, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

admin admin

ফিতরা (সদকাতুল ফিতর) কী এবং কেন ?

প্রকাশ: ২০১৫-০৭-১১ ০১:২৬:১৮ || আপডেট: ২০১৫-০৭-১১ ০১:৪৩:২৭

Spread the love

আরটিএমনিউজ২৪ডটকম ডেস্ক: পবিত্র রমজান মাসে বিশেষ কিছু আমল আমাদের জন্য রাখা হয়েছে। এর মধ্যে সাদকাতুল ফিতর একটি অন্যতম ইবাদত। ঈদের দিন গরিবদের খাবারের জন্য শরিয়তপ্রদত্ত একটি ব্যবস্থাপত্র।

সাদকাতুল ফিতর সম্পর্কে নবীজি (সা.) বলেছেন,
তোমরা এ দিনটিতে তাদেরকে অন্যের কাছে চাওয়া থেকে বিরত রাখো। জাকাতের মতো এটিও দরিদ্র মানুষের ওপর মহান আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত আমলি সহযোগিতা। ইসলামী শরিয়তের হুকুম মোতাবেক ঈদের দিনের ফজরের নামাজের আগে যে সন্তান জন্মগ্রহণ করবে তারও ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব।

ফিতরা কী?
ইসলামী শরিয়তের হুকুম মোতাবেক এটি একটি ওয়াজিব আমল। ঈদুল ফিতরের দিন সুবহে সাদিকের সময় জীবিকা নির্বাহের অত্যাবশকীয় সামগ্রী ছাড়া নিসাব পরিমাণ বা অন্য কোনো পরিমাণ সম্পদের মালিকদের পক্ষ থেকে গরিবদের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণের একটি অর্থ প্রদান করার বিশেষ আয়োজনকে সাদকাতুল ফিতর বলা হয়।

ফিতরার পরিমাণ জনপ্রতি আধা সা অর্থাৎ এক সের চৌদ্দ ছটাক বা পৌনে দুই সের গম বা সমপরিমাণ গমের মূল্য ফিতরা হিসেবে প্রদান করতে হবে।

ফিতরার পরিমাণ আসলে কত?
আমাদের দেশে প্রতি বছর ইসলামিক ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন ইসলামিক সেন্টার মাথাপিছু একটি পরিমাণ ঘোষণা প্রদান করে এবং সে ঘোষণা অনুযায়ী কোটিপতি ও মধ্যবিত্ত নির্বিশেষে সবাই ফিতরা প্রদান করে। আমাদের জেনে রাখা প্রয়োজন, নবীজি (সা.)-এর যুগে মোট চারটি পণ্য দ্বারা সাদকাতুল ফিতর আদায় করা হতো, যেমন খেজুর, কিশমিশ, জব ও পনির।

হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, আমাদের সময় ঈদের দিন এক সা খাদ্য দ্বারা সাদকা আদায় করতাম। আর তখন আমাদের খাদ্য ছিল জব, কিশমিশ, পনির ও খেজুর। [সহিহ বোখারি]

রাসুল (সা.)-এর যুগে গমের ভালো ফলন ছিল না বিধায় আলোচিত চারটি পণ্য দ্বারাই ফিতরা আদায় করা হতো। এরপর হজরত মুয়াবিয়ার (রা.) যুগে গমের ফলন বেড়ে যাওয়ায় গমকে আলোচিত চারটি পণ্যের সঙ্গে সংযোজন করা হয়।

আর তখন গমের দাম ছিল বাকি চারটি পণ্যের তুলনায় বেশি। আর মূলত এই দাম বেশি থাকার কারণেই হজরত মুয়াবিয়া গমকে ফিতরার পণ্যের তালিকভুক্ত করেছিলেন।

অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর বলেন, নবীজি (সা.) এক সা খেজুর বা এক সা জব দিয়ে ফিতরা আদায় করার আদেশ দিয়েছেন। পরবর্তী সময় লোকজন (সাহাবা আজমাইনরা) দুই মুদ গমকে (আধা সা) এগুলোর সমতুল্য মনে করে এবং আদায় করে। [বোখারি]

অতএব, ওপরের আলোচনা থেকে বোঝা যায়, গম দ্বারা আদায় করলে আধা সা বা এক কেজি ৬২৮ গ্রাম দিলেই ফিতরা আদায় হয়ে যাবে।

