, শনিবার, ৪ মে ২০২৪

Avatar n_carcellar1957

সাংবাদিকতায় যোগ্যতা এবং তোষামোদী

প্রকাশ: ২০১৫-১২-২৮ ০৯:৫৮:৩৬ || আপডেট: ২০১৫-১২-২৮ ০৯:৫৯:৩৫

Spread the love

শেখ জাহিদুজ্জামান11009852_741572905941324_438254097365038778_n হাতে কলম, গলায় ফিতা আর পকেটে একটা নোটবুক থাকলেই কি সাংবাদিক হওয়া যায় ? মনে হয় এখন আর এই তকমা পাওয়া কোনো বিষয়ই নয়! কিন্তু প্রশ্ন একটাই ? যারা গণমাধ্যম নিয়ে পড়ালেখা বা মিডিয়া নিয়ে কাজ করতে চান কিংবা যারা ভবিষ্যতে মিডিয়ার বড় বড় পদে আসীন হবেন তাদেরকে কি শিক্ষা দিচ্ছি আমরা?

দুর্ণীতি, রেষারেষি, অফিস পলিটিক্স, গ্রুপ নির্ণয়, তোষামোদী আর যিনি একটু কাজ জানেন তাকে কিভাবে দাবিযে রাখা যায় এটাই কি গণমাধ্যমের রীতিনীতি। অথচ যে শিক্ষার্থী আকাশ-কুসুম স্বপ্ন নিয়ে এসেছিলো। ভেবেছিলো জনমানুষের সেবা করবে কিন্তু এখন তাকে দুর্নীতিগ্রস্থ কিংবা বিকার গ্রস্থদের সেবায় ব্যস্ত থাকতে হয়। কারণ একটাই, রুটি রোজগারের পথটি যেন সহসা বন্ধ না হয়ে যায়। কিন্তু যেখানে হওয়া উচিত ছিলো, তেল বা তোষামোদি নয় কাজই হোক মূল পন্থা। আর যোগ্যতাই হোক সাফল্যের চাবিকাঠি। কিন্তু সেখানে দেখি আমরা ভিন্ন চিত্র।

তাই এখন প্রশ্ন থাকতেই পারে, যে শিক্ষার্থী তোষামোদী কিংবা ফাঁকিবাজি বুঝতো না সেই রঙিন স্বপ্ন নিয়ে আসা মানুষগুলো কিভাবে আজ দুর্ণীতি গ্রস্থ হয়ে পড়ছে। এর পেছনে কে দায়ী ? কেন আজ স্বপ্ন নিয়ে আসা মানুষগুলো পলিটিক্সে আসক্ত? সাংবাদিকতা একটি পেশা। তবে এটি অন্য পেশার চেয়ে আলাদা । এ পেশার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো মানব সেবা করা। পৃথিবীতে মানব সেবা করার যতগুলো পন্থা আছে তার মধ্যে লেখনীই সর্বোত্তম পন্থা।

লেখার মাধ্যমে যেভাবে মানুষের উপকার করা যায় অন্য কোনো ভাবে তা করা যায় না। নিতান্তই সত্য এক সময় ছিলো যখন সাংবাদকর্মীদের ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে সবাই শ্রদ্ধা করত। কিন্তু এখনো যে সংবাদকর্মীদের শ্রদ্ধা বা সম্মান করে না তা কিন্তু ঠিক নয়। সম্মান এবং শ্রদ্ধা সবই করে তবে সেটি মাত্র লোক দেখানো। সামনে শ্রদ্ধার ফুলঝুরি আর পেছনে বাবা-মা তুলে গালি দেওয়া এটা তো আর সম্মান হতে পারে না। মাঝে মাঝে ভাবতে ভাবেতে নিজেকে হারিয়ে ফেলি আর মনে হয় বড় ভুল করে ফেলেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকরা যখন সাংবাদিকতার বিভিন্ন দিক নির্দেশনামূলক লেকচার দিতেন, তখন মনে হতো আসলে না জানি কতো সম্মানের এ পেশাটি। কিন্তু আজ বড় কষ্ট হয়। কেন আজ মিডিয়া কর্মীদের দূরবস্থা? এই প্রশ্ন কি আমি গণমাধ্যম নেতাদের প্রতি রাখতে পারি না?

