, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪

admin admin

জঙ্গি হামলার মাস্টারমাইন্ড সেই জিয়া নজরদারিতে

প্রকাশ: ২০১৬-০৭-১৩ ১৬:৫৬:৪৩ || আপডেট: ২০১৬-০৭-১৩ ১৬:৫৭:২৭

Spread the love

আরটিএমনিউজ২৪ডটকম, ঢাকাঃ জঙ্গি হামলার ব্লুপ্রিন্ট এখন গোয়েন্দাদের হাতে। গুলশান ও শোলাকিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে হামলার মাস্টারমাইন্ড বরখাস্ত এক সেনা কর্মকর্তাকেও গোয়েন্দা জালে আনা হয়েছে। হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্র আমদানির রুট ও সম্ভাব্য মজুদ সম্পর্কেও নিশ্চিত হয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। গুলশান হামলায় ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্রের সঙ্গে কমলাপুর ও চট্টগ্রাম থেকে উদ্ধারকৃত অস্ত্রের মিল রয়েছে। একই চক্র এসব কাজ করছে বলে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয়েছেন। তারা আশা করছেন কয়েক দিনের মধ্যেই গুলশানসহ বড় বড় কয়েকটি হামলা ও অস্ত্র উদ্ধার সংক্রান্ত তথ্য জানা যাবে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

গত ডিসেম্বরে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য আসে জঙ্গিদের হাতে দু’ডজনের বেশি ভয়ানক আগ্নেয়াস্ত্র আছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে জঙ্গি হামলার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা যুগান্তরকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন। তারা বলেন, ওই অস্ত্রের মধ্যে তিনটি উদ্ধার হয়েছে। এর একটি চট্টগ্রামের জঙ্গি আস্তানা থেকে এবং অপর দুটি ঢাকার কমলাপুর স্টেশন থেকে উদ্ধার করা হয়। একই চালানের অপর তিনটি অস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে জঙ্গি হামলায়, যা আলামত হিসেবে জব্দ করা হয়েছে। কমপক্ষে আরও ১৮টি অস্ত্র এখনও জঙ্গিদের হাতে আছে, যা দিয়ে আগামীতে বড় ধরনের হামলা চালানো হতে পারে বলে আশংকাও করছেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা।

