, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

admin admin

একবছরেই ভারতে ধর্ষিত হয়েছে কুড়ি হাজার শিশু বা কিশোরী

প্রকাশ: ২০১৮-০২-১১ ১৫:০৮:২৭ || আপডেট: ২০১৮-০২-১১ ১৫:০৮:২৭

Spread the love

একবছরেই ভারতে ধর্ষিত হয়েছে কুড়ি হাজার শিশু বা কিশোরী
ভারতের রাজধানী দিল্লিতে আট মাসের একটি কন্যাশিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছে সপ্তাহখানেক আগে। তার আগে কোথাও তিন বছর, কোথাও ১০ বা ১১ বছর বয়সী কন্যাশিশুদের ধর্ষণের খবর উঠে এসেছে সেদেশের সংবাদ শিরোনামে। সংবাদ বিবিসি বাংলার ।

আর শিরোনামে না আসা শিশু ধর্ষণের সংখ্যাটা আরও বহুগুণ বেশি।

২০১৬ সালে – একবছরেই ভারতে ধর্ষিত হয়েছে প্রায় কুড়ি হাজার শিশু বা কিশোরী। ভারতের জাতীয় অপরাধ রেকর্ড ব্যুরোর সাম্প্রতিকতম পরিসংখ্যানে তেমনটাই উঠে এসেছে।

তবে ধর্ষণ বা যৌন হেনস্থার শিকার যে সেখানে শুধু কন্যা শিশুরাই হচ্ছে তা নয়।

প্রায় ১০ বছর আগে প্রকাশিত একমাত্র পরিসংখ্যানে দেখা গেছে মোট যত শিশুর ওপরে যৌন হেনস্থা হয়, তার অর্ধেকেরও বেশি ছেলেশিশু বা কিশোর।

কিন্তু সমাজকর্মীরা বলছেন, ভারতে শিশুদের ওপরে যৌন নির্যাতনের প্রকাশিত পরিসংখ্যানটি মোট ঘটনার কিছু অংশমাত্র।

শিশুদের অধিকার নিয়ে সারা দেশ জুড়েই কাজ করে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘ক্রাই’।

তারই পূর্বাঞ্চলীয় ডিরেক্টর অতীন্দ্রনাথ দাস ব্যাখ্যা করছিলেন, “শিশুদের ওপরে যৌন নির্যাতনের ঘটনাগুলো ক্রমবর্ধমান হারে বেড়ে চলেছে গত প্রায় এক দশক ধরে। কিন্তু গত তিনবছরে সংখ্যাটা লাফিয়ে বেড়েছে। তার অর্থ এই নয় যে এরকম ঘটনা আগে হত না। কিন্তু হঠাৎ করে সংখ্যাটা বেড়ে যাওয়া নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক।”

সাম্প্রতিক সময়ে এমন বেশ কিছু শিশু ধর্ষণের ঘটনা সামনে এসেছে, যা রীতিমতো শিহরন জাগানো।

২০১৫ সালে দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্য কর্ণাটকে আট বছরের একটি কন্যা শিশুকে অপহরণ করার ছবি ধরা পড়ে সিসিটিভি-র ফুটেজে। পরে তার মৃতদেহ পাওয়া যায়, তার মুখে প্লাস্টিক গুঁজে দিয়ে চুপ করিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছিল।

ধর্ষণ ছাড়াও প্রায় ১২ হাজার কন্যা-শিশুর ওপরে যৌন নির্যাতন চলেছে, আর যৌন হেনস্থা ঘটেছে নয়শোরও বেশী কন্যা-শিশুর সঙ্গে।

কলকাতার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘দীক্ষা’র প্রধান পারমিতা ব্যানার্জী বলছিলেন, “যৌন নির্যাতনটা আগেও চলত, এখনও চলে। কোনও না কোনোভাবে যৌন হেনস্থা হয় নি, এমনভাবে বোধহয় ভারতের কোনও মেয়েই বড় হয় না – সেটা ভিড় বাসে শরীরে হাত দেওয়া থেকে শুরু করে আরও গুরুতর কিছু – যাই হোক না কেন। আগে আমরা মেয়েরা মুখ খুলতাম না – ভয়ে, লজ্জায়, কিন্তু এখন মুখ খুলতে শুরু করেছে একটু একটু করে।”