আর বাকি চারটি পণ্য অর্থাৎ খেজুর, জব, পনির ও কিশমিশ দ্বারা আদায় করার ক্ষেত্রে জনপ্রতি এক সা বা তিন কেজি ২৫৬ গ্রাম দিতে হবে। দেখা যাচ্ছে যে গম ছাড়া অন্য পণ্য দ্বারা ফিতরা আদায় করলে এক সা পরিমাণ দিতে হচ্ছে, যা গমের ওজনের দ্বিগুণ এবং মূল্যের দিক দিয়েও অনেক তফাত।

হাদিসে এক সা আদায় করার কথা উল্লেখ থাকার পরও তখন এর মূল্য অনেক বেশি হওয়ায় সাহাবারা আধা সা পরিমাণ গম আদায়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তখন আধা সা গমের মূল্যও অন্য চারটি পণ্যের এক সা-এর চেয়েও বেশি ছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ে আলোচিত পাঁচটি পণ্যের মধ্যে গমই হচ্ছে সবচেয়ে কম দামি পণ্য।

তাহলে এখন প্রশ্ন হলো, বর্তমানে গমের পরিমাণ হিসেবে আধা সা ফিতরা আদায় করলে হবে? হাদিসের আলোচনা থেকে এ কথাটি স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে সাহাবারা খেজুর, জব, পনির ও কিশমিশ থেকে হলে এক সা পরিমাণ এবং গম থেকে হলে আধা সা পরিমাণ ফিতরা আদায় করতেন। কারণ তখন গমের দাম অন্য সব পণ্যের তুলনায় বেশি ছিল।

আর বর্তমানে অন্য চারটি পণ্যের তুলনায় গমের দাম কম। এ পর্যন্ত হাদিসের এমন কোনো সূত্র পাওয়া যায়নি যে সাহাবারা সবাই সর্বনিম্ন দামের বস্তু দ্বারা ফিতরা আদায় করেছেন। বরং তাঁদের সবার আগ্রহ ছিল সর্বাধিক দামি পণ্য দ্বারা ফিতরা আদায় করা।

তাহলে বর্তমানে সবাই সর্বনিম্ন দামের পণ্য দ্বারা ফিতরা আদায় করছে কেন? আমাদের সময়ের সম্পদশালী আর মধ্যবিত্ত নির্বিশেষে আধা সা গম বা তার সমপরিমাণ মূল্য দ্বারা সাদকাতুল ফিতর আদায় করা সমীচীন হচ্ছে কি? এবং এতে সাদকাতুল ফিতরের আসল হক কি আদায় হচ্ছে?

শরিয়তের বর্ণনা ও হাদিসের আলোচনা অনুযায়ী সমাধান হলো- যার সামর্থ্য অনুযায়ী উলি্লখিত পাঁচটি পণ্যের যেকোনো একটি পণ্যের নির্দিষ্ট পরিমাণে ফিতরা আদায় করতেন। যার সামর্থ্য আছে উন্নতমানের খেজুর দ্বারা সে খেজুর দ্বারাই আদায় করবে। আর যার সামর্থ্য আছে কিশমিশ কিংবা জব দ্বারা আদায় করার সে তা দ্বারা আদায় করবে। যার গম দ্বারা আদায় করা ছাড়া অন্য পণ্য দ্বারা আদায় করার সামর্থ্য নেই সে গম দ্বারা ফিতরা আদায় করবে।

বেশি সম্পদশালী এবং কম সম্পদশালী নির্বিশেষ গম বা সর্বনিম্ন দামের পণ্য দ্বারা সাদকাতুল ফিতর আদায় করার বিষয়টি বিবেকবর্জিত এবং হাদিস ও শরিয়তের নির্দেশনার পরিপন্থী। তাই আসুন! আমরা সবাই নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী সাদকাতুল ফিতর আদায় করি এবং দায়সারা আদায় পদ্ধতি ত্যাগ করি।

