, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

admin admin

কক্সবাজারের সর্বস্তরের মানুষকে কাঁদিয়ে চিরদিনের বিদায় নিলেন জি এম রহিমুল্লাহ

প্রকাশ: ২০১৮-১১-২১ ১৯:৪২:৪৭ || আপডেট: ২০১৮-১১-২১ ১৯:৪২:৪৭

Spread the love

কক্সবাজারের সর্বস্তরের মানুষকে কাঁদিয়ে চিরদিনের বিদায় নিলেন জি এম রহিমুল্লাহ
ছবি, সিবিএন।

যে গ্রামে জন্ম জিএম রহিমুল্লাহর, সেই গ্রামের সর্বস্তরের মানুষকে কাঁদিয়ে চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়েছেন তিনি। আর ফিরে আসবেন না অজপাড়াগায়ের এই জননেতা। কারো সাথে দেখা মিলবে না সাদাসিধে মানুষটির। প্রতিবেদন কক্সবাজার নিউজের।

জিএম রহিমুল্লাহ কক্সবাজার সদর উপজেলা পরিষদের বিপুল ভোটে নির্বাচিত চেয়ারম্যান। প্রশাসনিক মূল্যায়নে তিনি অত্যন্ত সৎ ও দক্ষ প্রশাসক এবং সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন।
পাশাপাশি জামায়াতের কক্সবাজার জেলা সেক্রেটারী পদেও ছিলেন জিএম রহিমুল্লাহ।

তিনি জামায়াতের রাজনীতি করলেও সব দলের সাথে ছিল তার সুসম্পর্ক। জীবনে জেনেশুনে কাউকে কষ্ট দেননি। ক্ষতি করেননি কারো। শুধুই দিয়েছেন, নেননি। জমা ছিলনা দু’মুঠো ভাতের টাকা। স্বপরিবারে থাকতেন ভাড়া বাসায়। নিজ গ্রাম ছাড়া অন্য কোথাও একখণ্ড জমি ছিলনা।
এই স্বীকৃতি জিএম রহিমুল্লাহর দুই জানাজার মাঠে উপস্থিত লাখো জনতার। সবাই হাত উঁচিয়ে স্বীকার করেছে ‘জিএম রহিমুল্লাহ ভাল মানুষ ছিলেন।’

মরহুম জিএম রহিমুল্লাহর দ্বিতীয় জানাজা নিজের নাভিকাটা এলাকা সদরের ভারুয়াখালীর দারুল উলুম মাদরাসা সংলগ্ন মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় এক একর বিশিষ্ট উম্মুক্ত মাঠে সংকুলান না হয়ে আশপাশের পাহাড়ের চুড়া, বাসাবাড়ির আঙ্গিনা, পথেঘাটে লোকজন অবস্থান নেয়।

দুপুর ১২টার দিকে জিএম রহিমুল্লাহর লাশবাহী এ্যাম্বুলেন্স  নিজ এলাকা ভারুয়াখালি পৌঁছলে পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। সবার প্রিয় জিএম রহিমুল্লাহকে একনজর দেখতে ছুটে আসে শিশু-কিশোর আবালবৃদ্ধবনিতা। এ সময় অশ্রু ঝরিয়ে অসংখ্য মানুষকে কাঁদতে দেখা গেছে। পাহাড়ের চূড়া বা বাড়ির আঙ্গিনা থেকে ওঁকি মেরে দেখে মা বোনেরা।

বেলা ২ টা বেজে ৪০ মিনিটের দিকে মরহুমের নামাজে জানাজা আদায় করা হয়। ইমামতি করেন ভারুয়াখালী ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান মাওলানা আবুল বশর। শেষে জিএম রহিমুল্লাহকে তার বাড়ির পাশে কবরস্থানে দাফন করা হয়।

