, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

jamil Ahamed jamil Ahamed

সৌদি আরবের তেল স্থাপনায় হামলার জেরে যুদ্ধের আশংকা

প্রকাশ: ২০১৯-০৯-১৭ ১৫:৩৩:০৪ || আপডেট: ২০১৯-০৯-১৭ ১৫:৩৩:০৪

Spread the love

সৌদি আরবের তেল স্থাপনায় ড্রোন হামলার অনেক প্রশ্নের জবাব এখনও মেলেনি। শনিবার ভোর হওয়ার আগেই ওই হামলায় বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম আকাশ ছুঁয়েছে।

এখন সামরিকভাবে ওই হামলার জবাব দেয়া হয় কিনা, সেটিই সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। সৌদি আরবের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ আবকাইক ও কুরাইসে আরমাকো পেট্রোলিয়াম এবং গ্যাস প্রক্রিয়াজাতকরণ স্থাপনায় ফজরের সময় ওই ড্রোন হামলার ঘটনা ঘটেছিল।

এতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল রফতানিকারক দেশটির অপরিশোধিত তেলের উৎপাদন অর্ধেকের বেশি কমে গিয়েছিল। এই কমে যাওয়াটা দিনে গড়ে ৫৭ লাখ ব্যারেলের বেশি হবে।

হামলার দায় স্বীকার করেছে প্রতিবেশী ইয়েমেনভিত্তিক হুতি বিদ্রোহীরা। ইরানসংশ্লিষ্ট ওই গোষ্ঠীটির বিরুদ্ধে ২০১৫ সাল থেকে বিমান হামলায় চালিয়ে আসছে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট।

হামলার দায় স্বীকার করে হুতিরা বলছেন, তারা সৌদি আরবে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা অব্যাহত রাখবেন।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও দ্রুতই হামলার দায় ইরানের ঘাড়ে চাপিয়েছেন। কোনো ধরনের প্রমাণও হাজির করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করলেন না তিনি। ইরানও তাৎক্ষণিকভাবে দায় অস্বীকার করেছে।

এ অবস্থা উপসাগরীয় অঞ্চলে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নতুন করে যুদ্ধের আশঙ্কা উসকে দিয়েছে, যা ব্যাপক ও বিধ্বংসীভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে।

হামলার ঘটনার পর সোমবার ইয়েমেনে জাতিসংঘের শান্তির দূত মার্টিন গ্রিফিথস এক আতঙ্কজনক শঙ্কার কথা জানিয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যে এমনিতেই ভয়াবহ উত্তেজনা বিরাজ করছে। এতে বড় ধরনের সংঘাত ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করেন গ্রিফিথস।

একটি ভিডিও লিংকের মাধ্যমে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে তিনি বলেন, এ ধরনের পদক্ষেপে ইয়েমেন সংঘাত আঞ্চলিক বিধ্বংসী লড়াইয়ে রূপ নিতে পারে।

‘এই মারাত্মক ঘটনাটি আঞ্চলিক সংঘাতকে আরও ব্যাপকতর জায়গায় নিয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি করছে,’ বললেন জাতিসংঘের এ দূত।

ব্রিটিশ থিংকট্যাংক রয়েল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের মধ্যপ্রাচ্যে হুতি ও অন্যদের ড্রোন ব্যবহারবিষয়ক একটি প্রতিবেদনের লেখক জাস্টিন ব্রোংক মনে করেন, জ্বলন্ত তেল স্থাপনার কিছু ছবিতে বিস্ফোরণের কারণে গর্তের যে দৃশ্যপট ফুটে উঠেছে, তাতে মনে হচ্ছে- এটি ক্রুজ মিসাইল হামলা ছিল। এতে ইরানি সংশ্লিষ্টতার আভাস দিচ্ছে।

তার ধারণা, ইয়েমেন থেকে হুতি এবং ইরান যৌথভাবে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে।

অন্যান্য সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরাকে ইরানসংশ্লিষ্ট মিলিশিয়াদের উৎক্ষেপণ স্থান থেকে এ হামলা চালানো হয়েছে।

ছয় বিশ্বশক্তির সঙ্গে ইরানের সই করা পরমাণু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র গত বছর একতরফাভাবে সরে আসে। এর পর দুই দেশের মধ্যে পরিস্থিতি ধারাবাহিকভাবে অবনতি ঘটছে।

ইরানের অর্থনীতিকে ভেঙে দিতে দেশটির তেল ও ব্যাংক খাতের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।

ইরানও পরমাণু চুক্তির প্রতিশ্রুতি থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। চলতি বছরের মে মাসে সৌদি তেল পাইপলাইন এবং ট্যাংকারে হামলার দায়ও যুক্তরাষ্ট্র ইরান ও হুতি বিদ্রোহীদের ওপর চাপিয়েছে।

সম্প্রতি কয়েক সপ্তাহে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা কিছুটা কমেছিল। নিষেধাজ্ঞায় কিছুটা শিথিলতা ও ইরানি প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির সঙ্গে বৈঠকের সম্ভাবনা তৈরি করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

চলতি মাসের শেষে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনেই দুই নেতার মধ্যে বৈঠকের এ সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছিল।

এখন পরিস্থিতি এমন জায়গা গেছে যে এমন বৈঠক এখন অসম্ভাব্য।

থিংকট্যাংক বার্সেলোনা সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের জ্বালানি তেলের বাজার ও উপসাগরীয় নিরাপত্তাবিষয়ক বিশেষজ্ঞ একহার্ট ওয়ের্টার্জ বলেন, ইরানি কৌশল থেকেই এ হামলার ঘটনা ঘটেছে।

