদিকতার কাজ অনেক সহজে এবং দ্রুততার সাথে করা যাচ্ছে। তবে বিড়ম্বনাও বেড়েছে এবং সেটা হচ্ছে ভাষার অজ্ঞতার কারণে।

 

সাংবাদিকতায় নতুন একটা শব্দ চালু হয়েছে  ‘spell checker journalist’। ধরা যাক, একটা  শব্দের শুদ্ধ বানান না জেনে কাছাকাছি কিছু একটা লেখা হল। কম্পিউটারের  ‘spell checker’ প্রোগ্রামে  সেটা  চিহ্নিত করে  কয়েকটি শুদ্ধ শব্দ  দেখাল।  যেমন  sack, sake, shake, sex।  এর মধ্যে কোনটি আপনার দরকার সেটা না জানলে যা ভুল হবার হয়েই যাবে।

 

বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় এরকম একটি হাস্য কৌতুক চালু আছে যে, পত্রিকা অফিসে সম্পাদনার কাজে নিয়োজিত একজন সিনিয়র সাংবাদিক তার জুনিয়র সহকর্মীকে পরামর্শ দিয়েছিলেন বানান নিয়ে সন্দেহ হলে ডিকশনারি দেখে নিতে। উত্তরে সে জুনিয়র সাংবাদিক  বলেছেন-আমার তো সন্দেহই হয় না।

 

বর্তমান সময়ের এটা দুর্ভাগ্য বলতে হবে যে, প্রতিষ্ঠান হিসেবে সংবাদেপত্র বা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার যে রকম বিস্তার ঘটেছে সে পরিমাণ দক্ষ সাংবাদিক পাওয়া যাচ্ছে না। বিশেষ করে,  ভুলটা ধরিয়ে দেবার মত দক্ষ সাংবাদিক কমই পাওয়া যায়। কারণ,  কম দক্ষ বা অনভিজ্ঞদের দিয়ে কাজ করালে কম বেতন দিলে চলে এবং  তারা মালিকদের পদলেহন করতে বেশি পারদর্শী হয়।

 

ভাষার শুদ্ধতা নিয়ে কথা বলতে গেলে অনেকেই গলা বাড়িয়ে বলেন- এভাবেও হয় ওভাবেও হয়। না,  তা হয় না। ব্যাকরণ শুদ্ধ করেই লিখতে হয়। যদিও ব্যতিক্রম রয়েছে, তবে সেটা পণ্ডিতদের জন্য।

 

কবিগুরু রবিন্দ্রানাথ ঠাকুর  “বল” খেলতে পছন্দ করতেন সেটার প্রমাণ হিসেবে কেউ বলতে পারেন তার কবিতার একটি লাইন- “বল দাও মোরে বল দাও”। অথবা পল্লী কবি জসিমউদ্দিনের “রাখাল ছেলে রাখাল ছেলে বারেক ফিরে চাও”  লাইনটি  দেখিয়ে  কেউ বলতে পারেন, এখানে  রাখাল ছেলের নাম ছিল “বারেক”। তবে  এরকম তাৎক্ষণিক জ্ঞান নিয়ে মিরাক্কেল কৌতুক অনুষ্ঠানে লোকদের  আনন্দ দেয়া যায়, কিন্তু  সাংবাদিকতা হয় না।

 

সাংবাদিক একেবারে সবজান্তা হতে হবে এমন কথা নেই। কিন্তু ভাষার ক্ষেত্রে যতটা না জানলে  চলে না  অন্ততঃ সেটুকু জেনেও  সাংবাদিকতা পেশায় আসা উচিত।  ভাষার ক্ষেত্রে মৌলিক বিদ্যার্জন জরুরি। এটা জানা থাকলে অধ্যবসায় সহকারে দক্ষতা এবং  জ্ঞানার্জন করা যায়। সাংবাদিকদের প্রতিদিন শব্দ নিয়ে খেলতে হয়। সে কারণেই শব্দের প্রয়োগ আর অপপ্রয়োগ ভালোভাবে জানতে হবে।#

 

লেখক: সাংবদিক, কলামিস্ট ও বিশেষ প্রতিনিধি, রেডিও তেহরান, ঢাকা।

Logo-orginal