নারী আন্দোলনের কর্মী অধ্যাপক শাশ্বতী ঘোষও বলছিলেন, “অ্যাবসলিউট নাম্বারে যৌন নির্যাতন বেড়েছে তো বটেই, কিন্তু এখন বিষয়গুলো সামনে আসছে আগের থেকে অনেক বেশী। শিশু সুরক্ষা সম্বন্ধে অভিভাবক থেকে শুরু করে পুলিশ – সকলেরই সচেতনতা বেড়েছে। এখন কোনও শিশুর ওপরে যৌন নির্যাতন হলে প্রথমেই রিঅ্যাক্ট করে এই বলে যে ‘একটা বাচ্চার সঙ্গে এরকম করে পার পেয়ে যাবে!’ এই ধারণাটা বদল হয়েছে বলেই যৌন নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে মুখ খুলতে অনেকে সাহস পাচ্ছেন এখন।”

ভারতের রাজধানী দিল্লিতে আট মাসের একটি শিশুকে ধর্ষণের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। (ফাইল ছবি)
যৌন নির্যাতনের শিকার অর্ধেকই ছেলেশিশু

সমাজকর্মীরা বলছেন একটা বিরাট সংখ্যক পুত্র-শিশু বা কিশোররাও নিয়মিত যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে ভারতে – যার একমাত্র সরকারী পরিসংখ্যান পাওয়া গিয়েছিল ২০০৭ সালে। কথা বলেছিলাম স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন প্রাজকের প্রধান দীপ পুরকায়স্থর সঙ্গে।

“ছেলেদের ওপরে যৌন নির্যাতনের পরিসংখ্যান খুব একটা পাওয়া যায় না। একমাত্র ওই ২০০৭ সালের সংখ্যাটা ছাড়া। আমরা যারা এই বিষয়টা নিয়ে কাজ করি, তাদের একটা ধারণা ছিলই যে কী সংখ্যায় ছেলেদের ওপরে যৌন নির্যাতন চলে। আর সরকারী তথ্যে দেখা যাচ্ছে মোট যত শিশুর ওপরে যৌন নির্যাতন হয়, তার প্রায় অর্ধেক পুত্র-শিশু বা কিশোর। তার পরে আর কোনও তথ্য আমাদের হাতে নেই,” বলছিলেন মি. পুরকায়স্থ।

শিশু ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন বেড়ে যাওয়ার কারণ কী

শিশুদের ধর্ষণ বা তাদের ওপরে যৌন নির্যাতন বেড়ে যাওয়ার কারণ রয়েছে একাধিক।

কেউ বলছেন ইন্টারনেটে পর্ণোগ্রাফি সহজলভ্য হয়ে যাওয়া। কারও মতে বিকৃত যৌন চাহিদা মেটানোর সব থেকে সহজ টার্গেট হয়ে উঠছে শিশুরা, কারণ তারা অরক্ষিত আর তাদের ওপরে কী ঘটছে, সেটা তারা বুঝতে অক্ষম।

এইসব নানা কারণেই শিশু ধর্ষন বা শিশুদের ওপরে যৌন নির্যাতন ক্রমাগত বেড়ে চলেছে।

কলকাতায় যৌন হেনস্থার ব্যাপারে শিশুদের সচেতন করে তোলার কাজ করে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন দীক্ষা। তার প্রধান পারমিতা ব্যানার্জীর কথায়, “অনেকগুলো কারণ আছে। এর মধ্যে পিডোফিলিয়া নিশ্চিতভাবেই মানসিক বিকৃতি। কিন্তু বাসে-ট্রামে মেয়েদের শরীর ছোঁয়ার মতো যেসব ঘটনা ঘটে, সেগুলো কিন্তু ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য। এর বাইরে একটা কারণ হল ছোটবেলায় যেসব পুরুষ হেনস্থার শিকার হয়েছেন কোনও না কোনও ভাবে, তাদের একটা অংশও কিন্তু পরবর্তীতে নিজেরা হেনস্থা করছেন মেয়েদের।”