ফিতরার আর্থ-সামাজিক গুরুত্ব
ফিতরা আদায় করা মহান আল্লাহর গুরুত্বপূর্ণ একটি আদেশ। বিত্তবান মুসলিম নাগরিকের ওপর ফিতরা ওয়াজিব করে দেওয়া হয়েছে। গরিব-অসহায় মানুষদের হক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে এই সাদকাতুল ফিতরাকে। পবিত্র রমজান মাসে রোজা পালনের পুরস্কার হিসেবে আল্লাহ মহান ঈদের আনন্দ প্রদান করেছেন। সমাজে বসবাসকারী ধনিক শ্রেণীর মানুষদের সঙ্গে সঙ্গে গরিবরাও যাতে ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পারে, এজন্য এই সাদকাতুল ফিতরের আমলকে ওয়াজিব করা হয়েছে।

ফিতরার মাধ্যমে মুসলিম সমাজে বসবাসকারী ধনীদের অর্থ গরিবদের মধ্যে বণ্টিত হয় এবং এ দ্বারা গরিবদের জীবন-যাপনে কিছুটা হলেও গতি ফিরে আসে। এ জন্য ইসলামে সাদকাতুল ফিতরের গুরুত্ব অপরিসীম। এ ফিতরা দানের মাধ্যমে সমাজে বসবাসকারী জনসাধারণের মধ্যে সমতা ফিরে আসে এবং সহযোগিতার মানসিকতার বিস্তার ঘটে। একে অন্যের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক সাধিত হয় এবং এই সামাজিক সম্পর্কের উন্নয়ন হয়।

বিশেষ পরামর্শ
ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশের বিভিন্ন ইসলামিক সংস্থা, ইমাম, খতিবসহ যারাই এ বিষয়টির সঙ্গে জড়িত আছেন, সবার উচিত এই বিষয়ে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা এবং সবাইকে আসল ব্যাপারটা বুঝিয়ে সামর্থ্য অনুযায়ী সদকাতুল ফিতর আদায় করার আগ্রহ সৃষ্টি করা। এ ব্যাপারে ইসলামিক ফাউন্ডেশনকেই বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

কারণ এটা একটি সরকারি ইসলামী প্রতিষ্ঠান এবং তাদের মতামতের প্রভাব অনেক বেশি। ফিতরা আদায় করা প্রত্যেক উপযুক্ত ব্যক্তির নিজস্ব দায়িত্ব। এটা গরিবের হক। এ হক নষ্ট করা কোনোভাবেই উচিত হবে না। তাই আমাদের সবার উচিত নিজের সঠিক সামর্থ্য অনুযায়ী বেশি মূল্যের পণ্য দ্বারা সাদকাতুল ফিতর আদায় করার মাধ্যমে নিজে লাভবান হওয়া এবং গরিবদের বেশি বেশি সহযোগিতা করা।

সদকাতুল ফিতর ও কিছু নতুন ভাবনা
ঈদুল ফিতরের সঙ্গে ফিতরার একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। কেননা ব্যক্তির ওপর ফিতরা ওয়াজিব হয় বলিষ্ঠ মতানুসারে ঈদের দিন সুবহে সাদিকের সময়।

আর তা আদায় করতে হয় ঈদের নামাজের আগে। অবশ্য কেউ যদি ঈদের দিনের আগে সদকায়ে ফিতর আদায় করে দেয়, তাহলে এতে শরিয়তের পক্ষ থেকে কোনো আপত্তি নেই।

সদকায়ে ফিতর গরিবদের ঈদের খুশিতে শরিক করার জন্য দেয়া হয় বলে সাধারণ্যে যে ধারণা প্রচলিত রয়েছে তা যথার্থ নয়; বরং হাদিসে সদকায়ে ফিতরকে প্রথমে কাফফারাতুন লিসসাওম অর্থাত্ রোজা অবস্থায় অবচেতনভাবে যে ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়ে যায়, যার কারণে রোজা ভঙ্গ না হলেও দুর্বল হয়ে যায়—তার কাফফারা বা ক্ষতিপূরণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

অতঃপর তুমআতুন লিল মাসাকিন বা গরিবদের আহার্যের ব্যবস্থা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর দ্বারা পরিষ্কার বোঝা যায়, সদকায়ে ফিতর আদায়ের প্রধান উদ্দেশ্য হলো রোজাদারের রোজা পূর্ণাঙ্গ করা, আর এতে করে গরিবের আহার্যের ব্যবস্থাও হয়ে যায়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন যেটি অধুনা আমাদের সামনে আসছে তা হলো সদকায়ে ফিতরের পরিমাণ নির্ধারণের শরয়ি মানদণ্ডটি কী? অর্থাত্ সদকায়ে ফিতর বাবদ প্রতিজন ব্যক্তিকে কোনো দ্রব্য কী পরিমাণ বা কত টাকা আদায় করতে হবে?

