, শনিবার, ৪ মে ২০২৪

admin admin

রাসুল (সঃ) এর হাদীস মেনে চীনের উহান ফিরে না আসা বাংলাদেশী পরিবারের গল্প

প্রকাশ: ২০২০-০৩-০৯ ১৯:২০:০৯ || আপডেট: ২০২০-০৩-০৯ ১৯:২০:০৯

Spread the love

আমি পড়ালেখার উদ্দেশ্যে ২০১৪ সালের ৩১ আগস্ট চীনের উহান শহরে আসি। ২০১৮ সালের মধ্যম ভাগে পড়াশোনার পাঠ শেষ করে উহান শহরেরই উহান বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্টডক্টরাল রিসার্চ ফেলো হিসেবে কর্মরত আছি। বর্তমানে এই করোনাভাইরাস সংকটেও আমি, আমার স্ত্রী এবং আমাদের তিন বছরের ছেলে সবাই উহানেই আছি।

যাই হোক এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে প্রায় ৯০টিরও বেশি দেশের মানুষ সংক্রমিত হয়েছেন। তবে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা বিশ্বের মধ্যে চীনেই সর্বাধিক। চীনের মধ্যে উহান শহরের অবস্থা বেশি নাজুক। আলহামদুল্লিলাহ আল্লাহর ইচ্ছাই আমরা সেই উহান শহরেই এখনও সুস্থ এবং খুবই ভালো আছি।

এই সংকটময় পরিস্থিতিতে অন্য সবার মত আমরাও কিছুটা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলাম খুবই সামান্য সময়ের জন্য। কারণ গত ২৩ জানুয়ারি ২০২০ থেকে উহানের সমস্ত সাধারণ নাগরিকদের তাদের নিজেদের বাসস্থানে অবস্থান করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু শুধুমাত্র নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কেনার জন্য আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরের সুপারশপে যেতে পারি। এই সুপারশপে এখন মাছ ও হালাল গোস্ত পাওয়া যায় না। তাই আমরা একটু চিন্তিত হই আমাদের তিন বছরের বাচ্চার পুষ্টির ভারসাম্য নিয়ে। ঠিক সেই সময়েই আমার মুসলিম বন্ধু সোলায়মান আল্লাহর ইচ্ছায় তার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। আমি যখন তাকে জানালাম এই মহামারীর কারণে আমাদের দেশের (বাংলাদেশ) যারা উহানে ছিল তার প্রায় ৯০ ভাগই বিশেষ ফ্লাইটে দেশে ফিরে গেছে। কিন্তু হাদিসের নির্দেশ অনুসারে আমরা পরিবারসহ উহানেই থেকে গেছি। তখন তিনি খুবই খুশি হলেন এবং জানালেন উনি এবং উনার পরিবার একই কারণে উহান ছেড়ে যাননি।

সোলায়মান ভাই এবং আমরা একটু দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ করার চেষ্টা করি। সেই সূত্রেই উনার সঙ্গে আমার পরিচয়। উনি মুলত চীনের নিংশিয়া প্রদেশের উজহং শহর থেকে উহানে ব্যবসার উদ্দেশ্যে এসেছেন। সেখানে সোলায়মান ভাই খাওয়ার হোটেল এবং হালাল গোস্তের ব্যবসা করেন। যে কথা বলছিলাম, বর্তমানে উহানে মাছের কিছুটা সংকট দেখা দিয়েছে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপারশপে মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু উনাকে আমার ছোট বাচ্চার কথা বলায় উনি অনেক খুঁজে প্রায় ৫-৬ কেজি মাছ কিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে দিয়ে যান। শুধু মাছই নয় সঙ্গে দুধ এবং অনান্য খাবার সামগ্রী তিনি নিজে এসে পৌঁছে দিয়ে যান। এই সংকটময় পরিস্থিতিতে উনার এই সাহায্যে আমরা খুবই অভিভূত হই।

