, বৃহস্পতিবার, ২ মে ২০২৪

admin admin

আমার বাচ্চাটাকে ছেড়ে দিন ভাই, কাল ছেলেটার পরীক্ষা”

প্রকাশ: ২০২২-১২-০৮ ০৭:১৮:৩৯ || আপডেট: ২০২২-১২-০৮ ০৭:১৮:৪৪

Spread the love

সন্ধ্যা ৬টা ২১ মিনিট। রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির প্রধান কার্যালয় থেকে দলটির নেতা–কর্মীদের আটক করে প্রিজনভ্যানে তুলছিলেন পুলিশ সদস্যরা। কয়েকজন নারীকেও তোলা হচ্ছিল প্রিজনভ্যানে। তাঁদের মধ্যে এক নারীর সঙ্গে ছিল একটি শিশু।

এ সময় ওই নারী শিশুটিকে নিজের সন্তান বলে পরিচয় দেন। চিৎকার করে বলেন, ‘আমার বাচ্চাটাকে ছেড়ে দিন ভাই। কাল ছেলেটার পরীক্ষা। সে মনিপুর স্কুলে পড়ে। তার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে।’ পরে প্রিজনভ্যানটি নয়াপল্টন থেকে নিয়ে যায় পুলিশ।

বিএনপির এক নারী কর্মী ও তাঁর ছেলেকে আটক করে প্রিজন ভ্যানে তোলা হচ্ছে
বুধবার বেলা তিনটার দিকে নয়াপল্টনে বিএনপির নেতা–কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ শুরু হয়। এ সংঘর্ষে এ পর্যন্ত একজন নিহত হয়েছেন। পরে বিকেল সোয়া ৪টার দিকে পুলিশ বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অভিযান শুরু করে। সেখান থেকে দলটির কয়েক শ নেতা-কর্মীকে আটক করা হয়।

বিএনপির কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে ৩০০ নেতা-কর্মী আটক করা হয়েছে
সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা পর্যন্ত চলে পুলিশের আটক অভিযান। পুলিশ কার্যালয়ের ভেতরে তল্লাশি চালায়, যা শেষ হয় রাত নয়টায়। এরপর ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ নয়াপল্টনে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, এই অভিযানে ৩০০ নেতা-কর্মীকে আটক করা হয়েছে।

বুধবার রাতেই বিএনপির স্থায়ী কমিটির জরুরি বৈঠক হয়। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, নয়াপল্টনে নেতা-কর্মীদের ওপর পুলিশের হামলা, গুলি ও গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার সারা দেশে জেলা ও মহানগরে বিক্ষোভ কর্মসূচি দিয়েছে বিএনপি।

সংঘর্ষে নিহত মকবুল হোসেনের স্ত্রী হালিমা ও মেয়ে মিথিলার আহাজারি। রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগে
সংঘর্ষে নিহত মকবুল হোসেনের স্ত্রী হালিমা ও মেয়ে মিথিলার আহাজারি। রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগে
৩০ নভেম্বর) করেছে বিএনপি।

গত অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে নয়াপল্টনে যেসব সমাবেশ করেছে বিএনপি, এর কোনো কোনোটিতে বিপুলসংখ্যক নেতা–কর্মীর সমাগম ঘটেছিল। আর গত ১ সেপ্টেম্বর বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে নয়াপল্টন থেকে জাতীয় প্রেসক্লাব পর্যন্ত বর্ণিল ও বিশাল শোভাযাত্রা করেছিল দলটি। হাজারো নেতা–কর্মীর দীর্ঘ শোভাযাত্রার কারণে সেদিনও রাজধানীতে তীব্র যানজট ছিল। এসব সমাবেশ–শোভাযাত্রা সরকার বা পুলিশের অগোচরে হয়েছে এমনটি নয়। তবে সরকার তখন নয়াপল্টনের কর্মসূচিতে বাধা দেয়নি। অনুমতি দেওয়া নিয়েও পুলিশের শর্তের এতটা কড়াকড়ি ছিল না। এমনকি নয়াপল্টন ছেড়ে অন্য কোথাও সমাবেশ করার পরামর্শও দেয়নি।

নয়াপল্টনে বিএনপি–পুলিশ সংঘর্ষ, নিহত ১
গত তিন মাসে নয়াপল্টনের প্রতিটি সমাবেশে থেকেই বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছেন। এসব সমাবেশ থেকে সরকারের বিরুদ্ধে ভোট চুরির অভিযোগ আনা হয়েছে। অর্থনৈতিক সংকটের জন্য সরাসরি সরকারকে দায়ী করেছেন বিএনপির নেতারা এবং খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া, টাকা পাচারের জন্য সরকার–ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা জড়িত বলে উল্লেখ করেছেন। মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা, দেশে ভয়ের রাজত্ব তৈরি করা, ভয় দেখিয়ে ও জোর করে সরকার ক্ষমতায় টিকে আছে—এসব অভিযোগ করেছেন। একই সঙ্গে নয়াপল্টনের সমাবেশগুলো থেকে সরকারের পদত্যাগ দাবি এবং নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চেয়েছেন বিএনপির নেতারা।

নয়াপল্টনের বিভিন্ন সমাবেশ থেকে বিএনপি নেতাদের কঠোর বক্তব্য তখন সরকার ‘হজম’ করতে পারলে এখন আপত্তি উঠছে কেন? ১০ ডিসেম্বর বিএনপি নয়াপল্টনে সমাবেশ করতে পারলে আগের কথাগুলোই হয়তো আরও জোরের সঙ্গে বলবে। কেউ পরিবহন ধর্মঘট না ডাকলে বিএনপির ঢাকার সমাবেশ অন্য বিভাগীয় সমাবেশগুলোর চেয়ে হয়তো ‘একটু বড়’ হবে। তবে এবার নয়াপল্টনে বিএনপিকে কিছুতেই যে সমাবেশ করতে দেওয়া হবে না, এর খানিকটা নমুনা দেখা গেছে গতকাল (৭ ডিসেম্বর)। নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে জড়ো হওয়া নেতা–কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন একজন, আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক। এমনকি বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অভিযান চালানোর পাশাপাশি আটক করা হয় দলটির ৩০০ নেতা–কর্মীকে।

