, শুক্রবার, ৩ মে ২০২৪

Mohammad Juniad Mohammad Juniad

বাংলা ভাষার আন্তঃনাক্ষত্রিক মহাকাশ যাত্রা

প্রকাশ: ২০২২-০২-২৩ ১৮:৩৫:৫২ || আপডেট: ২০২২-০২-২৩ ১৮:৪২:০৮

Spread the love

বাংলা ভাষার আন্তঃনাক্ষত্রিক মহাকাশ যাত্রা

নূর মোহাম্মদ (নূর)

কম্বোডিয়ার জাতীয় ভাষা ‘খমের’ (Khmer)। ৭৪টি বর্ণমালা নিয়ে পৃথিবীতে সর্বাধিক অক্ষরের এই খমের ভাষা। অন্যদিকে পৃথিবীর প্রাচীনতম ভাষা হিসেবে স্বীকৃত তামিল ভাষায় মূল অক্ষর ৩১টি তবে যুক্তাক্ষর ধরলে সেখানে আরো ২১৬টি অক্ষর যুক্ত হয় অর্থাৎ সব মিলিয়ে ২৪৭টি অক্ষর রয়েছে এই ভাষায়। রোটোকাস – পাপুয়া নিউ গিনির একটি আদিবাসী ভাষা। এই ভাষার মোট ১২টি অক্ষর রয়েছে। খমের, তামিল অথবা রোটোকাস – কোনটার বর্ণমালা রক্তস্নাত নয় যেমনটা আমাদের বাংলা বর্ণমালা। আমাদের রক্তসিক্ত বর্ণমালাগুলো বর্ণময় হয়েছে শহীদ আবুল বরকত, রফিক উদ্দিন আহমেদ, আবদুস সালাম, আবদুল জব্বার, শফিউর রহমান, অহিউল্লাহ সহ অনেক শহিদের বুকের রক্তে।
হাজার বছরেরও বেশি আগে প্রাচীন আর্যভাষা রূপান্তরিত হয়ে বঙ্গীয় অঞ্চলে জন্ম নিয়েছিল এক মধুর-কোমল-বিদ্রোহী-প্রাকৃত ভাষা; আমার প্রাণের বাংলা ভাষা। নানান বিবর্তন, পরিবর্তন, রূপান্তর, নবরূপায়ন, বৈচিত্র্যতার সঙ্কলনে বাংলা ভাষার আজকের অবস্থান। ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার দাবি ডিঙিয়ে বাংলা ভাষা আজ বিশ্বের তিনটি দেশ যথাক্রমে বাংলাদেশ, ভারত ও সিয়েরালিয়নের দাপ্তরিক ভাষা। ভারতের সংবিধান স্বীকৃত ২৩টি দাপ্তরিক ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষা অন্যতম। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা রাজ্য হিন্দি ভাষার পাশাপাশি বাংলা ভাষাকে দাপ্তরিক ভাষা, আসাম এবং আন্দামান-নিকোবর রাজ্য বাংলা ভাষাকে সহ-দাপ্তরিক ভাষা এছাড়া বহুসংখ্যক বাঙালি-অধ্যুষিত রাজ্য ঝাড়খণ্ডে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলা ভাষা দ্বিতীয় দাপ্তরিক ভাষার স্বীকৃতি পায়।
এছাড়া এশিয়া মহাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে আফ্রিকা মহাদেশের সিয়েরা লিওন প্রজাতন্ত্রে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের ভূমিকায় মুগ্ধ হয়ে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ বাংলা ভাষাকে সে দেশের দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। পেয়েছি ইউনেস্কো ও জাতিসংঘের “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” এর গৌরবজ্জল স্বীকৃতি”। এই স্বীকৃতির পিছনের সৌধ শিল্পী কানাডার ভ্যাঙ্কুভার শহরে বসবাসরত দুই প্রবাসী বাঙালি যথাক্রমে রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুস সালাম। তাঁদের প্রতি অফুরন্ত ভালোবাসা। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য “Using technology for multilingual learning: Challenges and opportunities” – “বহুভাষিক শিক্ষার জন্য প্রযুক্তি ব্যবহার: চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগ”।