জানাজাপূর্ব সমাবেশে কক্সবাজার-৩ (সদর-রামু) আসনের সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল বলেন, জানাজার উপস্থিতি প্রমাণ করে জিএম রহিমুল্লাহ কেমন লোক ছিলেন। ১০ বছরেও এমন জানাজা দেখিনি।
বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা জামায়াতের আমীর জাফর সাদেক বলেন, জিএম রহিমুল্লাহ আমাদের জন্য আদর্শ, এলাকাবাসীর গৌরব। তিনি আপোষহীন নেতা ছিলেন। লোভের উর্ধ্বে থেকে নিজের আদর্শ ধরে রাখতে পেরেছেন।

শিবিরের কেন্দ্রীয় ছাত্র আন্দোলন বিষয়ক সম্পাদক তৌহিদ হোসেন, কক্সবাজার পৌরসভার সাবেক মেয়র সরওয়ার কামাল, টেকনাফের হোয়াইক্ষ্যং ইউপি চেয়ারম্যান জেলা জামায়াতের নায়েবে আমীর অধ্যক্ষ মাওলানা নুর আহমদ আনোয়ারী, কক্সবাজার সদর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান এডভোকেট সলিম উল্লাহ বাহাদুর, রামু উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রিয়াজ উল আলম, চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জামায়াত নেতা মাওলানা জহিরুল ইসলাম, সাবেক ছাত্রনেতা বিশিষ্ট ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর কাশেম, কক্সবাজার সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু তালেব, পেকুয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান উপজেলা যুবদলের সভাপতি শেফায়েত আজিজ রাজু, কক্সবাজার সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান শহিদুল আলম বাহাদুর, ভারুয়াখালী ইউপি চেয়ারম্যান শফিকুর রহমান সিকদার, মাওলানা আবদুর রহিম প্রমুখ।
পরিবাবের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন যুবলীগ নেতা জিএম জাহিদ ইফতেখার।
সভা পরিচালনা করেন এডভোকেট নেজামুল হক।