হাদিসের কিতাবাদি ঘাঁটাঘাঁটি করলে দেখা যায়, তামার বা খেজুর এবং শাঈর বা যব দ্বারা ১ সা বা আমাদের মাপে সাড়ে ৩ সের পরিমাণ আদায়ের কথা বহু হাদিসে বিবৃত হয়েছে। যে হাদিসগুলো বুখারি ও মুসলিম উভয় গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে অর্থাত্ হাদিসগুলো সহিহ মানে উের গেছে। অতএব এর দ্বারা দলিল গ্রহণ করা যায়। আবার কোনো কোনো হাদিসে যাবিব বা কিশমিশের কথা উল্লেখ আছে; আর কোনো কোনো হাদিসে আকিত বা পনিরের কথা উল্লেখ আছে। এ মর্মের হাদিসগুলোও বুখারি ও মুসলিম উদ্ধৃত করেছেন। অর্থাত্ প্রমাণ হিসেবে এগুলোও গ্রহণীয়। কিশমিশ বা পনির দ্বারা আদায় করলেও ১ সা বা সাড়ে ৩ সের পরিমাণ জনপ্রতি আদায় করতে হবে।

ইবনে হযম যাহেরি (রহ.) অবশ্য বলেছেন যে, শুধু খেজুর ও যবের দ্বারাই সদকায়ে ফিতর আদায় করতে হবে, অন্যগুলো দ্বারা নয়। তার যুক্তি হলো যেহেতু বহুসংখ্যক হাদিসে খেজুর ও যবের কথা উল্লেখ আছে, অতএব এ দুটোই ধর্তব্য হবে। কিন্তু সহিহ হাদিস দ্বারা কোনো বিষয় প্রমাণিত হলে সেক্ষেত্রে কতসংখ্যক হাদিস দ্বারা বিষয়টি প্রমাণিত হলো তা মোটেই বিবেচ্য হয় না। হ্যাঁ, দুটি হাদিসের মাঝে বৈপরীত্য থাকলে সেক্ষেত্রে সংখ্যাধিক্য রিওয়ায়েত দ্বারা প্রমাণিত বিষয়টি প্রাধান্য পায়। অথচ এখানে বৈপরীত্য নেই।

একশ্রেণীর হাদিস দ্বারা দুটি বিষয় প্রমাণিত হয়েছে, আর অন্য শ্রেণীর হাদিস দ্বারা অপর দুটি বিষয় প্রমাণিত হয়েছে। অতএব ইবনে হযমের (রহ.) বক্তব্য যে বস্তুনিষ্ঠ নয় তা সহজেই বোঝা যায়।
কিশমিশ দ্বারা সদকায়ে ফিতর আদায়ের ব্যাপারে মুতাআখখেরিনদের কারও কারও দ্বিমত থাকলেও ইমাম নববী (রহ.) তার মুসলিমের ব্যাখ্যাগ্রন্থ শরহে নববীতে বলিষ্ঠভাবে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। অনুরূপভাবে ইমাম আহমদের (রহ.) মতানুসারে আকিত বা পনির দ্বারা ফিতরা আদায় করা যাবে না। অবশ্য আল্লামা মাওয়ারদি ( রহ.) বলেছেন, গ্রামীণ মানুষ যারা পশু পালন করে জীবিকা নির্বাহ করে তাদের বেলায় পনির দ্বারা ফিতরা আদায় করা বৈধ হবে, নগরবাসীর জন্য নয়।

ইমাম নববী শরহে মুহাযযাবে এসব মতামতকে এই বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন যে, যেহেতু কিশমিশ ও পনির দ্বারা সদকায়ে ফিতর আদায়ের কথা সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত আছে, আর এর বিপরীত কোনো

বর্ণনা হাদিসে বিদ্যমান নেই, অতএব এগুলো দ্বারা সদকায়ে ফিতর আদায় করা যাবে না বলে যে মতামত ব্যক্ত করা হয়েছে তা আদৌ ঠিক নয়।

