, মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪

admin admin

কর্ণফুলী রক্ষা চট্টগ্রামবাসীর প্রাণের দাবি” প্রভাবশালীদের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ হোক”

প্রকাশ: ২০১৯-০২-০৬ ১২:২৭:০৫ || আপডেট: ২০১৯-০২-০৬ ১২:২৭:০৫

Spread the love

চট্টগ্রামঃ কর্ণফুলী রক্ষা এখন চট্টগ্রামবাসীর প্রাণের দাবি। অবৈধ উচ্ছেদে যত প্রভাবশালীই হোক কেউ যেন ছাড় না পায় সেটাই দেখতে চায় সব শ্রেণির মানুষ। অতীতে দেখা গেছে উচ্ছেদের পর ভূমি রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপের অভাবে পুনরায় দখলে চলে যায় বন্দরের মূল্যবান জায়গা। চলতে থাকে অবৈধ দখলের মহোৎসব।

এর আগেও কর্ণফুলী নদীর উচ্ছেদ অভিযান চললেও পরবর্তীতে ভূমি দখল ঠেকানো যায়নি। পুনরায় দখল হয়ে যায় বন্দরের মূল্যবান ভূমি। নদীর জায়গায় ঘরবাড়ি, বস্তি, দোকান ও মিল কারখানা তৈরি করে অবৈধ দখলদাররা প্রতি মাসে আয় করে কোটি কোটি টাকা।

ভুয়া দলিলে বেচাবিক্রিও হয় বন্দরের ভূমি। মূলত হযরত শাহ আমানত সেতু থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের ১নং জেটি পর্যন্ত নদী দখলের এ মহোৎসব চলে। তবে এবার প্রশাসনের জোরালো অভিযানের ফলে উদ্ধারকৃত ভূমি রক্ষায় পরিকল্পিত পদক্ষেপের দাবি উঠেছে বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে। প্রসঙ্গত, গতকাল মঙ্গলবার দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দরের ‘প্রাণ’ হিসেবে পরিচিত কর্ণফুলী নদীর উত্তর পাড়ে প্রভাবশালীদের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে দ্বিতীয় দিনের অভিযান চালানো হয়। অভিযানে কর্ণফুলী জেটি সংলগ্ন আদমঘাট এলাকায় ৭টি লবণ কারখানা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এর আগে উচ্ছেদ অভিযানের প্রথম দিন সোমবার এক কিলোমিটার এলাকা দখলমুক্ত করা হয়। এ সময় উদ্ধার করা হয় ৮০টি অবৈধ স্থাপনা সরিয়ে ৪ একর ভূমি।

উচ্ছেদ কার্যক্রমের সমন্বয়ক ও জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাহমিলুর রহমান জানান, ‘চাক্তাই থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত কর্ণফুলীর অবৈধ দখল উচ্ছেদ অভিযান কার্যক্রমকে তিনটি জোনে ভাগ করা হয়েছে। মোট ২ হাজার ১৮৭টি স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে। প্রথম ধাপে সদরঘাট থেকে বারিক বিল্ডিং পর্যন্ত সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে। এরপর পর্যায়ক্রমে অপর দু’টি জোনে উচ্ছেদ অভিযান চলবে।’ চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিক আলীউর রহমান দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, ‘কর্ণফুলী নদীর প্রত্যেকটি অংশ মূল্যবান ভূমি। এগুলো সংরক্ষণে দরকার যথাযথ পরিকল্পনা। নদীর উভয় পাড়ে উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে অবৈধ দখলদারদের তুলে দিতে হবে। এরপর উদ্ধারকৃত ভূমিতে বন্দরের কাজে ব্যবহার, পার্ক ও লিংকরোড তৈরি ছাড়াও পরিকল্পিত বনায়ন করতে হবে। না হয় বন্দরের এসব ভূমি পুনরায় দখল হয়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘শুধু অবৈধ উচ্ছেদ নয়, যারা এতদিন ধরে বন্দরের জায়গা দখল করে রেখেছে তাদের গ্রেপ্তার এবং ক্ষতিপূরণ আদায়ের ব্যবস্থা করলে দখলদারদের বেপরোয়া মনোভাব বন্ধ হবে।’ চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াছ হোসেন বলেন, ‘কর্ণফুলী নদীর অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ অভিযান চলছে। পুরোপুরি উচ্ছেদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ অভিযান চলবে। পূর্ণাঙ্গভাবে সরকারি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার পর এসব ভূমি রক্ষায় পরিকল্পিত কাজ শুরু হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে বনায়ন ও ওয়ার্কওয়ে নির্মাণ করা হবে উদ্ধারকৃত ভূমিতে।’

সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, দেশের অর্থনীতির প্রাণ প্রবাহ কর্ণফুলী নদীর অবৈধ দখল শুরু হয় আশির দশকে। নদীর কালুরঘাট সেতু থেকে মোহনা পর্যন্ত প্রায় ২৩ কিলোমিটার এলাকায় এ দখল যজ্ঞ চলে আসছে। তবে শাহ আমানত সেতুর পশ্চিম পাশ থেকে বন্দরের ১নং জেটি পর্যন্ত অবৈধ দখলদারদের তৎপরতা ছিল সবচেয়ে বেশি। নদীর জায়গা দখল করে ঘরবাড়ি, বস্তি, দোকান ও মিলকারখানা তৈরি করার কারণে অবৈধ দখলদারের দখলে চলে গেছে কর্ণফুলী। প্রতি বছরই দখলদারদের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে অনেকটা বিলীন হয়ে যায় নদীর দুই তীরও।