১ম জানাযা কক্সবাজার।

এর আগে প্রথম জানাজা সকাল ১০টা বেজে ৫০ মিনিটে কক্সবাজার কেন্দ্রীয় ঈদগাহ ময়দানে অনুষ্ঠিত হয়েছে।
ইমামতি করেন জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শীর্ষনেতা মাওলানা আবদুল হালিম।
জননেতা জিএম রহিমুল্লাহর জানাজাপূর্ব সংক্ষিপ্ত সভায় বক্তব্যে তিনি বলেন, আমার আদরের ভাই জিএম রহিমুল্লাহর মৃত্যুর সংবাদ প্রথমে বিশ্বাস হয়নি। কিভাবে তিনি এত অল্প সময়ে চলে গেলেন, ভাবিনি।
মাওলানা আবদুল হালিম বলেন, আপনাদের জিএম রহিমুল্লাহ ছিলেন ছোট মানুষ। হয়ে গেলেন জাতীয় নেতা। তিনি কক্সবাজারবাসীর গৌরব। তার মতো যোগ্যতা সম্পন্ন নেতা হয়তো আর জন্ম নিবেনা।
মরহুম জামায়াত নেতার জানাজায় দল মত নির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষ অংশ গ্রহণ করে।
জানাজার নির্ধারিত স্থান কক্সবাজার কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠ হলেও তা দশটার আগেই কানায় কানায় পূর্ন হয়ে যায়। পার্শ্ববর্তী কক্সবাজার বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন স্টেডিয়াম, পৌরপ্রিপ্যারেটরী উচ্চবিদ্যালয় মাঠ, আশপাশের সড়ক উপসড়কে শোকাহত জনতা অবস্থান নেয়। যে যেখানে ছিল সেখান থেকে জানাজার নামাজে শরিক হন।
জানাজাপূর্ব সমাবেশে কক্সবাজার-৩ (সদর-রামু) আসনের সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল বক্তব্য রাখেন।
তিনি বলেন, আজকে মহানবী (স.) এর জন্মদিন। এমন দিনে জিএম রহিমুল্লাহর জানাজা হচ্ছে। ভাবতে পারিনি তিনি এত কম সময়ে বিদায় নিবেন।
এমপি কমল বলেন, তিনি সবাইকে সন্তুষ্ট রেখে রাজনীতি করতেন। মানুষের যে কোন বিপদে ছুটে যেতেন। নিজের জন্য কিছুই করতে পারেন নি। ভাড়া বাসাতেই জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন।
এমপি কমল বক্তৃতার এক পর্যায়ে মরহুম রহিমুল্লাহর পরিবারের আশ্রয়স্থল হিসেবে একখন্ড জায়গা ব্যবস্থা করার অাশ্বাস দেন।
বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতের আমীর ও কক্সবাজার জেলার সাবেক আমীর মোহাম্মদ শাহজাহান।
তিনি বলেন, তার ঘরে অনেক সময় চাল থাকতোনা। আমাদের চাল কিনে দিতে হতো। তার মতো নির্লোভ মানুষ এই পৃথিবীতে হয়না।
তিনি বলেন, একজন উপজেলা চেয়ারম্যান হলেও চাল চলন ছিল সাধারণ মানুষের মতো।
বিএনপির কেন্দ্রীয় মৎস্যজীবী বিষয়ক সম্পাদক কক্সবাজার সদর-রামু আসনের সাবেক এমপি লুৎফুর রহমান কাজল বলেন, জিএম রহিমুল্লাহ আমার বন্ধু।
তার সাথে আমার রাজনৈতিক বিরোধ ছিল, তা ঠিক। কিন্তু তার মতো সাহসী বলিষ্ঠ নেতা আমি আর দেখিনি। ২৪ ঘন্টাই রাজনীতি, সমাজসেবা ছিল তার কাজ।
কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের লে.কর্নেল (অব.) ফোরকান অাহমদ বলেন, আমি দায়িত্ব পালনের কারণে জিএম রহিমুল্লাহকে কাছ থেকে দেখেছি। প্রায় সময় আমার পরামর্শ নিতেন। খুবই কর্মঠ জনপ্রতিনিধি ছিলেন। জনগণের সেবার মানসিকতা লালন করতেন। একটি রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত থাকলেও তার মাঝে প্রভাব ছিলনা। তার মধ্যে কোন বদনামিমূলক কাজ দেখিনি, শুনিনি।
কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মুজিবুর রহমান বলেন, আমি জিএম রহিমুল্লাহর সাথে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছি। তিনি অত্যন্ত ভাল মানুষ ছিলেন। আমার সাথে সবসময় যোগাযোগ রাখতেন। আমার স্ত্রীর মৃত্যুর দিন সকাল থেকে লাশ দাফন পর্যন্ত সাথে ছিলেন। মানসিক সাহস যুগিয়েছেন।