ইমাম মুসলিম (রহ.) এ চার বস্তুর বিবরণ সংবলিত হাদিসগুলো সংকলন করার পর হজরত মুআবিয়ার (রা.) গমের আধা সা দ্বারা ফিতরা আদায় সংক্রান্ত হাদিসগুলো উল্লেখ করেছেন।

হাদিসগুলো এরূপ যে, হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) যখন আমাদের মাঝে বিদ্যমান ছিলেন তখন আমরা বড়-ছোট, আজাদ কিংবা গোলাম সবার ক্ষেত্রেই খাদ্যদ্রব্যের এক সা কিংবা পনিরের এক সা অথবা যবের এক সা কিংবা খেজুরের এক সা বা কিশমিশের এক সা দিয়ে সদকায়ে ফিতর আদায় করতাম।

এভাবেই আমরা আদায় করে আসছিলাম। একবার হজরত মুআবিয়া (রা.) হজ কিংবা ওমরাহর উদ্দেশ্যে আগমন করলেন।

তিনি মিম্বরে বসে লোকদের সঙ্গে কথা বললেন, আমি দেখেছি যে, সিরিয়ার (উত্তম জাতের) দুই মুদ গম অর্থাত্ আধা সা (আমাদের হিসাবে পৌনে দুই সের প্রায়) এক সা খেজুরের মূল্যমান বহন করে। ফলে লোকেরা এই অভিমত গ্রহণ করে নিল। আবু সাঈদ (রা.) বলেন, তবে আমি যতদিন জীবিত থাকব ততদিন আগের নিয়মেই সদকায়ে ফিতর আদায় করে যাব।

ইমাম মুসলিম (রহ.) হয়তো মনে করেছেন যে, সাহাবির বক্তব্য প্রামাণিক ভিত্তি হয়ে থাকে বিধায় এই হাদিসটি উল্লেখ করলে অর্ধ সা গমের দ্বারা ফিতরা আদায় করার বিষয়টি প্রমাণিত হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ইমাম মুসলিমের (রহ.) এ ধরনের উপস্থাপনার কারণে পরবর্তীকালে এরূপ একটি ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে যে, অর্ধ সা গমের দ্বারা ফিতরা আদায়ের বিষয়টি সম্পূর্ণ হজরত মুআবিয়ার (রা.) ইজতিহাদ।

তাই অনেকেই অর্ধ সা গমের দ্বারা ফিতরা আদায় করার বিষয়টি শরয়ি মানদণ্ড হিসেবে মেনে নিতে চাননি। তারা বরং এভাবে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন যে, খাদ্যদ্রব্যের এক সা দ্বারা ফিতরা আদায়ের কথা যেহেতু হাদিসে ব্যক্ত হয়েছে তাই গম বা আটা দ্বারা আদায় করলেও এক সাই দিতে হবে। শাফেয়ি মাজহাবের কোনো কোনো ব্যক্তির এরূপ অভিমত রয়েছে।

বর্তমানে আমাদের দেশের কতিপয় ইসলামী গবেষক সে সুরেই কথা বলতে চাচ্ছেন, এ যেন কুয়ার ব্যাঙের পৃথিবী ভ্রমণের মতো বিষয়। তারা ধরেই নিয়েছেন যে, সদকায়ে ফিতরের মূল উদ্দেশ্য গরিবের উপকার করা। তাই তারা গরিবের উপকারের দোহাই দিয়ে গম বা আটা দ্বারা ফিতরা দিলেও এক সাই দিতে হবে এরূপ মতামত জাতির সামনে তুলে ধরতে চাচ্ছেন।

যুক্তি একটাই যে, গরিবের উপকার হবে। আমার প্রশ্ন হলো, গরিবের উপকারের দোহাই দিয়ে শরিয়তের স্বীকৃত একটি বিষয়কে কি অস্বীকার করা যাবে? মুসলিম শরীফ ছাড়াও হাদিসের বহু গ্রন্থ রয়েছে। সেসব গ্রন্থের বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত হাদিসে স্পষ্টতই উল্লেখ আছে যে, গমের অর্ধ সার দ্বারা সদকায়ে ফিতর আদায় করার বিষয়টি স্বয়ং রাসুল (সা.) নিজেই নির্ধারণ করেছেন।