তিনি বলেন, কোনো ছায়া বাহিনী পাইপলাইনে বোমা হামলা চালায়নি যে, যেটা অল্প সময়ের ভেতর সংশোধন করা যাবে। এটি সৌদি আরবের অবকাঠামোর মূল কেন্দ্রে হামলার ঘটনা।

‘এখন পর্যন্ত ইরানিরা দক্ষতার সঙ্গে উত্তেজনা বাড়িয়ে চলছেন। কিন্তু সৌদি তেল স্থাপনায় হামলা এক অস্বাভাবিক ঘটনা। কাজেই প্রতিশোধ নেয়ার বাইরে খুব কমই উপায় আছে ট্রাম্পের সামনে,’ বললেন এ বিশ্লেষক।

তিনি মনে করেন, ইরানের হিসাব-নিকাশ এ ক্ষেত্রে যেটা হতে পারে, সেটা হলো দ্বিতীয় কোনো পরিকল্পনা তাদের হাতে রয়েছে।

যুদ্ধে যাওয়ার ক্ষেত্রে ট্রাম্পের অনিচ্ছার প্রতি ইঙ্গিত করে ব্রোংক বলেন, ইরানের হিসাব হচ্ছে, পশ্চিমারা তাদের সঙ্গে কোনো যুদ্ধে যেতে চায় না। ইরান নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র বিভক্ত। ট্রাম্পও সংঘাতবিরোধী। কাজেই ইস্যুটিকে উত্তপ্ত অবস্থায় রাখতে চায় ইরান।

সম্প্রতি যুদ্ধবাজ ও কট্টরপন্থী জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টনকে বরখাস্ত করছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ইরাক ও আফগানিস্তানে যুদ্ধ নিয়ে আতঙ্কের রেশ মার্কিন ভোটারদের এখনও কাটেনি। কাজেই ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে তাকে এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।

ব্রোংক বলেন, ইরানের স্বার্থে ওপর চাপ প্রয়োগ অব্যাহতভাবে বাড়ছে। তারা অবশ্য কোনো যুদ্ধে জড়াতে চাচ্ছেন না। বিশেষ করে এ হামলায় ইরানের সম্পর্ক থাকলেও নির্দিষ্টভাবে ইসলামী প্রজাতন্ত্রটিকে দায়ী করা যাচ্ছে না।

এনার্জি কিংডামসের লেখক ও রাইস বিশ্ববিদ্যালয়ের উপসাগরীয় অঞ্চলবিষয়ক গবেষণা বিশ্লেষক কিম ক্রেইন মনে করেন, ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধ বন্ধে মধ্যস্থতার ভূমিকা রাখতে এ হামলা বিশ্বের জন্য সজাগ হওয়ার আহ্বানও হতে পারে।

হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে হামলায় নেতৃত্ব দিচ্ছে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট আবদ-রাব্বু মানসুর আল হাদীর পক্ষে এ দুই দেশ সেখানে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে। জাতিসংঘের মতে, এতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে ইয়েমেনে।

ক্রেইন বলেন, সর্বনাশা ইয়েমেন যুদ্ধ থেকে এই হামলার ঘটনা ঘটেছে। কাজেই এ সংঘাত নিরসনে বিশ্বের আরও মনোযোগ দেয়া উচিত বলে দাবি রাখে। সেখানে সৌদি আরবের বোমা হামলায় হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষ মারা যাচ্ছেন। কিন্তু সে অনুসারে সৌদি খুব বেশি প্রত্যাঘাত পাচ্ছে না।

‘আমরা এক ভয়ঙ্কর উত্তেজনার মুহূর্তে রয়েছি। ইয়েমেন যুদ্ধের নিষ্পত্তিতে এ হামলা বিশ্বকে জোরালো আহ্বান জানাতে পারে। আবার সৌদি ও ইরানকে সরাসরি যুদ্ধের দিকেও নিয়ে যেতে পারে, যাতে যুক্তরাষ্ট্রকেও অবশ্যই জড়াতে হবে,’ যোগ করলেন এ গবেষক।

মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়ার কথা সোমবার পুনর্ব্যক্ত করেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। জুনে তেহরান একটি মার্কিন সামরিক নজরদারি ড্রোন ভূপাতিত করার পর প্রতিশোধমূলক বোমা হামলার নির্দেশ দিয়ে শেষ মুহূর্তে এসে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।

হামলায় সম্ভাব্য প্রাণহানির কথা ভেবে পিছু হটেছেন বলে তখন তিনি জানিয়েছেন। তবে সৌদি তেল স্থাপনায় হামলার জবাবের প্রস্তুতির কথা ব্যক্ত করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। কাজেই মার্কিন সেনাপ্রধানও এখন সেদিকে যাবেন?

ব্রোংক প্রশ্ন রাখেন, কিসের জন্য তাদের প্রস্তুতি? অপেক্ষাকৃত অল্প সময়ের নির্দেশনায় ইরানি স্থাপনায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র? জবাব যদি ‘হ্যাঁ’ হয়, তবে মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক রূপ নেবে। যে জন্য ট্রাম্প প্রশাসন প্রস্তুত না। সুত্র” যুগান্তর ।

Logo-orginal