, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

admin admin

মাওলানা নিজামীর ফাঁসি ও জামায়াতের ভবিষ্যৎড. মোঃ নূরুল আমিন

প্রকাশ: ২০১৬-০৫-১৭ ১৮:৪৩:৪৮ || আপডেট: ২০১৬-০৫-১৭ ১৮:৪৩:৪৮

Spread the love

ড. মোঃ নূরুল আমিন
ড. মোঃ নূরুল আমিন

 

আরটিএমনিউজ২৪ডটকম, ঢাকাঃ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী আমাদের মধ্যে আর নেই (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের তথাকথিত অভিযোগে তাকে প্রাণদণ্ড প্রদানের পর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ তার আপিল আবেদন নাকচ করে তার প্রাণদণ্ড বহাল রাখেন এবং এর বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদনও খারিজ হবার এক সপ্তাহের মধ্যেই সরকার তার ফাঁসির দণ্ড কার্যকর করেন।

 

 

দেশের অন্যতম বৃহৎ একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং বিশ্ববরেণ্য একজন আলেমকে ফাঁসিতে হত্যার ঘটনা শুধু এই উপমহাদেশ নয়, আধুনিক বিশ্বে একটি বিরল ঘটনা। স্বাধীনতা প্রাপ্তির ৩৮ বছরের মধ্যে তার বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধকালে হত্যা, ধর্ষণ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে সম্পৃক্ত থাকার কোনও অভিযোগ ছিল না। হঠাৎ করে ২০১০ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ১৯৭৩ সালে ১৯৫ জন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীর বিচারের জন্য প্রণীত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন পুনরুজ্জীবিত করেন। বলা বাহুল্য ১৯৭৪ সালে ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তান যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং অপরাধীদের ছেড়ে দেয়। ঐ আইনে যুদ্ধের সাথে সংশ্লিষ্ট নয় এ ধরনের সিভিলিয়ান অথবা পলিটিশিয়ানদের বিচারের  বিধান ছিল না। আওয়ামী লীগ সরকার উক্ত আইনটি সংশোধন করে সশস্ত্র বাহিনী-আধা সশস্ত্র বাহিনী ও তাদের সহযোগী বাহিনীর সাথে বেসামরিক ব্যক্তি ও ব্যক্তিবর্গকে যুদ্ধাপরাধীর সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করে যা আন্তর্জাতিক আইনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। তাদের মৌলিক অধিকারও হরণ করে নেয়া হয় এবং বিচার প্রক্রিয়ায় প্রচলিত ফৌজদারী দণ্ডবিধি ও সাক্ষ্য আইন অকার্যকর করে জনশ্রুতিনির্ভর সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে তাদের বিচারের বিধান করা হয়।

 

জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক বার এসোসিয়েশন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ সারা দুনিয়া থেকে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উঠে কিন্তু সরকার তার সিদ্ধান্তে অটল থাকে এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য এই আইনটি ব্যবহৃত হয়। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে অনেকের মতে এখানে অভিযোগকারী ছিলেন সরকার, সাক্ষী সরকার এবং বিচারকও ছিলেন সরকারের অনুগত। স্কাইপি কেলেঙ্কারি এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। এসব বিচারে সাক্ষীর অনুপস্থিতিতে পুলিশ কর্তৃক তৈরিকৃত বানোয়াট লিখিত বিবৃতিকেও সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করার নজির স্থাপিত হয়েছে। সরকারের পক্ষে সাক্ষ্য দিতে অস্বীকার এবং আসামীর পক্ষে বক্তব্য দিতে আসায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে খোদ কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে হাইজ্যাক করে প্রতিবেশী দেশের সীমান্ত পার করে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে এবং তাকে সে দেশের কারাগারে পাওয়া গেছে। বিষয়টি আদালতের নোটিশে নেয়ার পরও কোনও প্রতিকার হয়নি। বিচারের নামে এ ধরনের প্রহসনের নজির বিশ্বে বিরল।

 
মাওলানা নিজামী মানুষের কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাননি। তিনি ঈমানের সাথে কালেমা উচ্চারণ করতে করতে ফাঁসির মঞ্চে উঠে জীবনের জয়গান গেয়েছেন। আল্লাহর সান্নিধ্যে গিয়ে শহীদের মর্যাদা লাভ করেছেন। আল্লাহ তার শাহাদাত কবুল করুন। তিনি ছিলেন ইসলামী আন্দোলনের সিপাহসালার। অন্যায়ের সামনে মাথানত না করে নিজেকে আল্লাহর হাতে সোপর্দ করে দিয়ে ইসলামী আন্দোলনের প্রতিটি নেতাকর্মীর জন্য তিনি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তার এই দৃষ্টান্ত এ দেশে লাখ লাখ নিজামী তৈরি করবে যারা অনাগত ভবিষ্যতে রোল মডেল হিসেবে কাজ করবেন। যারা মনে করেন জামায়াত অথবা তার নেতৃবৃন্দকে ধ্বংস করে আজীবন ক্ষমতায় থাকতে পারবেন তারা ভুল করছেন। তাদের বিরুদ্ধে জনরোষ বৃদ্ধির যে ভয়ঙ্কর সঙ্কেত পাওয়া যাচ্ছে তাতে শঙ্কিত হবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। স্বল্পসংখ্যক স্বার্থান্বেষী ভাড়ের নর্তন-কুর্দন তাদের মোহাবিষ্ট করে তুলেছে বলে মনে হয়। এই মোহ থেকে তারা জামায়াতকে বেআইনি ঘোষণা করার পথে অগ্রসর হচ্ছে বলে জানা যায়। এই কাজটি তাদের জন্য শুভ নাও হতে পারে। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সমুদ্রের পাড়ে সিংহাসনে বসে কেউ যদি সমুদ্রের প্রবহমান তীব্র গতির জলোচ্ছ্বাস ও ঢেউ-এর আগমনকে পানির বিনম্র পদধূলি নেয়ার পূর্বাভাস বলে মনে করে আনন্দে আটখানা হন তাহলে  সম্ভবত তিনি বুদ্ধিমানের নয় বোকার স্বর্গে বসবাস করবেন।