নাসাঈ ও আবু দাউদ শরীফে একটি হাদিস হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন : রাসুল (সা.) এই সদকাই আমাদের ওপর বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন যে, খেজুর কিংবা যব দ্বারা আদায় করলে এক সা পরিমাণ দিতে হবে, আর গম দ্বারা আদায় করলে অর্ধ সা দিতে হবে।

মিশকাত শরীফে হাদিসটি দ্বিতীয় অধ্যায়ে সংকলন করা হয়েছে যার অর্থ হাদিসটি হাসান পর্যায়ের চেয়ে নিম্নমানের নয়। আর হাসান পর্যায়ের হাদিস সবার কাছেই প্রমাণযোগ্য। মিশকাত শরীফের তৃতীয় অধ্যায়ে আরও একটি হাদিস সংকলন করা হয়েছে। আমর ইবনে শুয়ায়েরের সূত্রে বর্ণিত হাদিসটির বক্তব্য হলো

এরূপ, নবী (সা.) মক্কার গলিতে গলিতে ঘোষক প্রেরণ করলেন যে, শোন! সদকায়ে ফিতর প্রত্যেক মুসলমানের (সাহেবে নেসাব) ওপরই ফরজ। পুরুষ হোক বা নারী, স্বাধীন হোক বা গোলাম, প্রাপ্তবয়স্ক হোক বা অপ্রাপ্তবয়স্ক—গম দ্বারা আদায় করলে দুই মুদ (অর্ধ সা) কিংবা তার সমপরিমাণ মূল্য আর অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য দ্বারা আদায় করলে এক সা। হাদিসটি ইমাম তিরমিজি সংকলন করেছেন।

সনদে ইতিরাব থাকলেও যেহেতু হাসান পর্যায়ের ওপর বর্ণিত হাদিসটি তার মুতাবে অর্থাত্—অর্ধ সার ক্ষেত্রে সমঅর্থ প্রদানকারী। অতএব এটিও প্রমাণযোগ্য।
আল্লামা জামালউদ্দিন যাইলায়ি (রহ.) অর্ধ সার বিবরণ সংবলিত প্রায় দশটি মরফু রিওয়ায়েত নাসবুর রায়াহ গ্রন্থে সংকলন করেছেন।

সুতরাং গমের অর্ধ সা দ্বারা ফিতরা আদায়ের বিষয়টি নবী (সা.) নিজেই নির্ধারণ করেছেন, তা বহু সূত্রে প্রমাণিত আছে। এটি হজরত মুআবিয়ার (রা.) ইজতিহাদ নয়। অতএব অর্ধ সা গম দ্বারা ফিতরা আদায় করা যাবে না বলে যদি কেউ মতামত ব্যক্ত করেন তাহলে তা কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য হবে না। আর হাদিসের জগত্ সম্পর্কে যাদের এত সীমিত জ্ঞান তাদের বোধহয় এ ধরনের নতুন ইজতিহাদের পথে পা বাড়ানো ঠিক হবে না।

আসলে হজরত মুআবিয়া (রা.) নতুন কোনো ইজতিহাদ করেননি; বরং রাসুলের (সা.) বলা কথাটাই নতুন করে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন মাত্র। রাসুল (সা.) গমের আধা সার কথা বললেও যেহেতু গম তাদের উত্পাদিত বস্তু ছিল না, বাইরে থেকে আমদানি করে আনতে হতো, তাই গম দ্বারা সাধারণত কেউ ফিতরা আদায় করত না। হজরত মুআবিয়া (রা.) যখন দেখলেন যে, গমের দুর্লভ্যতা কমে গেছে, এখন ইচ্ছা করলে গম দ্বারাই তারা ফিতরা দিতে পারে, যা তাদের প্রধান খাদ্য, তাই তিনি গমের কথাটা জনগণের দৃষ্টিতে নিয়ে এসেছেন মাত্র। আর গম দ্বারা দিলে কেন অর্ধ সা দিতে হবে তার যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে দিয়েছেন।

এরূপ না হলে সাহাবারা এটা অবশ্যই মেনে নিতেন না। অন্তত দু-চারজন প্রতিবাদ করতেন।
হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) ছাড়া বিষয়টির ব্যাপারে অন্য কেউ আপত্তি করেছেন বলে জানা যায় না। তাই ধরে নিতে হবে, আবু সাঈদ খুদরির কাছে রাসুলের (সা.) ওই বক্তব্যটুকু যে কোনো কারণেই হোক পৌঁছেনি। ফলে তিনি সে মত মেনে নেননি।