সূত্র জানায়, ভর জোয়ারের সময় পানি যে জায়গায় গিয়ে স্থির হয়, সেখান থেকে ৫০ মিটার পর্যন্ত কর্ণফুলী নদীর সীমানা। কালুরঘাট থেকে মোহনা পর্যন্ত কর্ণফুলী নদীর মালিকানা হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর। কিন্তু নদীর উভয় তীরের বেশিভাগ জায়গা অরক্ষিত। এসব জায়গার মধ্যে কিছু কিছু বন্দর কর্তৃপক্ষ লিজ দিলেও অবশিষ্ট ভূমির বেশিরভাই অবৈধ দখলে চলে গেছে। এসব জায়গায় অন্তত ৫ হাজার ঘরবাড়ি, বস্তি, দোকান ও মিলকারখানা তৈরি করেছে অবৈধ দখলদাররা। তারা এসব অবৈধ স্থাপনা থেকে প্রতি মাসে ভাড়া দিয়ে আয় করছে কোটি কোটি টাকা।

অবৈধ দখলদাররা প্রতি ফ্যামিলি ঘর ভাড়া দিয়ে সর্বনি ১২০০ থেকে সর্বোচ্চ ৩ হাজার টাকা এবং ব্যাচলর ঘর ভাড়া দিয়ে ৩০০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। এ ছাড়া তারা পাঁচশ দোকান ও কারখানা তৈরি করেও ভাড়া আদায় করছে।

অভিযোগে জানা গেছে, অবৈধ দখলদারদের কেউ কেউ বস্তি তৈরি করে সন্ত্রাস, মাদক ও অসামাজিক কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে স্থানীয়রা ভয়ে এ ব্যাপারে মুখ খুলছে না।

স্থানীয় জনসাধারণের সাথে কথা বলে জানা গেছে, অবৈধ স্থাপনা তৈরি করে ভাড়া দেওয়ার পাশাপাশি ভূমি অফিসের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহযোগিতায় ভুয়া দলিল সৃষ্টি করে বেচাবিক্রিও করছে অবৈধ দখলদাররা। প্রতি গন্ডা তিন থেকে চার লাখ টাকা করে দখলসত্ত্ব বিক্রি করে সহজ সরল মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ারও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসে তাদের নাম ভাঙিয়ে রাতারাতি দখল ও অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের ধারা অব্যাহত থাকে। চাক্তাই, মাঝিরঘাট, শিকলবাহা ও চরলক্ষ্যা এলাকায় সবচেয়ে বেশি অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের কারণে কর্ণফুলী নদী অস্তিত্ব সংকটে পড়ে। কিন্তু দু’পাশে বেপরোয়া দখলবাজির কারণে সংকীর্ণ হয়ে যাওয়া নদীর জায়গায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে উদ্যোগ না নেওয়ায় বন্দরের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০০১ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ম্যাজিস্ট্রেট থাকাকালীন বর্তমানে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মহাপরিচালক মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী নদীর তীরবর্তী বন্দর এলাকায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে প্রায় সাড়ে চার হাজার অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে। এতে উদ্ধার করা হয় প্রায় ১২৭ একর ভূমি। যার আনুমানিক বাজার মূল্য প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। একই সাথে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকা জরিমানা আদায় করে বন্দর তহবিলে জমা দেন। অভিযানে তিনি এক ডজনেরও বেশি অবৈধ ডকইয়ার্ড, বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের অবৈধ খাত ও জেটি অপসারণ করেন। তাঁর সাঁড়াশি অভিযানের কারণে ওই সময়ে কর্ণফুলী নদীর দখলের বেপরোয়া প্রবণতা থেমে যায়। তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট মুনীর চৌধুরীর টানা অভিযানে উদ্ধারকৃত জমির প্রায় ৮০ শতাংশ ব্যবহার হয় বন্দরের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ কাজে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো লালদিয়া চর কন্টেইনার টার্মিনাল, পতেঙ্গা নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনালসহ বিভিন্ন স্থাপনা।

কিন্তু বন্দর থেকে তাঁর বদলি হওয়ার পর নদীর তীরে অবস্থিত কোনো কোনো শিল্প কারখানা অবৈধভাবে তাদের জেটি সম্প্রসারণ করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এমনকি কোনো কোনো সিমেন্ট কারখানার বর্জ্য পড়ে নদী ভরাট হতে থাকে। তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট মুনীর চৌধুরীর ওই অভিযান ছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরের ১৩০ বছরের ইতিহাসে কর্ণফুলী নদীর দখল উচ্ছেদে অভিযান চালানো হয়নি। এমনকি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে জরিমানা আদায় করা হয়নি এক টাকাও।

অভিযোগে জানা গেছে, বন্দরের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর ইন্ধনে কর্ণফুলী নদীর অবৈধ দখল কার্যক্রম চলে। ২০০৭ সালে তৎকালীন বন্দর ম্যাজিস্ট্রেট মুনীর চৌধুরী বদলির হওয়ার পর অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে বন্দরের উচ্ছেদ তৎপরতা ভাটা পড়ে। উৎসঃ দৈনিক পুর্বকোণ।

Logo-orginal