, মঙ্গলবার, ৭ মে ২০২৪

admin admin

লিবিয়ায় গিয়ে সন্ত্রাসীদের হাতে জিম্মি ছেলেকে ফিরিয়ে আনল এক দুঃসাহসী মা”

প্রকাশ: ২০২২-০৪-১২ ১৩:০৬:০৬ || আপডেট: ২০২২-০৪-১২ ১৩:০৬:০৯

Spread the love

ছবি: (এম ছাদেক-প্রথম আলো) বাড়ির উঠানে বসে লিবিয়ার দুঃসহ সময়ের গল্প শোনাচ্ছিলেন মা শাহিনুর আক্তার ও ছেলে ইয়াকুব হাসান। সোমবার বিকেলে কুমিল্লা দেবীদ্বার উপজেলার কালিকাপুর।

উন্নত জীবনের আশায় লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিতে যেতে চেয়েছিলেন তরুণ ইয়াকুব হাসান। কিন্তু ধরা পড়েন সস্ত্রাসীদের হাতে। দালালদের মাধ্যমে মুক্তিপণ হিসেবে কয়েক দফায় টাকা দিলেও ছেলের সন্ধান পাচ্ছিলেন না বাংলাদেশে থাকা মা শাহিনুর আক্তার।

একপর্যায়ে ছেলের জন্য পাগলপ্রায় শাহিনুর পৌঁছে যান লিবিয়ায়। দেড় মাস এখানে-ওখানে ছুটে বেড়ান। ছেলের সন্ধানও বের করে ফেলেন। বাংলাদেশ দূতাবাস ও আইওএমের (ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন) সহযোগিতায় মুক্তি পান ইয়াকুব। আলাদা আলাদা দেশে ফিরে দেখা হয় মা-ছেলের।

সিনেমার কোনো চিত্রনাট্য নয়, গল্পটা কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার জাফরগঞ্জ ইউনিয়নের কালিকাপুর গ্রামের শাহিনুর আক্তার (৪৫) তাঁর ছেলে ইয়াকুব হাসানের (২০)। বাংলা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা না জানা শাহিনুরের ছেলেকে দেশে ফিরিয়ে আনার গল্প এখন এলাকাজুড়ে।

গোমতী নদীর বাঁধের দক্ষিণ পাড়ে কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কের লাগোয়া কালিকাপুর গ্রাম। সেই গ্রামে দোচালা টিনের ঘরে শাহিনুর আক্তারের বসতভিটা। সোমবার পড়ন্ত বিকেলে বাড়ির উঠানে বসে কথা হয় মা-ছেলের সঙ্গে।

পরিবারের সদস্যরা জানান, চার বছর আগে শাহিনুরের স্বামী আবুল খায়ের লিবিয়ায় যান। সেখানে তিনি নির্মাণকাজে নিয়োজিত। আবুল খায়ের বিদেশে যাওয়ার ২ মাস ১০ দিন পর একমাত্র ছেলে ইয়াকুব হাসানকেও লিবিয়ায় নিয়ে যান। সেখানে ইয়াকুব কাজ করতেন। এ সময় ইয়াকুব বন্ধুদের প্ররোচনায় ইতালিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। হবিগঞ্জের দালাল জাহাঙ্গীর আলমের মাধ্যমে প্রথমে চার লাখ টাকা দিয়ে ট্যুরিস্ট ভিসায় ইতালিতে রওনা হন। কিন্তু ধরা পড়েন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে। এক মাস জেল খাটেন। পরবর্তী সময়ে আবার ইতালি যাওয়ার উদ্যোগ নেন। এবারও ধরা পড়েন। তবে এবার তাঁর কোনো খোঁজ প্রথম দিকে পাননি পরিবারের সদস্যরা। দেড় মাস পর দালালরা তাঁর বাবা ও মায়ের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করেন। এই সময়ে তাঁরা পরিবারটির কাছ থেকে কয়েক দফায় অন্তত ১৮ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন বলে অভিযোগ।

শাহিনুর আক্তার জানান, তাঁর দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। স্বামী ও ছেলে লিবিয়ায় থাকেন। তাঁকেও ২০১৯ সালের ৩১ জুলাই পাসপোর্ট করে দেন লিবিয়ায় যাওয়ার জন্য। কিন্তু তিনি রাজি হননি। পরবর্তী সময়ে ছেলের বিপদের কথা শুনে চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি ঢাকা থেকে দুবাই ও মিসর হয়ে চার দিনের মাথায় লিবিয়ায় যান।