আরও অবাক করা বিষয় হল, এই সমস্ত খাদ্য দ্রব্যাদির জন্য উনি কোনো অর্থ গ্রহণ করেননি। যদিও আমি তাকে উইচ্যাটের মাধ্যমে অর্থ প্রদান করেছিলাম কিন্তু উনি ওই অর্থ আমাকে ফিরিয়ে দেন এবং বলেন তুমি যদি এগুলোর বিনিময়ে আমাকে অর্থ প্রদান কর তাহলে তোমার সঙ্গে আমি আর যোগাযোগ রাখব না।

সোলায়মান ভাই এবং উনার পরিবার বর্তমানে উহানে সেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন। করোনাভাইরাসে সংক্রমিত ব্যক্তিদের সেবা দেয়ার জন্য অন্যদের মতো চীনের অন্যান্য প্রদেশ ও শহর থেকে বেশ কিছু মুসলিম চিকিৎসা কর্মী উহানে এসেছেন। মূলত উনাদের হালাল খাবারের ব্যবস্থা করেন আমাদের সুলাইমান ভাই। যাই হোক আলহামদুলিল্লাহ আমাদের ঘরে আগে থেকেই মুরগি এবং ছাগলের গোস্ত কেনা ছিল। কিন্তু আমরা প্রায় দের মাস হালাল গোস্ত কেনার জন্য বাইরে যেতে পারছি না। যদিও আমার বাসায় এখনও তিন থেকে সাড়ে তিন কেজি মুরগি ও ছাগলের গোস্ত আছে।

তারপরও ভবিষ্যতের নিরাপত্তার জন্য এবং অন্যান্য ভাইদের গোস্ত শেষ হয়ে যাওয়ায় সোলায়মান ভাইকে গোস্ত সরবরাহের কথা জানাই। কারণ উনি আমাকে বলেন তোমার এবং অন্যান্য মুসলিমদের (উহানের অন্য যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়) যদি কিছু প্রয়োজন হয় তাহলে উনাকে যেন অবশ্যই অবগত করি। উনি জানান গরুর গোস্ত পর্যাপ্ত পরিমানে উনার কাছে মজুত আছে। তাই আমরা কয়েকজন মিলে সোলায়মান ভাইয়ের কাছ থেকে আমাদের চাহিদা অনুযায়ী গরুর গোস্ত ক্রয় করি। যদিও বর্তমানে উহানে সব কিছুরই দাম একটু বেশি তারপরও উনি বলেন- আমরা মুসলমান তাই দাম বেশি নিবেন না। আগের বারের মত এবারও বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে গোস্ত আনতে গিয়ে দেখি আমার মত অন্য আরও একজন মুসলিম ভাই সোলায়মান ভাইয়ের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সংগ্রহ করার জন্য ওখানে উপস্থিত হয়েছেন। গতবারের মত এবারও গোস্তের সঙ্গে সোলায়মান ভাই ডিম, আলু, টমেটো এবং বাঁধাকপি নিয়ে হাজির।

আমার মনে হয় আল্লাহ পাক উনাদের মত মানুষদের জন্যই এই পৃথিবী এখনও টিকিয়ে রেখেছেন। দোয়া করি আল্লাহ পাক উনার এবং উনার পরিবারের নেক ও বরকতময় হায়াত দান করুন। সোলায়মান ভাইসহ সমস্ত মুসলিমকে আল্লাহ মাফ করে দিয়ে সরাসরি জান্নাত দান করুন। সেই সঙ্গে যে সমস্ত অমুসলিম এই সংকটময় পরিস্থিতিতে মানুষের সেবা করছেন আল্লাহ যেন তাদেরকেও অবশ্যই হেদায়েত দান করেন। আরও দোয়া করি আল্লাহ পাক যেন সমগ্র বিশ্বের সমস্ত মানুষকে হেদায়েত দান করে বিনা হিসাবে জান্নাত দান করেন।

লেখক : পোস্টডক্টরাল রিসার্চ ফেলো, উহান বিশ্ববিদ্যালয়, উহান, হুবেই, চীন।
সুত্রঃ জাগো নিউজ।

Logo-orginal