 
নশ্বর মানুষ হিসেবে গোলাম আযম-নিজামীকে হত্যা করা বা ফাঁসি দেয়া কঠিন কাজ নয়। তারা আল্লাহর কুরআনের প্রোডাক্ট। এই কুরআনকে ধ্বংস করা যাবে না। অতীতে অনেকে চেষ্টা করেছেন কিন্তু পারেননি, নিজেরা ধ্বংস হয়েছেন। জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা ধৈর্যের সাথে পরিস্থিতির মোকাবিলা করছেন, হিংসার বদলে হিংসা নয়, হত্যার বদলে হত্যা নয়, সন্ত্রাসের বদলে সন্ত্রাস নয়, সুকৃতি দিয়ে দুষ্কৃতির মোকাবিলা করছেন। এটা প্রশংসনীয়। সারা দুনিয়া মাওলানা নিজামীর ফাঁসির খবরে স্তম্ভিত ও ক্ষুব্ধ। সরকারের অবিলম্বে এই জুলুম বন্ধ করা উচিত এবং মানুষের অধিকার ফিরিয়ে দিয়ে এখনো তাদের পক্ষে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির পরিবেশ ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলে অনেকে মনে করেন।

 
শোনা যাচ্ছে এবং সরকারের মন্ত্রীরাই বলছেন, জামায়াতকে অচিরেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হবে। নিষিদ্ধ ঘোষণা করাটা অস্বাভাবিক নয়। আসল কথা হচ্ছে, যারা গণতন্ত্র শিষ্টাচার, নীতি ও নিয়মনিষ্ঠা, আদর্শ এবং সততার শত্রু তাদের কাছে জামায়াত চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছে। তারা মনে করেন যে জামায়াতের তৎপরতা ও রাজনীতি তাদের ও তাদের দলের জন্য মৃত্যু পরোয়ানাস্বরূপ। খ্যাতনামা সমাজ সেবক ও মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ বাংলাদেশের নষ্ট রাজনীতিতে ১০টি কারণে জামায়াতকে বেমানান ও অনাকাক্সিক্ষত বলে মন্তব্য করেছেন। এই কারণগুলো হচ্ছে:
১. জামায়াত একমাত্র বড় দল যার নেতার ছেলে, মেয়ে বা স্ত্রী পরবর্তীতে গদ্দীনশীন হননি যা গণতন্ত্রের চেতনার সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।
২. জামায়াত নেতারা মন্ত্রিত্ব পেয়েও ঘুষ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও দলপ্রীতিতে জড়িয়ে পড়েননি। দেশের সর্বোচ্চ পদে থেকেও ব্যক্তিগত সম্পদ বৃদ্ধি করতে পারেননি যা বিবেকহীন জনগণকে হতাশ করেছে।
৩. জামায়াতের (আসলে জামায়াত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের) প্রত্যেকটি বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান সততা ও দক্ষতার কারণে লাভজনক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। দলীয় কোনও প্রতিষ্ঠানের এহেন মুনাফা দলীয় দুর্নীতির চেতনার সাথে খাপ খায় না।
৪. বিগত কয়েক বছরে প্রথম সারির তথা শীর্ষ নেতাদের সকলেই জেলে থাকার পরও আন্দোলনে কর্মীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ চিন্তার বিষয়।
৫. সরকারি দালাল টিভি চ্যানেল ও প্রিন্ট মিডিয়াসমূহে জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডবের কথা ফলাও করে প্রচার সত্ত্বেও এ পর্যন্ত লাঠি আর ঢিল ছাড়া তাদের হাতে কোনও আগ্নেয়াস্ত্র দেখতে না পাওয়ায় তাদের তাণ্ডবের প্রচার মলিন হয়েছে। আগ্নেয়াস্ত্রের প্রতি তাদের অনীহা ক্ষমতাসীনসহ দেশের বিদ্যমান অনেক রাজনৈতিক দলের সাথে তাদের বৈষম্যের সৃষ্টি করেছে।
৬. জামায়াতো ছাত্রসংগঠন শিবির চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ইভটিজিং, জ্বেনা ব্যভিচার, শিক্ষক পেটানো, ভর্তি বাণিজ্য, সিট বাণিজ্য, দখলদারি প্রভৃতিসহ দুর্নীতি ও অনৈতিক কাজের সাথে জড়িত নেই, বরং তারা সবাই নামায ও কুরআন-হাদিস পড়ে ও অন্যদের পড়ার তাগিদ দেয়। উন্নত নৈতিক মান অর্জন করতে না পারলে এই বয়সে এটা সম্ভবপর নয়। আমাদের দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সাথে এটা সংগতিশীল নয়।
৭. জামায়াত একমাত্র দল যার নেতাকর্মীরা তাদের মাসিক আয়ের সাধারণত ১-৫% এবং ক্ষেত্র বিশেষে তারও বেশি দলীয় তহবিলে দান করেন। প্রচলিত অর্থে রাজনীতি করার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে পকেট ভরা। টাকা খরচ করে রাজনীতি করার এই কালচার রাজনীতির চিরাচরিত উদ্দেশ্যকে চ্যালেঞ্জের মুখে ছুঁড়ে দিয়েছে।

