admin
প্রকাশ: ২০১৬-০৮-১৬ ০৬:৩৪:৪১ || আপডেট: ২০১৬-০৮-১৬ ০৬:৩৪:৪১
মারজান
আরটিএমনিউজ২৪ডটকম, ঢাকাঃ গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার তিন অপারেশন কমান্ডারের অন্যতম মারজানের পরিচয় মিলেছে। ‘নয়া জেএমবি’র এই আঞ্চলিক কমান্ডারের পুরো নাম নুরুল ইসলাম মারজান, গ্রামের বাড়ি পাবনা সদর উপজেলার হেমায়েতপুর ইউনিয়নের আফুরিয়ায়। গতকাল সোমবার রাতে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারের উপকমিশনার (ডিসি) মাসুদুর রহমান এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
মারজান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের ছাত্র ছিলেন। গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, তিনি ‘নয়া জেএমবি’র সামরিক কমান্ডারের দায়িত্বও পালন করছেন।
জানা গেছে, গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার অন্য দুই অপারেশন কমান্ডার চাকরিচ্যুত মেজর জিয়া ও তামিম চৌধুরী গোয়েন্দাদের নজরের মধ্যেই আছেন। আবার এমন তথ্যও আছে, তাঁরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন। তবে এ ব্যাপারে সরাসরি কিছু বলতে রাজি হননি তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
পরিচয় পাওয়ার পর গতকাল সন্ধ্যায় গ্রামের বাড়ি থেকে মারজানের বাবা নিজাম উদ্দিনকে আটক করা হয়েছে বলে তাঁর স্বজনরা দাবি করেছে। তবে এ বিষয়ে পাবনার এসপি আলমগীর কবির বলেন, ‘বিভিন্ন সংস্থা আছে, কারা আসলে বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে, আমাদেরও জানা নেই।’
গুলশান ও শোলাকিয়া হামলার পর রাজধানীসহ সারা দেশে ব্লক রেইড দিয়ে জঙ্গিগোষ্ঠীর সদস্যদের গ্রেপ্তার অভিযান চলছে। অতি সম্প্রতি রাজধানীর কয়েকটি এলাকা থেকে নয়া জেএমবি ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের ১২ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা র্যাব ও ডিবির রিমান্ডে রয়েছে।
জিজ্ঞাসাবাদে তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গতকাল র্যাবের এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, ১২ জনের মধ্যে ১১ জনই নিষিদ্ধ সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) আত্মঘাতী স্কোয়াডের সদস্য। অন্যজন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) প্রযুক্তি শাখার পরিচালক। জিজ্ঞাসাবাদে তারা তিন মাস্টারমাইন্ড সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলার আর্থিক লেনদেন, পরিকল্পনা, অস্ত্রের জোগানদাতা এবং সাংগঠনিক অনেক তথ্য দিয়েছেন। সেসব তথ্য যাচাই করে দেখা হচ্ছে। তবে তিন মাস্টারমাইন্ড কোনো গোয়েন্দা সংস্থার হাতে আছে কি না সে ব্যাপারে তিনি কিছু বলেননি।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার এবং কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, জিয়া, তামিম ও মারজান এবং নয়া জেএমবির নতুন সদস্যদের বিষয়ে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। তিনি জানান, গ্রেপ্তার জেএমবি সদস্যদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সংগঠনটির সব পর্যায়ের নেতা ও কর্মীদের ওপর নজর রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। শিগগিরই আরো অনেক জঙ্গি সদস্যকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে। জঙ্গিবিরোধী অভিযান অব্যাহত আছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গুলশান হামলার ঘটনার তদন্তে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। পরিকল্পনাকারী, নির্দেশদাতা, অস্ত্রের জোগানদাতা ও প্রশিক্ষণদাতাদের সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় সারা দেশে র্যাবের অভিযান চলছে। সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়া নয়া জেএমবির আত্মঘাতী দলের ছয় সদস্য রিমান্ডে তাদের সহযোগী ও নেতাদের সম্পর্কে অনেক তথ্য দিচ্ছে। জঙ্গিদের অর্থ ও অস্ত্রের উৎস সম্পর্কেও তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
বেশ কয়েকজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, রিমান্ডে জঙ্গিরা বলেছে, গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার মাস্টারমাইন্ড সাবেক মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক (সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত), তামিম আহমেদ চৌধুরী ও মারজান ওরফে সাগর। তারা ঢাকায় থেকে সদস্যদের সংগঠিত করার কার্যক্রম চালাচ্ছেন। বিদেশি জঙ্গি সংগঠনগুলোর সঙ্গে তাদের যোগাযোগ রয়েছে। বিদেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে তাদের কাছে অর্থ আসে। দেশের উত্তরাঞ্চলের প্রতিটি জেলায় শীর্ষ পর্যায়ের একজন এবং মাঠ পর্যায়ে একেকজনের নেতৃত্বে ছোট ছোট গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। তারা মাস্টারমাইন্ডদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে মাঠপর্যায়ের কাজ করছেন।