জানাজাপূর্ব সভায় বক্তব্য রাখেন- কক্সবাজার জেলা জামায়াতের আমীর মাওলানা মোস্তাফিজুর রহমান, নায়েবে আমীর ঝিলংজা ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান মাওলানা আবদুল গফুর, টেকনাফের হোয়াইক্ষ্যং ইউপি চেয়ারম্যান জেলা জামায়াতের নায়েবে আমীর অধ্যক্ষ মাওলানা নুর আহমদ আনোয়ারী, শিবিরের কেন্দ্রীয় ছাত্র আন্দোলন বিষয়ক সম্পাদক তৌহিদ হোসেন, চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এডভোকেট ফরিদ উদ্দিন খান, অধ্যক্ষ নুর হোসেন সিদ্দিকী, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের সাবেক ভিপি অধ্যক্ষ রেজাউল করিম, কক্সবাজার পৌরসভার সাবেক মেয়র সরওয়ার কামাল, কক্সবাজার শহর জামায়াতের আমীর আলহাজ্ব সাইয়েদুল আলম, ইসলামী ঐক্যজোটের কক্সবাজার জেলা সভাপতি হাফেজ মাওলানা সালামত উল্লাহ, রামু উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান উপজেলা জামায়াতের আমীর ফজলুল্লাহ মোহাম্মদ হাসান, সাবেক ছাত্রনেতা বিশিষ্ট ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর কাশেম, কক্সবাজার সদর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান এডভোকেট সলিম উল্লাহ বাহাদুর, সদর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান শহিদুল আলম বাহাদুর,
জেলা শিবির সাবেক সভাপতি হেদায়েত উল্লাহ, বর্তমান সভাপতি রবিউল আলম, শহর শিবির সভাপতি রিদুয়ানুল হক জিসান প্রমুখ।
জেলা প্রশাসের পক্ষ থেকে প্রথম নামাজে জানাজায় অংশ গ্রহণ করে বক্তব্য দেন কক্সবাজার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এএইচ এম মাহমুদুর রহমান।
জানাজাপূর্ব সভা পরিচালনা করেন জেলা জামায়াতের সাংগঠনিক সম্পাদক শামসুল আলম বাহাদুর ও শহর জামায়াতের সেক্রেটারী আবদুল্লাহ আল ফারুক।
জামায়াত নেতা জিএম রহিমুল্লাহ (৫৪) হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মঙ্গলবার (২০ নভেম্বর) কক্সবাজার শহরের হোটেল সাগরগাঁওতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এর আগের রাতে তিনি হোটেলের চতুর্থ তলার ৩১৬ নম্বর কক্ষে একাই ঘুমান। দুপুর পর্যন্ত ঘুম থেকে না ওঠায় তাকে ডাকতে যায় হোটেলের এক বয় ছেলে। এরপর ডাকতে যায় হোটেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও জিএম রহিমুল্লাহর শ্যালক শাহেদুল ইসলাম।
তিনিও গিয়ে প্রথমে দরজা ধাক্কা দেন। কোনো সাড়া-শব্দ পাননি। পরে ভ্যান্টিলেটর দিয়ে উঁকি মেরে দেখেন- জিএম রহিম উল্লাহ উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে আছেন। ২টা ৪০ মিনিটের দিকে বিকল্প চাবি দিয়ে দরজা খুলে দেখেন তিনি মারা গেছেন। পরে পুলিশকে খবর দেয় তারা।
শাহেদ জানান, জিএম রহিমুল্লাহ মাঝে মধ্যে হোটেল সাগরগাঁওতে রাত যাপন করতেন। সোমবার রাতেও এসে হোটেলের চার তলার ৩১৬ নং কক্ষে ঘুমাতে যান। হোটেলে থাকলে সকালে ফোন করে নাস্তা আনাতেন। কিন্তু মঙ্গলবার তিনি তা করেননি।
জিএম রহিমুল্লাহ কক্সবাজার সদরের ভারুয়াখালীর বানিয়াপাড়ার বাসিন্দা মৃত আব্দুল হাকিমের ছেলে। তিনি ভারুয়াখালী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান, সাংসারিক জীবনে ৪ মেয়ে ও ১ ছেলের জনক।
এদিকে জিএম রহিম উল্লাহর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে শহরের হোটেল সাগর গাঁওয়ের সামনে প্রচুর লোক ভিড় করে।

জননেতাকে এক নজর দেখতে সাধারণ মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে। অনেকে লাশ দেখে হতবিহবল হয়ে যায়।
দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে হোটেল প্রাঙ্গণে সারারাত লাশবাহী এ্যাম্বুলেন্স সাগর গাঁও এর সামনে রাখা হয়। সেখান থেকে সরাসরি কক্সবাজার কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠে জানাজার উদ্দেশ্যে নেয়া হয়। প্রথম জানাজা শেষ করে দুপুুুর ১২ টার দিকে জিএম রহিমুল্লাহর লাশ গ্রামের বাড়ি ভারুয়াখালী নেয়া হয়।

Logo-orginal