, শুক্রবার, ৩ মে ২০২৪

admin admin

২৮ অক্টোবরে লগি-বইঠার নির্মমতার শিকার শহীদ রফিকের মায়ের স্মৃতিচারণ’

প্রকাশ: ২০২২-১০-২৯ ১৭:৪৯:৫৬ || আপডেট: ২০২২-১০-২৯ ১৮:০০:০৫

Spread the love

আমার তিন ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে সবার বড় মো: রফিকুল ইসলাম। আমার বড় বোনের কোনো সন্তান না থাকায় আমাদের পরিবারে তাকে নিয়ে সবাই ব্যস্ত থাকত। এমনকি রফিকুলের বয়স যখন ২ বছরের একটু বেশি, তখনও সে মায়ের দুধ ছাড়েনি, সে বয়সেই তার নানা ও তার খালা তাকে নিয়ে যান এবং আদর যত্নে নিজেদের কাছে রেখে দেন। এরপর আমার কোলজুড়ে আসে দ্বিতীয় ছেলে ওহাব। এভাবেই সময়ের ব্যবধানে খালার কোলেই বড় হতে থাকে রফিকুল। স্বামী ও সন্তানহীনা তার খালা তাকে নিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখতে থাকেন। আর রফিকুল তার নানা-নানী এবং খালার আদরে থাকতেই পছন্দ করত। কিন্তু এ আদর বেশি দিন তার কপালে টেকেনি। মাত্র ৫ বছর বয়সে তার নানী ও ৭ বছর বয়সে নানা ইন্তেকাল করেন। এরপর খালার বাসাতে থেকেই তার স্কুলজীবন শুরু হয়। তারপর সে মাঝে মাঝে আমাদের কাছে এসে থাকত আর চলে যেত। রফিকুল যখন দশম শ্রেণীর ছাত্র তখন থেকেই আমরা জানতে পারি সে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাথে জড়িত হয়েছে।

শিবির করার পর থেকেই তার মাঝে আমরা অনেক পরির্বতন দেখতে পাই। কিছু দিনের জন্য বাড়িতে এলেই আমাকে সে সময় দিত, নামাজ পড়তে বলত, গ্রামের মানুষ ঝগড়া করলে সে আমাদের সেখান থেকে দূরে থাকতে বলত। অভাবের সংসারে তার ছোট ভাই ওহাবকে তখন আমরা ঢাকায় সোয়েটার কোম্পানিতে পাঠিয়ে দিই। এদিকে আমার বড় বোন রফিকুলকে পড়াশোনা করাতে থাকেন। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর। ঈদের ছুটিতে আমার বোন ও দুই ছেলেকে কাছে পেয়ে খুবই খুশিতে ছিলাম। আমরা জানতাম না যে, সেই দিন কুড়িগ্রাম শহরে মিছিল আছে। আমরা সবাই সেদিন বাড়ির পাশে জমিতে কাজ করছিলাম। কিন্তু এর মধ্যে রফিকের মাঝে একটু তাড়াহুড়া লক্ষ্য করলাম। সে বাড়িতে এসে বলল, আমাকে এক্ষুনি খালার বাড়িতে যেতে হবে আমাকে ভাত দাও। আমরা জানতাম না সে কিসের জন্য এত তাড়াহুড়া করছে? আমি তাকে ভাত খেতে দিলাম তার ধরে আনা মাছ, পছন্দের হাঁসের গোশত ও ডাল দিয়ে। আমি আর তার খালা দু’জনে পাশে বসে তাকে খেতে দিলাম। সে সেদিন অনেক ভাত খেয়েছিল। সে খেতে খেতে তার খালাকে বলল, দেখছো আম্মা কত সুন্দর করে মাছ ভাজতে পারেন? আর ডালটাও কত সুন্দর? কে জানতো, সেটাই তার জীবনের শেষ খাবার? খাওয়া শেষ করে রফিকুল যখন চলে যাচ্ছে, তখন ওর খালা ও আমি বাড়ি থেকে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এলাম। আমরা হয়তো আরো যেতাম কিন্তু তার বাধায় আর যাইনি।

কিন্তু যতক্ষণ সে চোখের আড়াল হয়নি ততক্ষণ আমরা দুই বোন তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আর দেখলাম সে কিছু দূর যাচ্ছে আর পেছনে ফিরে আমাদের দেখছে। কে জানত যে, সেটাই তার শেষ দেখা? কে জানত যে সেটাই তার শেষ বিদায় মুহূর্ত। আমি জানি না কেন তাকে বিদায় দেয়ার পর থেকে আমার আর ভালো লাগছিলো না। আর জানতাম না কেনই বা একটা কাক গাছের ডালে বসে শুধু চিৎকার করছিলো। আর যখন বুঝতে পারলাম আমার কলিজার টুকরা রফিকুল আর নেই, তার পরের স্মৃতিগুলো প্রকাশ করার মতো ভাষা আমার নেই। কিভাবেই বা তা প্রকাশ করা সম্ভব? আমার ছেলেকে হারানোর দু-একদিন পর এক রাতে ঘুমের মাঝে আমার ছেলে আমার সাথে দেখা করতে এলো। আমি তার সাথে কথা বললাম। আমি বললাম ‘ত্ইু না মরে গেছিস?’ সে বলল, ‘আম্মা এ কথা আর কক্ষনো তুমি বলবে না। আমি মরে যাইনি, আমি শহীদ হয়েছি।’ হ্যাঁ সে ইসলামের জন্যই শহীদ হয়েছে, আর আমি তার গর্বিত মা। রফিকুলের শাহাদাতের প্রায় এক মাস পর একদিন রাতে আমি এশার নামাজ না পড়েই ঘুমিয়ে যাই। হঠাৎ দেখি রফিকুল একটা লাঠি হাতে বাড়িতে এসেছে। আর আমাকে বলছে, আম্মা তুমি নামাজ পড়েছো? আমি বললাম, না। তখন সে চলে গেল। তাকে আর খুঁজে পেলাম না। এভাবে আমার সন্তান আল্লাহর কাছে চলে যেয়েও আমার নামাজের খোঁজ নিয়েছিলো। রফিকুলের শাহাদাতের পর শিবিরের ছেলেরা এসে হয়তো আম্মা বলে ডাকবে। তাই শিবিরের ছেলেদের মাঝেই খুঁজে নেয়ার চেষ্টা করি আমার রফিকুলকে। আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ আমার ছেলে যেন শাহাদাতের সর্বোচ্চ মর্যাদা লাভ করে। আমার ছেলের কোনো অপরাধ ছিল না। সে এলাকার ছেলেদের কুরআন শেখাতো, নামাজ পড়াতো। এতো সুন্দর সোনার টুকরো ছেলেকে যে আওয়ামী হায়েনারা আঘাতের পর আঘাতে আমার বুক খালি করেছে আমি তাদের বিচারের অপেক্ষায় আছি। যদি দুনিয়ায় দেখে যেতে না-ও পারি তবে অবশ্যই সবচেয়ে বড় ন্যায়বিচারক মহান আল্লাহর দরবারে বিচার দেখবো ইনশাআল্লাহ। আমিন।

কথা : শহীদ রফিকের মা

#Oct28 #Bangladesh

Logo-orginal