ক্রমবর্ধমান হারে শিশুদের যৌন লালসার শিকার বানানোর পিছনে রয়েছে কুসংস্কারও। অন্তত দেড়শো বছর আগের ছাপা বটতলার বই নামে পরিচিত তথাকথিত অশ্লীল সাহিত্যেও এই কুসংস্কারের উল্লেখ আছে যেখানে বলা হয়, কন্যা-শিশু অথবা কুমারী নারীদের সঙ্গে যৌন সংসর্গ করলে নানা যৌন রোগ নিরাময় হয়।

নিউ লাইট স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রধান উর্মী বসু বলেন,”আমরা যৌন কর্মী এবং তাঁদের সন্তানদের নিয়ে কাজ করি। আমাদের সঙ্গে যারা আছেন, তাঁদের অনেকেরই বয়স ৬০/ ৬৫ এমনকি ৭০। তাঁদের কাছ থেকেই জেনেছি, বহু মানুষ এটা মনে করেন যে কুমারী নারী বা শিশুদের সঙ্গে যৌন সংসর্গ করলে তাদের নিজেদের শরীরে বাসা বেঁধে থাকা যৌনরোগ নিরাময় হয়। ভারতের বহু প্রদেশে এই ধারণা প্রচলিত রয়েছে। ”

সমাজকর্মী পারমিতা ব্যানার্জীও এইডস আক্রান্তদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে একই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন।

শিশুদের ওপরে ক্ষমতা প্রদর্শন সহজ, তেমনই যৌন লালসা মেটানোর পরে ভয় দেখিয়ে তাদের মুখ বন্ধ করে রাখা আরও সহজ।

সমাজকর্মীরা বলছেন ভারতে বিরাট সংখ্যক পুত্র-শিশু বা কিশোরও নিয়মিত যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে
স্কুল ও পরিবার থেকে শিক্ষা

অনেক স্কুলেই আজকাল ছোট-বয়স থেকেই মেয়েশিশুদের শেখানো হচ্ছে কোন স্পর্শ বা আদর করাটা ভাল, কোনটা খারাপ। কোনটা গুড টাচ, কোনটা ব্যাড।

আর কেউ খারাপভাবে ছুঁলে যে সেটা মাকে বলতেই হবে, সেটাও বোঝানো হচ্ছে শিশুদের।

পশ্চিমবঙ্গ শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশনের চেয়ারপার্সন অনন্যা চক্রবর্তী বলছিলেন, “ভালো স্পর্শ আর খারাপ স্পর্শ নিয়ে পাঠ দেওয়াটা এখনও মূলত অভিজাত স্কুলগুলিতেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু সরকারী স্কুলেও যাতে এগুলো শেখানো হয়, তার জন্য আমরা স্কুল সিলেবাস কমিটির সঙ্গে বৈঠক করেছি। তারা আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে বিষয়টা পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করবেন বলে কথা দিয়েছেন।”

“শুধু মেয়েদের শেখালে তো চলবে না, ছোট ছেলে বা সদ্য-কিশোরদেরও এই পাঠটা দেওয়া দরকার যে একটা মেয়ে মানেই শুধু শরীর নয় – সে সব অর্থেই ছেলেদের সমান। অথচ উল্টোটাই মনে করে বহু ছোট ছোট ছেলেরাও। বদলাতে হবে এই মানসিকতা,” বলছিলেন শাশ্বতী ঘোষ।

হাজার হাজার মামলা, বিচার সময় মতো শেষ হয় না

শিশুদের ধর্ষণ বা তাদের ওপরে যৌন নির্যাতনের ঘটনা কিছুটা বেড়ে চলার একটা কারণ হল- নির্যাতনকারীরা অনেক সময়েই অপরাধ করেও পার পেয়ে যায়। যেটা দেখে ওইরকম ঘটনা ঘটাতে উৎসাহিত হয় আরও অনেকে।

পরিসংখ্যানও বলছে, শিশুদের ওপরে যৌন নির্যাতনের ঘটনার বিচার সময় মতো শেষ হয় না।

জাতীয় অপরাধ রেকর্ড ব্যুরোর তথ্যেই দেখা যাচ্ছে, ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৫৭ হাজারেরও বেশী শিশু ধর্ষণের মামলা ভারতের নানা আদালতে চলছে। অভিযুক্তদের শাস্তি পাওয়ার হারও মাত্র ২৮ শতাংশ। এর মধ্যে শিশুদের ওপরে যৌন নির্যাতন বা হেনস্থার ঘটনা ধরা হয় নি।

Logo-orginal