পৃথিবীর ভৌগোলিক সীমানা পেরিয়ে নক্ষত্রে অনন্ত যাত্রা অবিরত আছে বাংলা ভাষার। আজ থেকে ৪৫ বছর আগে ১৯৭৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বের ভয়েজার-১ (voyager 1) মানবসভ্যতা ও প্রকৃতির বেশকিছু শব্দ, কথা, আর সঙ্গীতের নিদর্শন সাথে নিয়ে মহাকাব্যিক যাত্রা শুরু করেছিলো নাসার এই নভোযান। স্বর্ণের প্রলেপ দেওয়া ‘গোল্ডেন রেকর্ডস’ নামক এই সিডিতে পৃথিবীর ৬৫০০ হাজার কথ্য ভাষার মধ্য থেকে মাত্র ৫৫টি পৃথক ভাষায় সম্বোধন রেকর্ড করা হয়, বাংলা ভাষা তাদের একটি। পশ্চিমবঙ্গের প্রয়াত রাজনীতিবিদ সুব্রত মুখোপাধ্যায় এর কণ্ঠে বাংলা ভাষায় ‘নমস্কার, বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হোক’ সম্বোধন-টি রেকর্ড করা হয়। ২০১২ সালের ২৫শে আগস্ট ভয়েজার-১ আন্তঃনাক্ষত্রিক মহাকাশে (Interstellar Space) এ প্রবেশ করেছে। এটি প্রথম মনুষ্য নির্মিত বস্তু যা আমাদের সৌরজগতের সীমানা পেরিয়ে মিল্কওয়ে গ্যালাক্সির বিশালতায় ঘন্টায় ৬১৫০০ কিলোমিটার নিরবচ্ছিন্ন গতিতে পাড়ি দিচ্ছে অজানার উদ্দেশে আর সেই সাথে পৃথিবী থেকে আজকের দিনে ২৩.৩ বিলিয়ন কিলোমিটার দূরে সেই গতিদায়ক নভোযানের সহযাত্রী হয়ে আছে আমাদের বাংলা ভাষা। ভয়েজার-১ যে গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে সেই গতিতে আমাদের সৌরজগতের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র (সূর্য থেকে ৪.২৩ আলোকবর্ষ দূরে) ‘প্রক্সিমা সেনটাউরি’ (Proxima Centauri) তে পৌঁছাতে আরও সময় লাগবে ৭৪,৪০০ বছর অন্যদিকে গোল্ডেন রেকর্ডসের সেই সিডি আরও ১০০ কোটি বছর মহাশূন্যে টিকে থাকার কথা জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। অজানা নক্ষত্রে কোন উন্নত সভ্যতার হাতে গিয়ে এই সিডি পৌঁছে যাবে একদিন হয়তো, সেই সাথে আমাদের বাংলা ভাষা।
অনেক ভাষায় মহাকাব্যের চূড়ান্ত সফল রূপ যেমন পায়নি তেমনি অনেক ভাষায় লেখা মহাকাব্য হারিয়ে গিয়েছে। ফিলিপাইন – নিজের আদি লেখ্য বর্ণমালা হারিয়ে ফেলেছে। বর্তমানে ইংরেজি হরফে তাগালগ থেকে রূপান্তরিত ফিলিপিনো ভাষায় লিখে। উদার আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসন ও বিশ্বায়নের এই যুগে বাংলা ভাষার সঠিক ব্যবহার, প্রয়োগ এবং উচ্চারণ এবং ভাষার সংমিশ্রণ ও আগ্রাসন থেকে সেভাবে রক্ষা করা যায়নি। যেই ভাষা বুকের রক্ত দিয়ে অর্জন সেই ভাষার বিকৃতি ও দূষণের প্রভাব থেকে নিরাপদ রাখার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। যাহোক, বিশ্ববাসী বাংলা ভাষার জন্য শহিদের বলিদানের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে অমর একুশকে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” হিসেবে স্বীকৃত দেওয়ায় বাংলাদেশে বসবাসরত চাকমা, মারমা, সাঁওতাল, ত্রিপুরা, গারো, তঞ্চ্যঙ্গা, ম্রো, বম, পাংখো, চাক, খেয়াং, খুমি, লুসাই, ডালু, কুকি, রাখাইন, মণিপুরী, হাজং, খাসিয়া, সাঁওতাল, উঁরাও, মুণ্ডা, মাহালি, মাহাতো, পাহান, রাজবংশী, কোঁচ, কৈর্বত্য, মুরং সহ সকল ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কথ্য ও লেখ্য মাতৃভাষা-কে সংরক্ষণ ও ক্রমবিকাশে আমাদের উপর কর্তব্য, প্রতিশ্রুতি ও দায়বদ্ধতা আরও বেড়ে গেল মনে করছি।

লেখক: কাতার প্রবাসী সাংবাদিক,গবেষক ও কমিউনিটি নেতা।

Logo-orginal