গত জুলাই মাস থেকে বিভিন্ন ইস্যুতে বিএনপি ধারাবাহিক আন্দোলন করে এলেও দলটির কিছু করার ‘সামর্থ্য’ নেই—এমন বক্তব্য সকাল–বিকেল অনবরত দিয়ে যাচ্ছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মধ্যম সারির নেতারাও। সরকারের মন্ত্রীদের কেউ কেউ বলছেন, বিএনপিকে ঠেকাতে আওয়ামী লীগ লাগবে না, যুবলীগই যথেষ্ট। পরিস্থিতি এমনই হলে, নয়াপল্টনে বিএনপিকে সমাবেশ করতে দিলে সমস্যাটি আসলে কোথায়, সেটি স্পষ্ট করে কেউ বলছেন না। যানজট, জনদুর্ভোগের যে কথা এখন বলা হচ্ছে, সেটি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১০ ডিসেম্বর বিএনপি সমাবেশ করলেও হবে, সেখানে না (অন্য জায়গায়) করলেও হবে। গত ১১ নভেম্বর যুবলীগ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যে সমাবেশ করেছে, তাতে সকাল থেকেই রাজধানীর একাংশ কার্যত অচল ছিল। ছুটির দিন হওয়া সত্ত্বেও (শুক্রবার ছিল) যানজটের দুর্ভোগ সইতে হয়েছিল। রাজধানীর বাইরে থেকে শত শত বাসে হাজারো নেতা–কর্মীরা ঢাকায় এসেছিলেন। লাখো মানুষের সমাগমের কথা তখন বলা হয়েছিল, ফলে অসহনীয় যানজট ছিল। আর ৬ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের জাতীয় সম্মেলনের কারণে দিনের কিছু সময় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আশপাশের এলাকায় যান চলাচল নিয়ন্ত্রিত ছিল। যানজটের শহরে কিছু সময় কোনো সড়ক বন্ধ রাখা হলে এর প্রভাব কী হতে পারে, সেটি কারও অজানা নয়।

আর সড়কে সমাবেশ করতে না দেওয়ার যে যুক্তি এখন দেওয়া হচ্ছে, সেটি সবার জন্য সমভাবে প্রয়োগ কেন হয় না, সে প্রশ্নও আছে। গত নভেম্বরে রাজধানীর মধ্য বাড্ডা এলাকায় প্রগতি সরণিতে এবং উত্তরার সোনারগাঁও জনপথ সড়কে যান চলাচল বন্ধ রেখে দুটি বড় সমাবেশ করেছিল আওয়ামী লীগ। গত ৫ ও ২০ নভেম্বর রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ দুটি সড়কে ওই দুই সমাবেশের কারণে ব্যাপক জনদুর্ভোগ হলেও ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) তখন নীরব ছিল। এমনকি ওই দুটি সমাবেশ রাস্তার পরিবর্তে খোলা মাঠে করা বা সমাবেশের অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে পুলিশের পক্ষ থেকে কঠোর কোনো শর্ত দেওয়ার কথাও শোনা যায়নি। ফলে জনদুর্ভোগ হবে—এই বিবেচনার চেয়েও এখানে (নয়াপল্টনে) ‘ক্ষমতা দেখানোর’ বিষয়টি বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে, এমন আলোচনা রাজনীতিতে রয়েছে।

গত তিন মাসে যখন বিএনপি নয়াপল্টনে একের পর এক সমাবেশ করছে, তখন সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে একাধিকবার বলা হয়েছে, আন্দোলনে বাধা দেওয়া হবে না। আন্দোলনের কারণে বিএনপির নেতা–কর্মীদের নামে মামলা না দিতে এবং গ্রেপ্তার না করারও আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। এমনকি গত জুলাই মাসে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এমনও বলা হয়েছিল, বিএনপি যদি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচিও দেয়, তাতেও বাধা দেওয়া হবে না। আন্দোলনের কর্মসূচি দিয়ে দলটির নেতারা যদি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পর্যন্ত যান, তাহলে তাঁদের ডেকে নিয়ে চা খাওয়ানোর ইচ্ছাও সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে প্রকাশ করা হয়েছিল।

১০ ডিসেম্বর নয়াপল্টনের সমাবেশ নিয়ে ‘নাশকতা’ হতে পারে—আকারে–ইঙ্গিতে এমন কথা এখন সরকার ও পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। আবার এমনও বলা হচ্ছে, ১০ ডিসেম্বর নয়াপল্টনে ১০ লাখ লোক জড়ো করে বিএনপির নেতা–কর্মীরা সেখানে বসে পড়বেন। যদিও বিএনপি বলে আসছে, অন্য বিভাগীয় সমাবেশের মতোই ঢাকায় সমাবেশ করতে চেয়েছে দলটি। এরপরও সরকারের কাছে যদি ‘নাশকতার’ কোনো তথ্য থাকে, সেটি জনস্বার্থে দ্রুত প্রকাশ করে দেওয়া উচিত। কিন্তু কোন দল কোথায়, কখন সমাবেশ করবে এবং কত লোক নিয়ে করতে পারবে—সেটিও সরকার ঠিক করে দিলে দেশে ‘গণতন্ত্রের’ আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না।
উৎসঃ দৈনিক প্রথম আলো।

Logo-orginal