সূত্র জানায়, জঙ্গি হামলার নীলনকশা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নকারীকে (মাস্টারমাইন্ড) অনেক দিন ধরেই খুঁজছিল আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা। গত কয়েক মাস আগে তারা নিশ্চিত হন সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্তকৃত মেজর সৈয়দ মো. জিয়াউল হকই এসবের মাস্টারমাইন্ড। এরপর থেকেই তাকে গ্রেফতারে অভিযান শুরু হয়। বিশেষ করে বড় ধরনের হামলা বা হত্যাকাণ্ডের পরই এ ধরনের অভিযান জোরদার হয়। সে অনুযায়ী গুলশান হামলার পর গত ৯ জুলাই সন্ধ্যা রাতে রাজধানীর নিকেতন এলাকায় সাঁড়াশি অভিযান চালায় পুলিশ। ওই অভিযানে কিছু সন্দেহভাজনকে আটক করা হয়। তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে মেজর জিয়াকে গোয়েন্দা জালে আনা সম্ভব হয়। তারা জঙ্গিদের হামলার পরিকল্পনা, অস্ত্র ও অর্থের উৎসসহ অনেক নতুন নতুন তথ্য দিয়েছে। এসব তথ্য বাস্তব অবস্থার সঙ্গে মেলানোর পর থেকেই মূলত জট খুলতে শুরু করেছে অনেক ঘটনার। উত্তরার দিয়াবাড়ী বৌদ্ধমন্দির খাল থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার, কলাবাগানের জোড়া খুন, ব্লগার ও প্রকাশক হত্যার ঘটনা খোলাসা হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের (সিটি) এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, গত ডিসেম্বরের বড় চালানের পর জঙ্গিরা কিছু অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় ছোট অস্ত্র সংগ্রহ করেছে। ওই অস্ত্র সংগ্রহের নেপথ্যে অর্থদাতাদের সম্পর্কেও তারা তথ্য পেয়েছেন। সে অনুযায়ী কয়েকজনকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। ২৫ এপ্রিল রাজধানীর কলাবাগানে ইউএসএইডের কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু মাহবুব রাব্বী তনয় হত্যাকাণ্ড শেষে পালানোর সময় এক জঙ্গির ব্যাগ কেড়ে নিতে সক্ষম হয় পুলিশ। ওই ব্যাগে আমেরিকার তৈরি একটি অত্যাধুনিক অস্ত্র ছিল, যা গুলশান হামলায় ব্যবহৃত ছোট অস্ত্রগুলোর সঙ্গে একই চালানে এসেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
১ জুলাই হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁ থেকে তিনটি অত্যাধুনিক একে-২২ মেশিনগান ও ৭টি ম্যাগাজিন উদ্ধার করা হয়। মেশিনগানগুলোর মধ্যে আমেরিকার তৈরি একটি একে-২২ মেশিন গান যার বডি নং ২৭৩৫১৪, সোভিয়েত ইউনিয়নের (রাশিয়া) তৈরি একটি একে-২২ মেশিনগান যার বডি নং ২২৩৫৪ এবং চীনের তৈরি আরও একটি একে-২২ মেশিনগান যার বডি নম্বর ১০২৫৭৩।
গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের মতে, জঙ্গিদের কাছ থেকে উদ্ধারকৃত  অত্যাধুনিক অস্ত্রগুলো সাধারণত পুলিশ ব্যবহার করে না। যুদ্ধক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীনসহ বিভিন্ন দেশের সৈনিকরা এ ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করে থাকেন। অত্যাধুনিক বিদেশী অস্ত্র কিভাবে কোন চ্যানেলে জঙ্গিদের হাতে পৌঁছেছে তার কিছু তথ্যও পেয়েছেন গোয়েন্দারা। পাওয়া গেছে এসব অবৈধ অস্ত্র আমদানির কিছু রুটের তথ্যও। এখন ওই সব রুটের শেকড় সন্ধান করছেন তারা। ওই চালানের পর আরও কি পরিমাণ অস্ত্র জঙ্গিদের হাতে এসেছে সে সম্পর্কেও কিছু বিক্ষিপ্ত তথ্য পাওয়া গেছে। যা বিভিন্ন ঘটনায় গ্রেফতারকৃত  জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা সম্ভব হয়েছে।
এসব অস্ত্রের উৎস সম্পর্কে জানতে চাইলে তদন্তসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বরেন, গত বছরের ডিসেম্বরে চট্টগ্রামের একটি জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালিয়ে একটি এমকে-১১ উদ্ধার করা হয়। ওই সময় জিজ্ঞাসাবাদে জামা’আতুল মুজাহেদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) সদস্যদের কাছে দু’ডজন ভয়ানক অস্ত্র থাকার তথ্য পাওয়া যায়। কারা এসব অস্ত্রের আমদানিকারক, এসবের মাস্টার মাইন্ড কে জানতে চাইলে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, সেনাবাহিনীতে  অভ্যুথান ঘটানোর চেষ্টার দায়ে বরখাস্ত হওয়া মেজর সৈয়দ মো. জিয়াউল হক। তিনি দীর্ঘদিন ধরে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) সামরিক শাখার প্রধান হিসেবে কাজ করছেন। তিনি দেশেই অবস্থান করে গোপন আস্তানা থেকে জঙ্গি অভিযান পরিচালনা করছিলেন। জঙ্গিরা যেহেতু ‘কাটআউট’ পদ্ধতিতে কাজ করে তাই তাদের পক্ষে উপরের ব্যক্তি সম্পর্কে জানা সম্ভব হয় না। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাউন্টার সার্ভিল্যান্সের বিস্তারিত কৌশল মেজর জিয়ার জানা থাকায় তিনি বরাবরই নিজেকে আত্মগোপনে রাখতে সক্ষম হন।