 
৮. ইলেকশনে নমিনেশন পাবার উদ্দেশ্যে অন্য দল থেকে কেউ জামায়াতে যোগ দিয়ে ফুলের মালা পায় না। বরং সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায়, স্বাভাবিক পন্থায় কর্মী থেকে তাদের নেতা পর্যায়ে উন্নীত হতে হয়।
৯. জামায়াত-শিবির পয়সা ভাগাভাগি বা অন্য কোনও বৈষয়িক কারণে দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে মারামারিতে লিপ্ত হয়েছে এবং পরস্পর পরস্পরকে খুন-জখম করেছে অথবা একে অন্যের বউ নিয়ে টানাটানি করেছে এমন কথা কখনো শোনা যায়নি। অথচ অন্য একটি বড় দলের সাধারণ সম্পাদক তার ছাত্রসংগঠনের জেলা পর্যায়ের এক নেতার বউকে অবৈধভাবে বাগিয়ে নিয়ে ঘর সংসার করার নজিরও আমাদের রাজনীতিতে আছে। জামায়াতে নমিনেশন নিয়ে মারামারি তো হয়ই না বরং কেউ নেতা নির্বাচিত হলে তাকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়তেও দেখা গেছে।
১০. জামায়াত এবং শিবির আদর্শিক রাজনীতির কথা বলে। বাংলাদেশের নাস্তিক সেক্যুলারিস্টরা মনে করেন ইসলাম শুধু হুজরা আর মসজিদে সীমাবদ্ধ থাকবে। রাজপথসহ অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য ও দেশের সর্বত্র চলবে মানুষের হুকুম। আল্লাহর সার্বভৌমত্বের কথা বলা যাবে না। সংবিধান অনুযায়ী জনগণই হচ্ছে সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক। অবশ্য সরকার, সরকারি দল ও তার অংগ সংগঠনের নেতাকর্মী কিংবা সরকারি কোনও বাহিনী সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক জনগণকে পেটালে, গুলী করে হত্যা করলে, গুম নির্যাতনের শিকার বানালে অথবা নিরপরাধ মানুষের ওপর জুলুম করলে তাদের সার্বভৌমত্বের মর্যাদা নষ্ট হবে না। এই ধারণায় যারা বিশ্বাস করেন তারা দুর্নীতিবাজ ও প্রতারক রাজনীতিক বলে পরিচিত এবং তারা বাংলাদেশের জন্য রাজনীতি এবং আদর্শ এই দু’টি শব্দকে বিপরীতার্থক শব্দে পরিণত করেছেন বলে অনেকের ধারণা। এই প্রেক্ষাপটে জামায়াতের আদর্শিক রাজনীতি বাংলাদেশে বড্ড বেমানান হয়ে পড়েছে।

 
উপরোক্ত অবস্থায়ও আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে জামায়াত নির্মোহ একটি বস্তু নয় ভালো মানুষদেরই একটি সংগঠন। আবার বাংলাদেশের সকল মানুষ যে খারাপ বা নীতি ও আদর্শভ্রষ্ট তাও নয়। এই অবস্থায় জামায়াতের ওপর যে কোনও আঘাত জামায়াতকে ধ্বংস করে দিবে তা বিশ্বাস করার কারণ নেই। অন্যায় ও অবিচার ন্যায় ও ইনসাফকে কখনো গ্রাস করতে পারে না। আবার গতিশীল একটি সংগঠনকে স্তব্ধ করে দেয়াও সম্ভব নয়। এটা হচ্ছে প্রবহমান নদীর মতো। বাঁধ দিয়ে তার স্রোত আটকে রাখার চেষ্টা করলে সে তার গতিপথ বের করে নেয়। জামায়াতও তার পথ অবশ্যই বের করে নেবে; কেননা এটা জনগণেরই সংগঠন।

সুত্রঃ সংগ্রাম

 

Logo-orginal