শাহিনুর বলেন, ‘ইয়াকুবের বাবা আমাকে এয়ারপোর্ট থেকে বেনগাজিতে নিয়ে যায়। যাওয়ার পর প্রথম দেড় মাস কোনো খবর পাইনি ছেলের। এরপর খবর পেলাম লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপলির অদূরে একটি গুহায় শত শত তরুণের সঙ্গে আমার ছেলেও আছে। তখন আমি লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাস ও আইএমওর মাধ্যমে যোগাযোগ করি। কিন্তু অনেক ছবি দেখানো হলেও ছেলেকে চিনতে পারিনি। পরে দেখলাম, জীর্ণ রোগাক্রান্ত একটি ছেলে, ঠিক দেখতে আমার ছেলের মতো। ও-ই আমার ইয়াকুব। এরপর আমি ছেলের বেঁচে থাকার সংবাদ পাই।’

আমি সুদে টাকা এনে, স্বর্ণ ও গরু বিক্রি করে চার লাখ টাকা খরচ করে লিবিয়ায় যাই। এখন আমার কিছু নাই। দেনার দায়ে জর্জরিত। কিন্তু ছেলেকে খুঁজে পেয়েছি, এটাই খুশি।

আইওএম কর্মকর্তারা লিবিয়া সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ইয়াকুবকে উদ্ধার করেন উল্লেখ করে শাহিনুর বলেন, ‘তাঁরা ফোনে আমার সঙ্গে ছেলের কথা বলিয়ে দেন। ছেলেকে দেখার জন্য তখন বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। কিন্তু লিবিয়ায় আমাদের দেখা হয়নি। ছেলে তখন ত্রিপলিতে ছিল, আর আমি বেনগাজিতে।’

ইয়াকুব হাসান বলেন, লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার জন্য প্রথমবার এক মাস জেল খাটেন। পরে আবার যাওয়ার চেষ্টা করেন। দ্বিতীয়বার লিবিয়া থেকে ট্রলারে করে ল্যাম্বদোসা দ্বীপে নেওয়া হয়। সেখানে অন্তত দেড় হাজার লোককে ইতালিতে নেওয়ার জন্য জড়ো করা হয়। সবাই ইতালিতে যাবেন। সেখানে কয়েক দিন রাখা হয়। তখন খাবারের প্রচণ্ড কষ্ট পান। ইয়াকুব বলেন, ‘সেখান থেকে ইতালির সিলসিলা যাওয়ার পথে জাওইয়া দ্বীপে মাফিয়াদের হাতে আটকে পড়ে বন্দী হই। পরে আমাদের লিবিয়ার একটি জেলে, যা অনেকটা অন্ধকার গুহার মতো। সেখানে মানবেতর জীবন যাপন করি। তখন আমার কাছে কোনো পাসপোর্ট ছিল না।’

ইয়াকুব হাসানের পুরো শরীরে এখন নির্যাতনের গুটি গুটি হাজার হাজার দাগ। কথাও ঠিকমতো বলতে পারেন না। স্মৃতিশক্তিও দুর্বল হয়ে পড়েছে। কারণ, বন্দী থাকা অবস্থায় অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ইয়াকুব।

শাহিনুর আক্তার বলেন, ‘আমি সুদে টাকা এনে, স্বর্ণ ও গরু বিক্রি করে চার লাখ টাকা খরচ করে লিবিয়ায় যাই। এখন আমার কিছু নাই। দেনার দায়ে জর্জরিত। কিন্তু ছেলেকে খুঁজে পেয়েছি, এটাই খুশি।’ তিনি বলেন, ‘ইয়াকুবের সঙ্গে লিবিয়ায় থাকতে আমার ফোনে কথা হয়েছে। দেখা হয়নি। ইয়াকুব দেশে ফিরেছে ১০ মার্চ। আমি ফিরি ১৬ মার্চ। ছেলেকে ফিরে পেয়ে খুশি।’

অবৈধ পথে বিদেশযাত্রাকে নিরুৎসাহিত করে কুমিল্লা জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসের সহকারী পরিচালক দেবব্রত ঘোষ বলেন, ‘এভাবে বিদেশে যাওয়ার কোনো নিয়ম নেই। এই বিষয়ে আমরা জনসাধারণকে সচেতন করি।’
উৎস: প্রথম আলো।

Logo-orginal