ডিবির রিমান্ডে থাকা নয়া জেএমবির সদস্য আতিকুর রহমান ওরফে আইটি আতিক, আবদুল করিম বুলবুল ওরফে ডা. বুলবুল, আবুল কালাম আজাদ, মতিউর রহমান ও শাহিনূর রহমান হিমেল ওরফে তারেক গোয়েন্দাদের জানিয়েছেন, তারা আত্মঘাতী স্কোয়াডের সদস্য। তাদের সঙ্গে মারজান ও তামিম চৌধুরীর নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। তারা জানান, মারজান গুলশান হামলার অন্যতম সমন্বয়কারী। তার সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের জঙ্গিদের নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই মারজান জেএমবির সঙ্গে যুক্ত। সংগঠনের অনেকেই তাকে চট্টগ্রামের বাসিন্দা হিসেবে জানে। তবে তার গ্রামের বাড়ি পাবনার হেমায়েতপুরে। গুলশান হামলার ঘটনায় তামিমের সঙ্গে তিনিও সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করেছেন। হামলাকারীদের অস্ত্রের জোগান দিয়েছেন।
এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, ‘মারজান চট্টগ্রামে নয়া জেএমবির আঞ্চলিক কমান্ডার। গুলশান হামলার আগে তিনি ঢাকায় এসে তামিমসহ শীর্ষ জঙ্গি নেতাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন। ঢাকায় আরো হামলার উদ্দেশে উত্তরাঞ্চল ও চট্টগ্রাম থেকে অনেক জঙ্গি সদস্যকে ঢাকায় এনেছিলেন তিনি। তবে ওরা আর ঢাকা থেকে বের হতে পারেনি।
গুলশান হামলার ঘটনার ছায়া তদন্ত করছে র্যাব। র্যাবের গোয়েন্দা তথ্য মতে, জেএমবি এখন নানা দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে হামলা চালাচ্ছে। ‘দাওলাতুল ইসলাম’-এর ব্যানারে জেএমবি সদস্যরা গুলশান হামলায় অংশ নেয়। তবে নয়া জেএমবির সদস্যদের কেউ দাওলাতুল ইসলামের সদস্য নয়। কেউ কেউ আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, হিযবুত তাহ্রীর ও আরো কয়েকটি জঙ্গি সংগঠনের সদস্য।
জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব সূত্র জানিয়েছে, গুলশানে হামলা চালানোর আগে দেশে-বিদেশে অনেক পরিকল্পনা করেছে জঙ্গিরা। তাদের মধ্যে চোরাকারবারি চক্রের সদস্যরাও রয়েছে। বিশেষ করে সোনা চোরাচালানি চক্রের মাধ্যমে জঙ্গিদের হাতে বিদেশ থেকে হুন্ডি মারফত অর্থ আসছে।
গোয়েন্দারা জেনেছে, গুলশান হামলার জন্য কয়েক দফায় অর্থায়ন করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫০ লাখ টাকার একটি চালান হুন্ডির মাধ্যমে নয়া জেএমবির সদস্যদের হাতে আসে। গত বুধবার রাজধানীর শাহ আলী থানা এলাকা থেকে নয়া জেএমবির ছয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। তাদের মধ্যে প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান সিফাত ‘দাওলাতুল ইসলাম বাংলাদেশ’-এর ওয়েবপেজ আত-তামকীনের প্রধান অ্যাডমিন। তারা হলি আর্টিজানসহ ১১টি হামলার ঘটনার দায় স্বীকার করেছে।
র্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘দাওলাতুল ইসলাম বাংলাদেশ’-এর সদস্যরা প্রশিক্ষিত ও দক্ষ। এরা আগে হিযবুত তাহ্রীর, জেএমবি, হরকাতুল জিহাদ ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (আনসার আল ইসলাম) সদস্য ছিল।’ তিনি বলেন, ভুয়া পরিচয়ে তারা গ্রুপ গঠন করে। সদস্যদের কেউ অন্যের বিষয়ে প্রকৃত তথ্য জানে না। ফলে কেউ ধরা পড়লে তার কাছ থেকে অন্য সদস্যের ব্যাপারে যথাযথ তথ্য পাওয়া কঠিন।
র্যাবের গোয়েন্দা শাখার একটি সূত্র জানায়, দাওলাতুল ইসলাম বাংলাদেশের (ডিআইবি) মূল উদ্যোক্তা সাবেক জিয়া। তার সঙ্গে হিযবুত তাহ্রীরের অপারেশন কমান্ডার তামিম আহমেদ চৌধুরীর সম্পৃক্ততা রয়েছে। তারা গুলশান ও শোলাকিয়ায় হামলার মূল পরিকল্পনাকারী। শোলাকিয়ায় হামলার দিন তামিম ঘটনাস্থলের আশপাশে ছিলেন।
আট মাস ধরে নিখোঁজ মারজান : পাবনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম) সিদ্দিকুর রহমান গতকাল রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, গুলশান হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী মারজানের পরিচয় জানা গেছে। তিনি পাবনার একটি মাদ্রাসা থেকে পাস করে ২০১৪ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগে ভর্তি হন। পরিবারের লোকজন পুলিশকে জানিয়েছে, মারজান আট মাস আগে স্ত্রীসহ নিখোঁজ হন।
ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের বিশেষ অ্যাপ ‘হ্যালো সিটি’তে মারজানের ছবি প্রকাশ করা হয় গত শুক্রবার। সেখানে তাকে গুলশান হামলার ‘অপারেশন কমান্ডার’ উল্লেখ করা হয়েছে। তার বয়স ২২ বা ২৩ বছর।
গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য রয়েছে, মারজান এখন পর্যন্ত ঢাকাতেই আছেন। সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়া নয়া জেএমবির এক সদস্যের মোবাইল থেকে তার ছবি পাওয়া যায়। নয়া জেএমবির প্রচার বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন মারজান। গুলশান হামলার ছবি অ্যাপসের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার মূল দায়িত্ব ছিল তার। তামিমের পাশাপাশি মারজানও ঘটনার সময় জঙ্গিদের সঙ্গে অ্যাপসের মাধ্যমে কথা বলেছেন। নয়া জেএমবিতে তামিমের পরেই তার অবস্থান।