অন্যরা জানতেন বিধায় মেনে নিয়েছেন। সুতরাং মুআবিয়ার ওই বক্তব্যটুকু হুকমান মারফু বলে গণ্য হবে। আর যদি তার ইজতিহাদ ধরা হয় তবে এই মত সব সাহাবি মেনে নিয়েছেন বিধায় ইজমায়ে সাহাবা দ্বারা বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে। কথা থেকে যায় যে, হাদিসে উল্লিখিত ওই পাঁচটি দ্রব্য (অর্থাত্ গম অর্ধ সা, খেজুর, যব, কিশমিশ, পনির এক সা) দ্বারাই সদকায়ে ফিতর আদায় করতে হবে না, অন্য কোনো দ্রব্য দ্বারা আদায় করলেও চলবে। ইবনে হযম যাহেরি মনে করেন, কেবল খেজুর ও যব দ্বারাই আদায় করতে হবে।

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের (রহ.) সাধারণ মত এই যে, হাদিসে উল্লিখিত পাঁচটি দ্রব্য দ্বারাই আদায় করতে হবে। অন্য কোনো দ্রব্য দ্বারা আদায় করলে হবে না। মালেকি ও শাফেয়িদের অভিমত হলো, যে কোনো খাদ্যদ্রব্য দ্বারা আদায় করা যাবে। অবশ্য কোনো কোনো শাফেয়ি গবেষকের মত এরূপ যে, খাদ্যদ্রব্য যেগুলো সঞ্চয়যোগ্য সেগুলো দ্বারা আদায় করতে হবে।
ইমাম আবু হানিফা মনে করেন, এই পাঁচটি হলো সদকায়ে ফিতরের ক্ষেত্রে মানদণ্ড।

এর যে কোনো একটি দ্বারা যেমন আদায় করা যাবে, এর সমমূল্যের যে কোনো দ্রব্য দ্বারাও আদায় করা যাবে। এমনকি মুদ্রা দ্বারাও আদায় করা যাবে। অবশ্য আর তিন ইমামের অভিমত এই ছিল যে, মুদ্রা দ্বারা আদায় করা যাবে না, দ্রব্যের দ্বারাই আদায় করতে হবে। তবে তাদের অনুসারীরা পরবর্তীকালে ইমাম আবু হানিফার (রহ.) অভিমতকেই মেনে নিয়েছেন।

এখন সবার দৃষ্টিতেই সমপরিমাণ মুদ্রা দ্বারা ফিতরা আদায় করলে আদায় হয়ে যাবে। তবে হ্যাঁ, শরিয়তের নির্ধারিত মানদণ্ড ঠিক রেখে যদি গরিবের উপকার করা যায় তাতে কোনো বাধা নেই; বরং সেটি উত্তম কর্ম বলে বিবেচিত হবে।

তাই শুধু আধা সা গমের মূল্য পরিশোধ না করে এক সা খেজুরের মূল্যের সমপরিমাণ আদায় করতে বাধা নেই, যার বর্তমান বাজার দর প্রায় ১৪০০ টাকা হবে। কিংবা এক সা কিশমিশের মূল্যের সমপরিমাণও আদায় করা যায়, যার বাজার দর ৪২০ টাকা প্রায়। কিংবা ১ সা পনিরের মূল্যের সমপরিমাণও আদায় করা যায়, যার বাজার দর ৭০০ টাকা প্রায়।

সমাজের বিত্তশালীরা যদি খেজুরের মূল্যে সদকায়ে ফিতর আদায় করেন, মধ্যবিত্তরা যদি পনির ও কিশমিশের মূল্যে আদায় করেন আর নিম্নবিত্ত যাদের ওপর সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হয় তারা যদি যব বা গমের মূল্যে আদায় করেন তাহলে গরিব লাভবান হবে এবং সম্পদের পর্যায় ভেদে এ অভ্যাস সমাজের মানুষের মাঝে গড়ে ওঠা উচিত।

এজন্য আলেম-ওলামা ও মসজিদের ইমামরা মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন। তবে শরিয়ত স্বীকৃত কোনো বিষয়কে আইন করে রহিত করার অধিকার কারও নেই।
মাওলানা মিরাজ রহমান/আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ

Logo-orginal