নিজ স্বচক্ষে দেখেছি একজন সৎ সংবাদকর্মীর জীবনযাপন। আবার এটাও দেখেছি একজন অসৎ সংবাদকর্মীর জীবনযাপন। পার্থক্য শুধু এক জায়গায়, একজন তেলবাজিতে পটু আর অন্যজন এটার ধারের কাছেও যান না। একজন দীর্ঘ ১৭ বছর গণমাধ্যমে কাজ করেও এখন মাত্র মাথা গোজার ঠাই খুঁজছেন আর অন্যজন তেলবাজি বা তোষামোদিতে পটু হওয়ায় আজ বিলাসীতায় জীবন যাপন করছেন। আসলে গণমাধ্যমে কি মেধাবী বা যোগ্য লোকের কোনো মূল্যায়ন নেই? নাকি যারা কাজ ফেলে তেলবাজিতে মত্ত মিডিয়া এখন তাদেরকেই যোগ্য বলে মনে করে।

এজন্য আমি, যিনি অসাধুপায় অবলম্বর করছেন তাকে দোষারোপ করব না। কেননা তার এই পথের জন্য তিনি দায়ী নন। কারণ যিনি যোগ্য নন কিংবা গণমাধ্যমে কাজ করার উপযোগি নন তাহলে তিনি কিভাবে সংবাদকর্মী হলেন। এর জন্য কে দায়ী? আপনি, আমি,গণমাধ্যম নাকি যে অফিস তাকে গণমাধ্যমের তকমা দিয়েছে সেই প্রতিষ্ঠান? প্রকৃতপক্ষে বিশুদ্ধ পানির যেমন গন্ধ, বর্ণ বা স্বাদ নেই, একজন বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকের অবস্থাটাও তেমন। সাংবাদিক ও সাংবাদিকতা একটি পেশা।

এটা কেউ বেছে নেয় পেশা হিসাবে। অনেকে আবার নেশা হিসাবে। তদুপরি কারো তোষামোদি করে, কাউকে আকাশসম প্রশংসায় তুলে কিংবা দোষারোপের তলানিতে আটলান্টিকের তলদেশে নিয়ে যাওয়াটা সাংবাদিকতার বৈশিষ্ট্য নয়।

মূল কথা হলো সাংবাদিকতার থিম হচ্ছে ভয়ভীতি, রাগ উপেক্ষা করে সত্যের অনুসন্ধান, প্রতিফলন ও বেহুঁশকে জাগ্রতকরণ। এ জায়গায় সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে সত্যে মিশ্রিত করার কোনো সুযোগ নেই। তাই সাংবাদিকতা তোষামোদ নয়, সত্যের অনুসন্ধান, প্রতিফলন ও বেহুঁশদের জাগ্রতকরণ।

যা হোক, মানুষের ভুল হয় বলে সাংবাদিকের ভুল হতে পারে। মানুষ অপরাধ করলে সাংবাদিকও করতে পারে। যেমন করতে পারেন একজন বিচারক, পুলিশ, চিকিৎসক। ভুলের ক্ষমা আছে, অপরাধের শাস্তি আছে।

কিন্তু অপরাধপ্রবণ যাদের মন-মস্তিস্ক তাদেরকে পেশাদার চোর-ডাকাতের সঙ্গে তুলনা করতে আমার দ্বিধা নেই। বলা বাহুল্য, সাংবাদিকদের কাছে মানুষ যেমন সর্বোচ্চ মানবিকতা আশা করে, তেমনি সর্বোচ্চ সততাও আশা করে। এ ক্ষেত্রে কিছু কমবেশি অস্বাভাবিক নয়। এমতাবস্থায় মেধা বা যোগ্যতার মূল্যায়ন না হলে মেধাবী বা যোগ্যতা সম্পর্ণ ব্যক্তিরা কেন মিডিয়াতে আসবেন সেটা কি ভাবার বিষয় নয়?

গণমাধ্যম জগতে অনেকেরই জানা ,ওয়াটারগেট কেলেংকারিরর খবর প্রকাশ করে ওয়াশিংটন পোস্টের দুই সাংবাদিক বব উডওয়ার্ড ও কার্ল বার্নস্টেইন বিশ্বখ্যাত ও জনপ্রিয় হয়েছিলেন। যে সময় তারা মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের ওই কেলেংকারির খবরের পেছনে অনুসন্ধান শুরু করেছিলেন, তখন তারা ছিলেন সদ্য বিশ পেরোনো দুই যুবক।

১৯৭২ সালের ১৮ জুন ওয়াশিংটন পোস্টের প্রথম পাতার নিচের দিকে “Five Held in Plot to Bug Democratic Offices Here” শিরোনামে ছোট্ট যে খবরটি প্রথম প্রকাশ পেয়েছিল, দুই বছরের ধারাবাহিক অনুসন্ধান শেষে সেই খবর মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের পদত্যাগের মধ্য দিয়ে একটা অধ্যায় শেষ করেছিল। এই দুই যুবকের কাজ আজো যে কোনো পেশাদার সাংবাদিকের জন্য ঈর্ষনীয় সাফল্যের নজির হিসাবে বিবেচিত হয়।

সবশেষে একটি কথার মাধ্যমেই শেষ করতে চাই আর সেটি হচ্ছে, যোগ্য এবং মেধাবীদের কাজের মূল্যায়ন না করলে, ভবিষ্যতে গণমাধ্যম যে বেহাল দশায় পরিণত হবে না সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।

Logo-orginal