ফেব্রুয়ারিতে বাড্ডার সাঁতারকুলে একটি জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালায় ডিবি। ওই সময় সেই আস্তানায় জিয়াও অবস্থান করছিলেন। অভিযানের বিষয়টি আগেই টের পেয়ে তিনি কৌশলে পালিয়ে যান। অভিযানকালে একজন ডিবি সদস্য গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। ওই ঘটনার পর জিয়াকে পাকড়াও করতে নানামুখী ফাঁদ পাতেন গোয়েন্দারা। কিন্তু কিছুতেই তাকে গোয়েন্দা জালে আনা সম্ভব হয়নি। অবশেষে এবার গোয়েন্দারা তাকে জালে আনতে সফল হয়েছেন।
তদন্ত সূত্র জানায়, একে-২২ মেশিনগান ছাড়াও হলি আর্টিজান থেকে আরও বেশ কিছু অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। যার মধ্যে ছিল ২টি নাইন এমএম পিস্তল, যার গায়ে বিহার ও নলের শেষভাগে এফ-৬৫ লেখা, ২টি নাইন এমএম পিস্তল যার গায়ে মেড ইন জাপান লেখা, একটি নাইন এমএম পিস্তলের গায়ে একপাশে জাপান, ইতালি ও অপর পাশে চীন লেখা। ৬টি নাইন এমএম পিস্তলের ম্যাগাজিন যার দুটির পেছনে এফ-৬৫ লেখা, নাইন এমএম পিস্তলের ৬ রাউন্ড গুলি, ৭ পয়েন্ট ৬৫ বোরের ২৮ রাউন্ড তাজা গুলি, ৩৫ রাউন্ড একে-২২ মেশিনগানের তাজা গুলি, ২২ বোর (একে-২২ মেশিনগানের) তাজা গুলি ৪৪ রাউন্ড যার পেছনে ঊ লেখা, ১২ রাউন্ড ৬১ ইন্টু ৬ এর তাজা গুলি, ৯টি গ্রেনেডের সেফটি পিন, কাঠের বাঁটযুক্ত ১৮ ইঞ্চি লম্বা ছোরা, ৯ ইঞ্চি লম্বা চাকু, একটি ১৩ ইঞ্চি লম্বা চাপাতি, প্রায় দেড় ফুট লম্বা একটি ছোরা উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত এসব অস্ত্র মামলার আলামত হিসেবে প্রথমে গুলশান থানা পুলিশ ও পরে তদন্ত সংস্থা সিটি ইউনিটের কাছে হস্তান্তর করা হয়। সিটি ইউনিট মামলাগুলো ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানোর কথা।
সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবের বিশেষ পুলিশ সুপার নাসিমা বেগম যুগান্তরকে জানান, ‘গুলশান হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্রসহ অন্যান্য আলামত পরীক্ষার জন্য আদালত থেকে সিআইডিকে বলা হয়েছে। মঙ্গলবার পর্যন্ত আমরা এসব আলামত বুঝে পাইনি।’ সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট শাখা থেকে জানানো হয়- অস্ত্র, গোলাবারুদসহ জব্দ তালিকাভুক্ত ৮৬ ধরনের এবং এর বাইরে আরও নানা আলামত গুলশান থানা পুলিশকে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে।
এদিকে কমলাপুর রেলওয়ে থানার ওসি মোহাম্মদ আবদুল মজিদ মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, ২০১৪ সালের ২৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম থেকে আসা সুবর্ণ এক্সপ্রেস থেকে দুই জেএমবি সদস্যকে আটক করা হয়। তাদের কাছ থেকে দুটি একে-২২ মেশিনগান, বিপুল পরিমাণ গুলি, ডেটোনেটর, পাওয়ার জেল, বোমা তৈরির সরঞ্জাম ও ম্যাগাজিন উদ্ধার করা হয়। ওই অস্ত্রের গায়ে মেড ইন ইউএসএ লেখা ছিল। জিজ্ঞাসাবাদে  জানায়, তারা এক সময় ছাত্রশিবিরের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এদের মধ্যে নূরুল ইসলাম পঞ্চগড় জেলা ছাত্রশিবিরের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও শামীম ওরফে আবদুল্লাহ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা সদরের ছাত্রশিবিরের নেতা ছিল। পরে তারা শিবির ত্যাগ করে জেএমবিতে যোগ দেয়। একই মডেলের অস্ত্র গুলশান হামলায় ব্যবহার করেছে জঙ্গিরা। ধারণা করা হচ্ছে, হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলাও চালিয়েছে একই গ্রুপের সদস্যরা।
ওসি আবদুল মজিদ আরও বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে  দুই জঙ্গি জানিয়েছে এর আগেও ট্রেনে তারা কমপক্ষে ৭ বার একই ধরনের রাইফেলসহ বিভিন্ন অস্ত্র ঢাকায় নিয়ে এসেছে। প্রতিবারই তারা বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন নেমে রাজধানীর নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তির কাছে অস্ত্রের চালান পৌঁছে দিয়েছে। তিনটি চালান তারা সাভার এলাকাতেও পৌঁছে দিয়েছে বলে জানায়। কিন্তু সাভারে কাদের কাছে ওইসব অস্ত্র পৌঁছে দিয়েছে তা বলতে পারেনি শামীম ও নূরুল। ওসি আরও বলেন, জেএমবিতে যোগ দেয়ার পর নূরুল ইসলামের বাবা আবদুর রহমান তার ছেলেকে ত্যাজ্য করেন।
উৎসঃ যুগান্তর

Logo-orginal